Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তারা কারো অচেনা নয় কিন্তু অধরা

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ৬ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেই। সুবিধাবাদী শ্রেণী বা মধ্যসত্বভোগীরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কৌশল তৈরি করে নিত্য পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কখনোই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ভোগ্যপণ্যের সব ধরনের ব্যবসা এখন কর্পোরেট গ্রুপের হাতে। এখানে সব প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত। কোনো কোনো ব্যবসায় সরকারের মন্ত্রীরাও আছেন। ফলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না বা ব্যবস্থা নেয় না। মজুতের বিরুদ্ধে যে আইন আছে, তাও প্রয়োগ করা হয় না। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশির ভাগ পণ্যের দাম যখন বেড়েই চলেছে, তখন শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা স্বীকার করেছেন, পণ্যের দাম ওঠানামার পেছনে একটা সিন্ডিকেট সব সময় কাজ করে। একই সঙ্গে পণ্যের দাম বাড়ার জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে দাম আগের অবস্থায় না থাকাও একটি বড় কারণ।

‘সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকার কাজ করছে’ এ ধরনের কথাবার্তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু সেই সিন্ডিকেটের চেহারা-চরিত্র কী, সেটি জানা যায় না। সিন্ডিকেট বরাবর অধরাই থেকে যায়। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যতই বলেন সিন্ডিকেট ভেঙে দেবেন, ততই তারা আরও সংহত হয়। কোনো পণ্যের দাম হঠাৎ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেলে মন্ত্রী-আমলাদের কিছু তৎপরতা দেখা যায় বটে। তাৎক্ষণিক কোথাও কোথাও ব্যবসায়ীদের আড়তে অভিযান চলে, কোনো কোনো খুচরা ব্যবসায়ীর জেল-জরিমানাও হয়। কিন্তু রাঘববোয়ালেরা সবসময় আড়ালেই থেকে যায়। ফলে দেশে সিন্ডিকেট, বিশেষ করে বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে কয়েকদিন পর পরই এইরকম হইচই এখন অহরহই দেখা যায়। এই সিন্ডিকেটের মূল কাজ হলো সরবরাহ ব্যবস্থায় বাধা দেয়া। এটা করতে গিয়ে তারা পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং পণ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেয়। মূল কথা হলো, বাজারে পণ্যের সরবারাহ ও চাহিদার স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে বাধাগ্রস্ত করা। বাজারে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কমিয়ে দিলেই দাম বেড়ে যায়। তবে এটা করতে হলে বাজারের বড় একটি অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হয়।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার এ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করে না বা করতে পারে না বলে নিয়ম রয়েছে। দেশে বাজার অর্থনীতি নিয়ে এ ধরনের কিছু কথামালার প্রচলন রয়েছে বহুদিন থেকেই। কার্যত এগুলো একদম বাজারি কথা। কথার নামে কুকথা। তারওপর এসব কথার মধ্যে এন্তার ফাঁকফোকর। প্রশ্ন তো বাজারে হস্তক্ষেপের নয়, বাজার নষ্টের হোতাদের শায়েস্তা করার। সেইক্ষেত্রে কেবল হস্ত নয়, লাগলে পদের ব্যবহার মানে পদক্ষেপও প্রত্যাশিত। এটি সরকারের দায়িত্বও। নিশ্চয়ই সরকারও তা অস্বীকার করছে না। অস্বীকার করছে না বলেই মাঝে মধ্যে নামে মাত্র ধরপাকড়- জরিমানাসহ অভিযান চলে ছোট্ট খাটো সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। এতে সুফলটা কাক্সিক্ষত মাত্রায় আসে না। অভিযানকারীরা চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে দুর্বৃত্তরা বেঁকে বসে। পারলে আগের চেয়ে আরেকটু বেশি করে।

চিনি-পেঁয়াজ থেকে শুরু করে নুন-মরিচ, কচুর লতি-শুটকি পর্যন্ত এদের নিয়ন্ত্রণে। জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম, মজুত, সরবরাহের নিয়ন্ত্রকও তারা। সম্প্রতি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জরুরিভিত্তিতে একগুচ্ছ নির্দেশ জারি করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল মতবিনিময় সভায় এ নির্দেশনাবলি জারি করা হয়। সভায় গুরুত্ব পায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রস্তুতি, আমন ও রবি ফসলের উৎপাদন, সার মজুতের বিষয়ও। সব ছাড়িয়ে যায় চিনি ইস্যু। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজের পর চিনি নিয়ে ছিনিমিনি এ সময়ের আলোচিত ঘটনা। নিঃসন্দেহে বৈঠকটি হাই-প্রোফাইলের। নির্দেশগুলোও তাৎপর্যময়।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই চালবাজিসহ বাজার পরিস্থিতির হোতা কারা? এদের আগে বলা হতো চক্র। গত বছর কয়েক ধরে ডাকা হয় সিন্ডিকেট নামে। এদের কারণেই সিন্ডিকেট নামের সুন্দর শব্দটির অর্থ বদলে গেছে। সিন্ডিকেট শব্দটি ফরাসি ভাষা থেকে আগত। উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ সিন্ডিকাস থেকে। ব্যাখ্যায় সিন্ডিকেট হলো: ব্যক্তি, কোম্পানি, করপোরেশন বা সংস্থার একটি স্বসংগঠিত গোষ্ঠী যা কিছু নির্দিষ্ট ব্যবসায় লেনদেন করার জন্য অথবা একটি অংশীদারত্বমূলক স্বার্থ অনুসরণ বা প্রচারের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়।

মেরিয়াম ওয়েবস্টার ডিকশনারি অনুসারে সিন্ডিকেট হলো এমন একটি দল, যারা একসাথে কাজ করে। এটি একটি কাউন্সিল, সংস্থা বা সমিতি হতে পারে, যা আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণ বা কোনো অফিস বা এখতিয়ারের সাথে ব্যবসা করার জন্য অনুমোদিত। মোটকথা, সিন্ডিকেট একটি সংগঠন বা তার সদস্যদের সাধারণ স্বার্থের উদ্যোগের জন্য তৈরি কোনো সংস্থা তথা প্রতিষ্ঠান।

অভিধানে সিন্ডিকেটের প্রথম সংজ্ঞা হচ্ছে, ব্যবসায়িক উদ্যোগ বা সংগঠিত সংস্থাগুলির একটি যৌথ প্রকল্প যা যৌথ মূলধন প্রয়োজনের জন্য গঠিত। কিন্তু, বাস্তবটা ভিন্ন। কিছু লোকের কাণ্ডকীর্তিতে ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটির ব্যবহার প্রায়ই অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত অর্থ হয়ে গেছে। অথচ এক সময় সিন্ডিকেট শব্দটি স্মার্ট ছিল। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে সিন্ডিকেট-এসোসিয়েটস ধরনের শব্দ ব্যবহারে জৌলুস ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মেম্বার বলতে অন্যরকম গর্ব হতো। এখন ব্যবহার হয় দুষ্টচক্র অর্থে। দেশে সিন্ডিকেট বলতে এখন বোঝায়, মধ্যস্বত্বভোগী। তারা এ সমাজেরই অংশ। আমাদের চারপাশে বা মধ্যেই তাদের বিচরণ। তারা নিজেদের ‘সিন্ডিকেট’ বলে পরিচয় দেয় না। আবার কেউ আঙুল তুলে তাদের সিন্ডিকেট নামে ডাকে না। কিন্তু, নাম-ঠিকানাসহ জানে, চেনে। সরকারের দিক থেকেও সিন্ডিকেট শব্দ ব্যবহার হয়। তাদের ধমকায়। আহ্বান জানায়। কিন্তু, পরিচয় করিয়ে দেয় না।

দেশে বর্তমানে এই সিন্ডিকেট সাহেবদের কর্মপরিধি কেবল চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণসহ নিত্যপণ্য নিয়ে নয়, পরিবহন, ব্যাংক-বীমা, গ্যাস-বিদ্যুৎ, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি, ঠিকাদারী, সরকারি কেনাকাটাসহ প্রায় সব সেক্টরেই। এদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য-চিকিৎসাও। একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মিলে উদ্দেশ্য হাসিল করে চলছে তারা। শুধু সাধারণ মানুষের জীবন নাজেহাল নয়, সরকারকেও অক্টোপাসের মতো গিলে ফেলার অবস্থা করে দিচ্ছে এ সিন্ডিকেট। বিভিন্ন সেক্টরে ঘটনাচক্রে নানান সিন্ডিকেটের কথা আসে। তা রাজনীতিতেও। নেই কেবল গরিবদের সিন্ডিকেট। তবে, গরিবদের উদ্দেশ্য করে সিন্ডিকেট বেশ ক্রিয়াশীল। নিজেদের স্বার্থে এরা যেকোনো সময় জনগণকে জিম্মি করে ভোগান্তিতে ফেলতে কার্পণ্য করে না। এরা এক সেক্টরেও থাকে না। দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারেও এরাই। মানবপাচার, খুন, গুম, ধর্ষণ ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। মৌসুম দৃষ্টে সেক্টর বদলায় অদৃশ্য শক্তির মতো। বিভিন্ন সেক্টরে মামুরা আর খালুরার মতো তারা তারাই করে যাচ্ছে নানা অপকর্ম। নানান কথা হলেও এরা বরাবর ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। চুরির ওপর শিনাজুরিতে এরা কেবল ক্রেতাকূলকে নয়, গোটা দেশ এমন কি সরকারকেও কাহিল করে ফেলে। সরকার গড়পড়তা ভোক্তাদের সাশ্রয়ী হতে বলে। কিন্তু, সিন্ডিকেটকে সেভাবে আহ্বান বা নির্দেশ গেলাতে পারে না। কে সিন্ডিকেট বা সিন্ডিকেটের সদস্য তা শনাক্ত করার পদক্ষেপ নেয় না। দমনের চেষ্টা করেও কুলাতে পারে না। এ এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা। কিন্তু, এরা মোটেই সরকারের চেয়ে শক্তিশালী নয়। সরকার যে তাদের দমন বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে না-এমনও নয়। কিন্তু কেন কুলাতে পারে না, কী করলে পারবে-এ আলোচনা বেশি বেশি হওয়া দরকার। সিন্ডিকেটের কাজের দায়-বদনামের সিংহভাগ গড়ায় সরকারের ওপর। সরকার অসহায় ও বিব্রতকর অবস্থায় পড়লে এদের কিচ্ছু আসে-যায় না।


তারপরও সরকার কোনো কোনো সময় নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে দাম বেঁধে দেয় কিন্তু বিক্রেতারা সেটা মানে না। তারা তাদের ইচ্ছেমতো দামেই পণ্য বিক্রি করে। কারণ, এটি নিয়ন্ত্রণে সরকার সুনির্দিষ্ট কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। যা আছে তা শুধু কাগজে-কলমেই। ফলে এই দাম বেঁধে দেওয়া লোক দেখানো বলছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

দেশে আগে শুধু মিলারদের কাছে ধান মজুত থাকত। এখন শুধু মিলার নয়, মৌসুমি ধান ব্যবসায়ী, বড় বড় অনেক কোম্পানি, এমনকি অনলাইন ব্যবসায়ীরাও ধান/চাল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

পরিশেষে বলবো, সরকারের উপর মহল থেকে জনগণকে শুধু সাশ্রয়ী আর সাবধান হওয়ার ঘোষণা দিলেই চলবে না, পাশাপাশি নিত্য খাদ্যপণ্যের মূল্য নিয়ে কারসাজি রোধে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে। যেসব অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফার জন্য সময় ও সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, বাজারে প্রকৃত তদারকির মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে নিতে হবে ব্যবস্থা।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]



 

Show all comments
  • hassan ৭ নভেম্বর, ২০২২, ৯:৩৯ পিএম says : 0
    দেশের সরকার প্রধানরা যখন লুটেরা তখন ত সিন্ডিকেট তো দেশের মানুষকে না খাইয়াই মারবে আর পয়সা ইনকাম করবে এরা মনে করে সে আল্লাহর কাছ থেকে এই পয়সা দিয়ে জান্নাত কিনবে মরে দেখো সরাসরি জাহান্নামে যাবে>>>>কারণ এরা নরখাদক নরপিচাশ নরাধম এদের কোন মানবতা নাই এরা মানবতার শত্রু
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন