পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আজ পাকিস্তান নিয়ে লিখবো। বাংলাদেশ নিয়েও অবশ্য লেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। সেটি হলো, বরিশালের ঐতিহাসিক এবং অভূতপূর্ব জনসভা। দুটি পত্রিকায় রিপোর্ট করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই ৫১ বছরে বরিশালে এত বড় জনসভা আর হয়নি। অথচ, এই জনসভা বানচাল করার জন্য সরকারের মদদে বাস মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন যানবাহন বন্ধ করে বা হরতাল করে। একজন আওয়ামী লীগারের মালিকানাধীন বাংলা দৈনিকে তো ফার্স্ট লিড করে নিউজ করা হয়েছে। হেডিং দেওয়া হয়েছে, ‘অনেক বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে বরিশালে বিশাল জনসভা’। খবরের ভেতরে বলা হয়েছে, এটি ছিল স্মরণাতীতকালে বরিশালে অনুষ্ঠিত বৃহত্তম জনসভা। তার পরেও এই বিষয়টি নিয়ে আজ লিখছি না। কারণ, বরিশালকে নিয়ে এ পর্যন্ত ৫টি বিভাগীয় শহরে ৫টি বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হলো। অন্য ৪টি বিভাগীয় শহর হলো চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা ও রংপুর। চট্টগ্রাম ছাড়া অবশিষ্ট ৪টি বিভাগীয় শহরের সভা বানচাল করার জন্যও সরকারি হরতাল পালিত হয়েছে। তারপরেও প্রত্যেকটি শহরে স্মরণাতীত কালের বৃহত্তম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরপর আরো ৪টি শহরে জনসভা হবে। এগুলো হলো ফরিদপুর, সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহী ও সর্বশেষে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায়। এর মধ্যে বরিশালের জনসভাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে প্রচন্ড হুমকি ধামকি দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতি দ্রুত সাংঘর্ষিক পথে ধাবিত হচ্ছে। এও মনে হচ্ছে, অবশিষ্ট ৫টি জনসভাও আগের ৫টি জনসভার মতই বিশাল এবং অভূতপূর্ব হবে। কিন্তু তার আগেই যদি কোথাও কোনো বড় ধরনের ভায়োলেন্স হয় তাহলে ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে রাজনীতি অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হবে। তাই আমি ভাবছি, ফরিপুরের জনসভাটি দেখে নেই। তারপর বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে লিখবো। এখানে একটি কথা বলা দরকার যে, শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও জনসভাগুলোতে যে উপচে পড়া মানুষ দেখা যাচ্ছে, যারা চিড়া-গুড় নিয়ে, নৌকা ও ট্রলারে করে হলেও বিএনপির জনসভায় আসছে সেগুলো দেখে বলতে কোনো দ্বিধা নাই যে, দেশে অভূতপূর্ব গণজাগরণ তৈরি হয়েছে। এখন যে সংকটের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, সেটি হলো বিএনপির নেতৃত্বে হাজার বা লক্ষ মানুষের সাথে শাসক দলের মুখোমুখি হওয়া। যদি সেটা না ঘটে তাহলে দেশ বেঁচে গেল।
আমি এসব আশঙ্কা এজন্য করছি যে, গত ৫ নভেম্বর শাসক দলের তিন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মুখ থেকে তিনটি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, আমরা অনেক ছাড় দিয়েছি। ডিসেম্বর থেকে আর কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। ওবায়দুল কাদেরের কথার স্পষ্ট মানে বোঝা গেল না। ছাড় দেওয়া বলতে তারা কী বুঝিয়েছেন? জনসভা করতে দিয়েছেন, সেটা? ভবিষ্যতে আর ছাড় দেবেন না। তার অর্থ কি এই যে, ভবিষ্যতে আর জনসভা করতে দেওয়া হবে না? স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাধারণত রাজনৈতিক কথা বলেন না। তিনিও ৫ নভেম্বর এই মর্মে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে, আওয়ামী লীগের লাঠি যদি একবার ওঠে তাহলে সেই লাঠি আর নামবে না। তখন বিএনপিকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিএনপি তো শান্তিপূর্ণ জনসভা করছে। সেখানে লাঠিসোটার প্রশ্ন উঠল কেন, সেটি বোঝা গেল না। যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, আগামী ১১ নভেম্বর থেকে ঢাকার রাজপথ আওয়ামী লীগের দখলে থাকবে। এসব হুঁশিয়ারি নিয়মতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভাষা নয়।
॥দুই॥
এবার আসছি পাকিস্তানের রাজনীতি প্রসঙ্গে। সকলেই জানেন যে, ইমরান খান দ্রুত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ইসলামাবাদ অভিমুখে লংমার্চ শুরু করেছেন। লং মার্চের ৭ম কি ৮ম দিনে যখন তার কাফেলা ওয়াজিরাবাদ এসেছিল তখন বেশ কাছে থেকে এক ব্যক্তি একে ৪৭ রাইফেল দিয়ে ইমরান খানের দিকে গুলি চালায়। এই গুলিতে ৮ ব্যক্তি আহত হয়েছেন এবং ১ জন মারা গেছেন। ইমরান খান সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন। তবে তার পায়ে কেউ বলেন ৪টি, আবার কেউ বলেন, ৬টি গুলি লেগেছে। তার পা থেকে ঐসব গুলি অপসারণ করা হয়েছে। এখন তিনি শঙ্কা মুক্ত। কেউ বলছেন এক ব্যক্তি গুলি করতে এসেছিল, আবার কেউ বলছেন, দুই ব্যক্তি। ইমরান খানের কর্মীরা জান বাজি রেখে ঘাতককে পাকড়াও করে এবং পুলিশের কাছে হ্যান্ড ওভার করেন। ঘাতক বলেছে যে, তার টার্গেট ছিল ইমরান খান। সে ইমরান খানকে হত্যা করতে এসেছিল। সুখের বিষয় যে, ইমরান খান আততায়ীর গুলিতে মারা যাননি; বেঁচে গেছেন।
ইমরান খানকে কেন হত্যা করতে চাওয়া হয়েছিল? কারা ইমরানকে হত্যা করার জন্য ঘাতককে নিয়োগ করেছিল? এসব বিষয় এখনও পরিষ্কার নয়। যদি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিচারবিভাগীয় তদন্ত হয়, তাহলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। লাহোরের শওকত খানম মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইমরান এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন যে, এই হত্যা প্রচেষ্টার খবর দুইদিন আগেই তার কাছে পৌঁছেছিল। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছেন পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ এবং সেনাবাহিনীর অ্যাকটিভ মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসির। তাদের বিরুদ্ধে ইমরানের পিটিআই দল মামলা করতে যায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেই মামলা গ্রহণ করেনি। তারা বলেছে যে, মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসিরের নাম অভিযুক্তদের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। কিন্তু এই কলাম লেখার দিন পর্যন্ত ইমরান খান মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসিরের নাম তালিকা থেকে বাদ দিতে রাজি হননি। ফলে মামলাটি ঝুলে আছে।
এখানেই একটি রহস্যের গন্ধ পাওয়া যায়। মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসিরের নাম বাদ দেওয়ার জন্য এত জেদাজেদি কেন? তাকেও আসামী করে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক। তিনি যদি নির্দোষ হন তাহলে যথাযোগ্য মর্যাদায় তিনি খালাস পাবেন। আর যদি দোষী হন, তাহলে শুধু তিনিই নন, সেক্ষেত্রে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে সাপ বেরিয়ে আসবে। ইমরান খানকে যখন প্রধানমন্ত্রীর গদি থেকে নামানো হয় তখন আমি ইনকিলাবের এই কলামে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম। সেটার জের ধরে বলছি, এই হত্যা প্রচেষ্টা পাকিস্তানকে একটি গভীর সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখন পাকিস্তান সুষ্পষ্টভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে রয়েছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার। সেই সরকারকে পেছন থেকে সাহায্য এবং শক্তি যোগাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়ার নেতৃত্বাধীন ৭ লক্ষ সদস্য বিশিষ্ট শক্তিশালী সেনাবাহিনীর একটি অংশ। অন্যদিকে আছে কোটি কোটি পাকিস্তানি জনতার সমর্থনপুষ্ট অবিসংবাদিত জননেতা কাপ্তান ইমরান খান।
॥তিন॥
অনেকে ইমরান খানের এই রাজনৈতিক লড়াইকে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক লড়াইয়ের সাথে তুলনা করেছেন। শেখ মুজিবের পেছনে ছিল সাবেক পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। তার সেই জনসমর্থন ’৭০ সালের নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। ইমরান খান নিজেই বলেছেন যে, শেখ মুজিব ঐ নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলেন। তখনও পাকিস্তানে ছিল ইয়াহিয়া খানের সেনাশাসন। ইমরান খান অতি সম্প্রতি বলেছেন যে, যেহেতু শেখ মুজিব সারা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিলেন তাই সামরিক জান্তার উচিত ছিল, শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শেখ মুজিব কী করতেন সেটি পরের কথা।
এখন দেখা যাচ্ছে যে, ইমরান খান সারা পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা। পাঞ্জাব, সিন্ধু, খাইবার পাখতুনখোয়া (সাবেক সীমান্ত প্রদেশ) এবং আজাদ কাশ্মীর, গিলগিট ও বাল্টিস্তানে রয়েছে তার বিপুল জনপ্রিয়তা। বেলুচিস্তান পাকিস্তানে ভৌগোলিক আয়তনের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় প্রদেশ। কিন্তু জনসংখ্যা সবচেয়ে কম। এবার ইমরান খান গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর বেলুচিস্তানের, বিশেষ করে তার রাজধানী কোয়েটার জনগণ রাস্তায় নেমে আসেন এবং এমন বিক্ষোভ করেন যে, পুলিশ কোয়েটার সমস্ত প্রবেশ মুখ বন্ধ করে দেয়।
ইমরান খান কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেননি। তিনি দ্রুত নির্বাচনের জন্য দুর্বার আন্দোলন করছেন। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। সেই শাসনতন্ত্র মোতাবেক ১৯৫৮ সালে সারা পাকিস্তানে সর্ব প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু সেই নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। তার আগেই জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন। ১০ বছর তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের দুই অঞ্চল অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে যথাক্রমে শেখ মুজিব এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান হয়। সেই অভ্যুত্থানের পর আইয়ুব খানের নিকট থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ইয়াহিয়া খানের আমলে সর্বপ্রথম সারা পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিব এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো জনগণের নেতা হিসাবে উত্থিত হন। কিন্তু সেই নির্বাচনেও ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি। ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউন এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তিনিও মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। আবার পাকিস্তানে জেনারেল জিয়াউল হকের নেতৃত্বে সামরিক শাসন জারি হয়। জিয়াউল হক ৯ বছর শাসন করেন। জিয়াউল হকের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর কিছুদিন পাকিস্তানে গণতন্ত্র ছিল। কিন্তু তারপর জেনারেল পারভেজ মোশাররফের নেতৃত্বে ৪র্থ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে।
এবারের পরিস্থিতি অনেকটা ঐরকম হলেও অন্যদিক দিয়ে অনেকটা ভিন্ন। আগেই বলেছি যে, আমেরিকা ও সামরিক বাহিনী সমর্থিত শাহবাজ শরীফের কায়েমী স্বার্থবাদের বিরুদ্ধে সারা পাকিস্তানের জনগণ ইমরান খানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। পাকিস্তানের ৭৫ বছরের ইতিহাসে এবারই সর্বপ্রথম কোটি কোটি মানুষকে নিয়ে ইমরান খান পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিন্তু বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছেন। এই লড়াইয়ে যদি ইমরানের জয় হয়, তাহলে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, দেশটি মার্কিন আধিপত্যবাদ এবং সামরিক বাহিনীর অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হবে। আর পরাজিত হলে পাকিস্তানের ২২ কোটি মানুষ দেশি-বিদেশি সম্মিলিত কায়েমী স্বার্থবাদের কালো থাবার শিকার হবেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।