Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

পরিবেশদূষণ রোধ করে চামড়াশিল্পের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে

মনিরুল হক রনি | প্রকাশের সময় : ৮ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

সারা দেশে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য চামড়া ফ্যাক্টরি। পূর্বে হাজারীবাগ চামড়াশিল্পের জন্য সুপরিচিত থাকলেও সাভারে স্থানান্তরের পরে সাভারই এখন পরিচিতি লাভ করেছে চামড়াশিল্প নগরী হিসেবে। বর্তমানে এখানে ছোট-বড় ১৪০টি চামড়া ফ্যাক্টরি উৎপাদনে রয়েছে। একদিকে, এই বিপুল সংখ্যক চামড়া ফ্যাক্টরি আমাদের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে, এটি পরিবেশ দূষণের জন্য বিপজ্জনক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে, পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদী চামড়ার বর্জ্য দ্বারা দূষিত হচ্ছে অতিমাত্রায়। দূষিত হচ্ছে এ এলাকার পানি, মাটি, বায়ু এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। ধলেশ্বরী নদীর পানি ধারণ করেছে ভয়ঙ্কর কালো রঙ। চামড়া বর্জ্যের উৎকট দুর্গন্ধে এখানকার পরিবেশ হয়ে উঠেছে পুঁতি-দুর্গন্ধময়। এর আশপাশের এলাকায় এমন এক অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, সেখানে বসবাস করাই দায় হয়ে উঠেছে। বর্ষাকালে পরিবেশ পরিস্থিতির অবস্থা হয় আরও করুণ। পরিবেশ দূষণের মাত্রা এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেছে যে, খোদ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি পরিবেশদূষণের দায়ে চামড়াশিল্প নগরী সাময়িক বন্ধের সুপারিশ করেছে। এমনকি সম্প্রতি চামড়াশিল্প নগরী পরিদর্শন করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানও।

সামগ্রিক পরিবেশদূষণে এ শিল্পের ভয়াবহ চিত্রের কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায় পূর্বের কতিপয় পরিসংখ্যানিক তথ্যে। এক জরিপ বলছে, পূর্বে হাজারীবাগে অবস্থিত ট্যানারিগুলো থেকে দৈনিক উৎপন্ন ২১,৬০০ ঘন মিটারের বেশি তরল এবং ১৫০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্যের একটি বড় অংশের ঠিকানা ছিল পার্শ্ববর্তী বুড়িগঙ্গা নদী। আর বাংলাদেশ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্যা মতে, হাজারীবাগে অবস্থিত ট্যানারিগুলো থেকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ক্রোমিয়ামসহ প্রতিদিন সম্মিলিতভাবে ২২০০০ লিটার বিষাক্ত বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশতো। বাংলাপিডিয়ার তথ্যানুসারে, হাজারীবাগে অবস্থানকালে ১৪৯টি ট্যানারি থেকে দৈনিক উৎপন্ন প্রায় ১৮০০০ লিটার তরল এবং ১১৫ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্যের প্রায় পুরোটাই বুড়িগঙ্গা নদী এবং প¦ার্শবর্তী ড্রেন ও নর্দমায় ফেলা হতো। (পৃ.২৪৩, ভলিউম-৫, ২০০৩) উল্লিখিত পরিসংখ্যানিক তথ্যাবলী অতি পূর্বের ও হাজারীবাগকেন্দ্রিক হলেও এ অবস্থার খুব যে পরিবর্তন হয়েছে, তা কিন্তু নয়। সাভারে স্থানান্তরিত হওয়ার পরেও ট্যানারি ফ্যাক্টরিগুলো বলা যায় ঐ একই মাত্রায় দূষিত বর্জ্য উৎপন্ন করে চলেছে। পরিবর্তন যেটি হয়েছে, সেটি নদীর। আগে দূষিত হতো বুড়িগঙ্গা, আর এখন সে জায়গা দখল করেছে ধলেশ্বরী। তবে বুড়িগঙ্গা যে একেবারে রেহাই পেয়েছে, তাও কিন্তু নয়।

বর্তমানে সাভারে অবস্থিত ট্যানারিগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপন্ন হয়। অথচ, এখানকার কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) দৈনিক পরিশোধন ক্ষমতা ২৫ হাজার ঘনমিটারের মতো। বাকি প্রায় পনেরো হাজার ঘনমিটার বর্জ্য কোনো ধরনের ট্রিটমেন্ট ছাড়াই ধলেশ্বরী নদীতে চলে যাচ্ছে। এছাড়া যেটা সলিড বেজড বা কঠিন বর্জ্য- সেটার ট্রিটমেন্টের তো কোনো ব্যবস্থাই নেই। একটি চামড়া শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রক্রিয়াকরণে ক্ষতিকারক ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, জিঙ্কের মতো প্রায় ৯২ ধরনের কেমিক্যাল দরকার হয়। যদিও এখানে ৪৫টির বেশি ব্যবহৃত হয় না। কেমিকেলমিশ্রিত এসব বিষাক্ত তরল বর্জ্য নদীতে মিশে পানিতে থাকা মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে; নষ্ট করছে জলীয় পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য।

এসব চামড়া কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের অবস্থায়ও শোচনীয়। তাদের অধিকাংশই নিরাপত্তার জন্য কোনো প্রতিরক্ষামূলক হ্যান্ড গ্লাভস বা ফেস মাস্ক ব্যবহার করে না এবং এগুলো ব্যবহার করানোর ক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষেরও যেন কোনো হেলদোল নেই। ফলে তাদের বেশিরভাগই আক্রান্ত হচ্ছে স্কিন ক্যান্সার, ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, ত্বকের ক্ষত ইত্যাদির মতো দুরারোগ্য ও ভয়ঙ্কর রোগে এবং কেউবা হারাচ্ছে অকালে প্রাণ। কারখানায় ব্যবহৃত বিষাক্ত গ্যাসের কারণে অনেক শ্রমিক দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে ফেলছে। বাংলাদেশ সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (এসইএইচডি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাসায়নিক দূষণের কারণে প্রায় ৫ লাখ মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে এবং এখানকার প্রায় ৮ হাজার থেকে ১২ হাজার শ্রমিক গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল, চর্মরোগ এবং অন্যান্য রোগে ভুগছেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশেরই ৫০ বছর বয়সের আগেই অকাল মৃত্যু ঘটছে। তাছাড়া ট্যানারির দূষিত বাতাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে প্রায়ই ডায়রিয়া, পেটের সমস্যা এবং বমি বমি ভাব ইত্যাদির মতো রোগের সৃষ্টি করছে। বর্ষা মৌসুমে চামড়া বর্জ্যগুলো পার্শ্ববর্তী ফসলি জমিতে মিশে খর্ব করছে জমির উর্বরতা শক্তি। শুধু তাই নয়, বায়ু, পানি এবং মানব স্বাস্থ্যের ক্ষতির পাশাপাশি মাটি এবং বৃক্ষরাজিও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে চামড়া বর্জ্য দ্বারা। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব হলে নদী পার্শ্ববর্তী বাসিন্দারা গৃহস্থালি কাজে নদীর পানি ব্যবহার করেন। এতে খাদ্যে বিষক্রিয়াসহ চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কেউ কেউ। সর্বোপরি, চামড়াশিল্প এলাকার সার্বিক পরিবেশ সুস্থ জীবনযাপনের জন্য যে চরম দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, তা বলাই বাহুল্যা। হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্প সাভারে স্থানান্তরের সিদ্ধান্তের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল, বুড়িগঙ্গা নদীকে ওই শিল্পের দূষণ থেকে মুক্ত করা এবং হাজারীবাগ ও তার আশপাশের এলাকায় বসবাসরত বিপুল জনগোষ্ঠীকে দূষণজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই শিল্প স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে এর দূষণও স্থানান্তরিত হয়েছে; স্থানান্তরিত হয়েছে মানুষের দুঃখ-দুর্দশাও। কারণ, একই ধরনের দূষণের শিকার হচ্ছে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদী এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশগত নানা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এ শিল্পনগরীর আশেপাশে বসবাসকারী মানুষজন। কারণ, সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কার্যত কোনো লাগসই এবং টেকসই ব্যবস্থাই এখনো গড়ে ওঠেনি।

সাভারের হেমায়েতপুরে নতুন চামড়াশিল্পপল্লী গড়ে তোলার পরিকল্পনায় বর্জ্য পরিশোধন ও নিষ্কাশনের যে শর্তগুলো ছিলো, অনেকাংশেই সেগুলো লঙ্ঘিত হচ্ছে। কারখানাগুলোর নিজ নিজ অপরিশোধিত বর্জ্য স্ক্রিনিং ব্যবস্থার খামতি তো রয়েছেই, কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারও (সিইটিপি) পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি এখনো। কঠিন ও তরল বর্জ্য পৃথকীরণের কারিগরি ব্যবস্থাও অপ্রতুল। অসম্পূর্ণ রয়েছে ডাম্পিং ইয়ার্ড। সিইটিপি ও ডাম্পিং ইয়ার্ড চালু না করার ফলে শুধু যে প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি বাড়ছে, তা নয়। খোদ চামড়াশিল্পের ওপরও পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব। বাংলাদেশ থেকে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমে যাচ্ছে; অর্জন করতে পারছে না যথেষ্ট কমপ্লায়েন্স। ফলে আমাদের চামড়াশিল্প ‘লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (এলডব্লিউজি) নামের বৈশ্বিক সংগঠনের মানসনদ অর্জনে এখনো ব্যর্থ। ফলে পদে পদেই বিঘ্নিত হচ্ছে এ শিল্পের উন্নয়নমুখী অগ্রযাত্রা। এছাড়া দেখা গেছে, কঠিন বর্জ্যের একটা অংশ উৎপাদন নিষিদ্ধ পোল্ট্রি ও মৎস্য ফিড, আঠা ইত্যাদি তৈরির জন্য পুনঃব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু এগুলোর উৎপাদন প্রক্রিয়া (বয়লিং, রোদে শুকানো ইত্যাদি) অপরিবেশবান্ধব। এগুলো পরিবেশদূষণকে আরো বেশি ত্বরান্বিত করছে। এমতাবস্থায় চামড়া শিল্প কর্তৃক সৃষ্ট পরিবেশদূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ অতি জরুরি হয়ে পড়েছে।

ট্যানারি শিল্পে কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিক নিরক্ষর। তাদের না আছে শ্রমিক নিরাপত্তা সম্পর্কে জ্ঞান, না আছে ট্যানারি শিল্পে কাজ করার ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে জ্ঞান। শুধু জীবিকার তাগিদে কাজ করতে হয় তাই করে। এ সমস্ত শ্রমিকদের চামড়া ফ্যাক্টরিতে কাজ করার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক স্থানে ট্যানারির বর্জ্য রাস্তার পাশে স্তূপাকারে পড়ে থাকতে দেখা যায়। যা বাতাসকে দূষিত করে। এক্ষেত্রে এসব বর্জ্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে ডাম্পিংয়ের জন্য যেমন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকা দরকার, তেমনি দরকার সিইটিপি কার্যকরসহ চামড়া শিল্পের আধুনিকায়নে জোর পদক্ষেপ। এছাড়া ট্যানারির সাথে সম্পর্কিত বাই-প্রোডাক্ট শিল্পগুলিও যাতে বিদ্যমান পরিবেশগত নিয়ম ও প্রবিধান মেনে চল, সেজন্য কঠোরতা আরোপ করতে হবে।

পরিবেশদূষণ বর্তমান বিশ্বের একটি মারাত্মক সমস্যা। একটি দূষণমুক্ত বিশ্ব সকলের অন্যতম চাওয়া হওয়া স্বত্ত্বেও প্রতিনিয়তই বাড়ছে পরিবেশদূষণ। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চামড়া শিল্পের মতো একটি ক্রমবর্ধমান শিল্পের অবদান অস্বীকার করার জো নেই ঠিকই। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনা, প্রাচীন প্রযুক্তির ব্যবহার, যথাযথ অবকাঠামোর অভাব, অসচেতনতা, শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি, আর্থিক সঙ্কট ইত্যাদির কারণে এ শিল্প দিন দিন দেশের পরিবেশ ও জনসংখ্যার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে প্রায় শতাব্দী প্রাচীন এই শিল্প যে একদিন বিলীনের খাতায় নাম লেখাবে, তা বলাই বাহুল্য। তাই পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের উপর চামড়া শিল্পের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে দীর্ঘমেয়াদি, আধুনিক ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।


লেখক: সমাজকর্মী ও প্রভাষক, সাভার সরকারি কলেজ, ঢাকা,
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন