Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্য কবে কাটবে?

ড. মো. কামরুজ্জামান | প্রকাশের সময় : ৫ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে এশিয়ার অনেক দেশই খ্যাতি অর্জন করেছে। তবে এ অর্জনে যেসব দেশ শীর্ষে অবস্থান করছে তার মধ্যে অন্যতম হলো দক্ষিণ কোরিয়া। আন্তর্জাতিক সকল জরিপে প্রাথমিক শিক্ষায় দক্ষিণ কোরিয়া অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চেয়েও দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্যের হার অনেক বেশি। দেশটি প্রাক শৈশবকাল হতে শিশুদের মৌলিক শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। নার্সারি স্তরে প্রাক শৈশবেই শিশুর সিলেবাসে কল্যাণমূলক নীতির প্রতিফলন ঘটানো হয়। দেশ স্বাধীনের সূচনালগ্ন থেকেই পরিকল্পনামাফিক এ শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হয়। দেশের গ্রাম-গঞ্জসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে নার্সারি শিক্ষার প্রসার ঘটে। দেশটিতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শিশুশিক্ষার ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়। শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠানে ধর্র্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন নিয়ম-কানুন শিক্ষা দেয়া হয়। সরকার এ বিষয়ে উৎসাহ ও সামগ্রিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। এ স্তরে ৬ বছর বয়সে একটি শিশু প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। এ বয়সেই কোরীয় শিশুদের মাতৃভাষা, শারীরীক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। গণিত, বিজ্ঞান ও চারু-কারু বিষয়েও স্বল্প পরিসরে পাঠ দান করা হয়ে থাকে।

কোরিয়ার প্রতিটি পরিবার সন্তানকে উচ্চ শিক্ষাদানে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করে থাকে। তারা তাদের সন্তানকে গড়ে তুলতে সর্বস্ব উজাড় করে দেয়। কোরীয়বাসী তাদের সন্তানদের মানুষ করাকে জাতীয় প্রজেক্ট মনে করে। দেশের সাধারণ জনতার মাঝে শিখন-পঠনে রয়েছে অপার আগ্রহ। মাত্র সাড়ে তিন দশকে কোরিয়ার পথচলা একবারেই স্বপ্নের মতো। কোরিয়া তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সাজিয়েছে বর্ণিল সাজে। জাতির বীজ রোপণের ধাপ হিসেবে সর্বপ্রথম তারা শিক্ষাকেই বেছে নিয়েছে। প্রাথমিকের মতো উচ্চ শিক্ষাকেও তারা কর্মমুখী ও সৃজনশীল করে সাজিয়েছে। উদ্ভাবন ও গবেষণার বহুমুখিতার কারণে কোরীয় শিক্ষা ইতোমধ্যেই বিশ^দরবারে সমাদৃত ও নন্দিত হয়েছে। আর সে কারণে তৃতীয় বিশে^র শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করতে কোরিয়ায় ভিড় জমিয়েছে। মূলত বাধাহীন শিক্ষার স্রোত কোরিয়ানদের শিক্ষার সাগরে ভাসিয়েছে। পাশাপাশি আমজনতার শেখার আগ্রহে পাল তুলেছে রাষ্ট্র নায়কগণ। রাষ্ট্রের পরিচালকরা উন্নত ও কর্মমুখী শিক্ষা নিশ্চিতে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। দেশটি শিক্ষাখাতে দুই হাত উজাড় করে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশটি গত তিন দশকে শুধু টেকনিক্যাল খাতে যে ব্যয় করেছে, তা থেকে লভ্যাংশ এসেছে কয়েক লাখ গুণ! চলমান শতাব্দীতে কোরিয়া টেকনিক্যাল খাতে শুধু এশিয়াতেই নয়, গোটা বিশে^ সেরা সাফল্য অর্জন করেছে। কয়েকবছর ধরে বিশে^র সেরা শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা।

দক্ষিণ কোরিয়ার উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিনিয়তই বিশ^ র‌্যাংকিংয়ে জায়গা করে নিচ্ছে। সেদেশের বিশ^দ্যিালয়গুলো প্রতিযোগিতায় আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ^জুড়ে। সিউল ন্যাশনাল বিশ^বিদ্যালয়, কোরিয়া বিশ^বিদ্যালয়, হংগিক বিশ^বিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সকল বিশ^বিদ্যালয়ই বিশ^ র‌্যাংকিংয়ে জায়গা করে নিয়েছে। অথচ, আশির দশকেও দেশটি ছিল গরিব আর অনুন্নত। যুদ্ধবিধ্বস্ত আর জরাজীর্ণ দেশটির অবকাঠামো ছিল একবারেই ভঙ্গুর। দেশের মানুষ ছিল অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত ও নিরক্ষর। মূলত শিক্ষা ও গবেষণাই কোরীয়জাতিকে উন্নত আসনে সমাসীন করেছে। কোরিয়ার শতকরা প্রায় ১০ জন মানুষ সরাসরি গবেষণার সাথে জড়িত। তারা প্রতিনিয়ত নিত্য নতুন টেকনোলজি উদ্ভাবন করে চলেছে। তারা এগুলোর বাণিজ্যিকিকরণের মাধ্যমে দেশের আয় বৃদ্ধি করছে। কোরিয়ার উন্নত উদ্ভাবনীর অন্যতম হলো এলজি, স্যামসাং, কেয়াসহ নানা কোম্পানি। সচেতনমহলের সকলেই এসব কোম্পানির নামের সাথে পরিচিত। এ কোম্পানিগুলো বিশ^ব্যাপী দাপটের সাথে ব্যবসা করে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ^ময় এসব কোম্পানির প্রডাক্টগুলো গ্রাহকের কাছে খুবই জনপ্রিয় হিসেবে বিবেচিত।
কোম্পানি ব্যবসার বাইরে কৃষিতেও তারা ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে। এক্ষেত্রে তারা অভাবনীয় উদ্ভাবন আবিষ্কার করেছে। কৃষিকে তারা প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। একেবারে শূন্য অবস্থা থেকে দেশটি এখন বিশে^র একাদশ শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। মাত্র সাড়ে তিন দশকে দেশটি জনগণকে জনসম্পদে পরিণত করেছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটিয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে। স্বজনপ্রীতিকে উচ্ছেদ করেছে। ফলে দেশের জনগণ সরকারকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে সহযোগিতা করেছে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, দেশটিতে সামান্য কৃষি ব্যতীত প্রাকৃতিক অন্য কোনো সম্পদই নেই। শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমেই তারা উন্নত বিশে^র কাতারে নাম লিখিয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়গুলোকে কোরিয়া কেবলমাত্র জ্ঞান চর্চার উন্নত কারখানায় পরিণত করেছে। বর্তমান বিশে^ শিক্ষাখাতে বিনিয়োগে সর্বোচ্চ স্থানটি দখল করে আছে ইসরাইল। শিক্ষা ও গবেষণাখাতে ইসরাইল মোট জিডিপির ৪.২৫ শতাংশ ব্যয় করে থাকে। ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়া ইসরাইলকে পেছনে ফেলে ৪.৫৫ শতাংশ বিনিয়োগ দিয়েছে। আয়তন ও জনসংখ্যা বিবেচনায় দেশটি আমেরিকা বা জাপানের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণায় দেশটি তাদের চেয়ে অনেকাংশে এগিয়ে।

বর্তমানের মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনামসহ অনেক উন্নত দেশের স্বাধীনতার বয়স বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়সের সমান। ঐসব দেশ ৫০ বছর আগেও উন্নয়নের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের কাতারেই ছিল। তারা জ্ঞান, বিজ্ঞান ও গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আজ আকাশচুম্বী সাফল্য লাভ করেছে। শিক্ষা উন্নয়ন ও উৎপাদনমুখী পরিকল্পনার কারণে তারা উন্নত দেশে রূপান্তরিত হয়েছে।

আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়ে আমাদের জীবনধারায় পরিবর্তন এনেছি। আমাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে অধিকতর গতিশীল করেছি। কিন্তু সার্বিকভাবে সফল হতে শিক্ষা ও বিজ্ঞান গবেষণায় আমরা মনোযোগ দিতে পারিনি। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ^ র‌্যাংকিংয়ে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু র‌্যাংকিংয়ে জায়গা নেই শুধু বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর। শ্রেষ্ঠ ৮০০ থেকে এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও নাম নেই বাংলাদেশের কোনো একটি স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের। অথচ, পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জনবহুল দেশ হলো বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের শিক্ষার মান কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। আমরা এখনও গবেষণায় বরাদ্দ দেয়াকে অপচয় মনে করি। এই মানসিকতায় আমাদের এখনো কোনো পরিবর্তন আসেনি। শিক্ষায় বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বরাদ্দের হার মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আজও কেবল পড়ানোর জন্য তৈরি করা হচ্ছে, গবেষণার কেন্দ্র মনে করা হচ্ছে না।

বাংলাদেশে শিক্ষার এ দৈন্যের একমাত্র কারণ হলো স্বার্থান্ধ রাজনীতি। দেশে স্বার্থান্ধ রাজনীতিবিদরাই শিক্ষার পরিচালক। রাজনীতিবিদরাই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন। বাংলাদেশে শিক্ষাবিদদের হাতে শিক্ষার দায়িত্ব নেই। দেশটি যদি গবেষণায় উন্নতি লাভ করে তাহলে এটি দ্রুত উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আর দেশটি উন্নত হয়ে গেলে সাধারণ জনগণ রাজনীতিবিদদের চতুরতা ধরে ফেলবে। ফলে রাজনীতিবিদদের অনৈতিক ধান্ধাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে। এসব কারণে দেশের পেটপুজারী রাজনীতিবিদগণ উন্নত জ্ঞান-গবেষণা চায় না। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পাঁচ দশক পার করেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এটি ছিল একটি বিধ্বস্ত দেশ। বিধ্বস্ত এ স্বাধীন দেশে ছিল ‘নাই নাই’ অবস্থা। কিন্তু সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশটি অনেক প্রাপ্তির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট দেশটি এরই মধ্যে নানা সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের কৃষি ও অর্থনীতিতে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। চোখে পড়ার মতো আবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নামও লিখিয়েছি। এই এগিয়ে যাবার পেছনে একক ব্যক্তি বা দলের কোনো অবদান নেই।
দেশের চালকগোষ্ঠি গতানুগতিকভাবে দেশটাকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশের কারণে দেশটি নানা দিক দিয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। পাকিস্তান আমলেও এ অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি। এদেশের কৃষকরা স্বল্প জমিকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছে। আর স্বল্প জমিতে উৎপাদন বাড়াতে জৈব প্রযুক্তিবিদরা এগিয়ে এসেছে। নতুন এ উদ্ভাবন উত্তরের চিরায়িত মঙ্গাকে দমন করতে সক্ষম হয়েছে। কৃষিবিদগণ দক্ষিণের লোনা পানিতে সোনালি ধানের মাঠ উপহার দিতে সফল হয়েছে। দেশের কোটি কোটি মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে তারা পরিশ্রম অব্যাহত রেখেছে। আর্থ-সামাজিক এতসব উন্নয়নের পরেও আমরা আমাদের মানবশক্তিকে যথাযথ ব্যবহার করতে পারিনি। আমাদের দেশের সম্ভাবনাময় মানবশক্তিকে মূল্যায়ন করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পঞ্চাশ বছর মোটেই কম সময় নয়, বরং দীর্ঘ অর্ধশতাব্দিকাল। এ অর্ধশতাব্দিকালে আমাদের যেকোনো প্রথম সারির অর্থনৈতিক দেশের তালিকায় নিজেদের নাম লেখাবার কথা ছিল। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারিনি। এর পেছনে বড় কারণ একটাই। আর তাহলো দেশের জনশক্তিকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করতে না পারা। যেকোনো সরকারের জন্য এটা এক চরম বাস্তবতা ও ব্যর্থতা।

এ ব্যর্থতার মূল কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্য। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা টেকসই কোনো স্থায়ী শিক্ষানীতি তৈরি করতে পারিনি। গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমাদের শিক্ষা কারিকুলামকে নানাভাবে টানা-হেঁচড়া করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা নানাভাবে ইচ্ছেমত এটাকে কাঁটাছেড়া করেছে। সময় গড়ালেও কোনো এক অজানা কারণে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা হয়নি। স্বাধীনতা পরবর্তী কোনো সরকারই এব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ভাবতে অবাক লাগে, একবিংশ শতাব্দিতেও আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নকলের মহোৎসব ছিল। আর এখনও পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো শতভাগ নকলমুক্ত হয়নি। আরো অবাক লাগার বিষয় হলো, শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের জন্য নকল সরবরাহ করতেন, এমনকি এখনও করেন! প্রতিবছর বিভিন্ন পরীক্ষার সময়ে প্রশ্নফাঁসের খবর প্রকাশিত হয়। আর প্রতিটি সরকার সেটা বন্ধের কাক্সিক্ষত পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। এভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নানা অকাজে ব্যস্ত সময় পার করে।

স্বাধীনতার এতটা বছর পার হলেও আমরা আজও একটি কাঠামোগত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারিনি! আজও আমরা মূল্যবোধের শিক্ষানীতি থেকে অবস্থান করছি যোজন যোজন দূরে। আমাদের বর্তমানের শিক্ষা ব্যবস্থায় নানান বৈষম্য রয়েছে। এ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানে রয়েছে বিস্তর ফারাক। ফলে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে আমরা বাস্তবিকই পিছিয়ে যাচ্ছি। আমরা আমাদের ৫ বছরের শিশুর কাঁধে বই পুস্তকের ভার তুলে দিয়েছি। এ ভার ঐ শিশুর ওজনের চেয়ে বেশি! আমরা জিপিএ নামক এক আজব জিনিস সৃষ্টি করেছি। ছেলে-মেয়েদের সামনে আমরা এটাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছি, যা পেলেই আমরা তাদেরকে মেধাবী মনে করে করছি! তাদের মেধা ও মনন কতটুকু বিকশিত হচ্ছে সেটা খেয়াল করছি না।

সনদের উচ্চশিক্ষায় আমরা এগিয়েছি সত্য কিন্তু প্রকৃত উচ্চ শিক্ষায় আমরা পিছিয়ে। আমরা এখনো গবেষণায় যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করছি। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণাগার মনে করা হতো। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মোট কাজের অর্ধেকই গবেষণার অংশ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিশ^বিদ্যালয়ের সার্বিক অবস্থা রীতিমত লজ্জাকর। সারা বিশে^র বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে গেলেও আমরা হাঁটছি উল্টো পথে। বাংলাদেশের বয়স বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু গবেষণার মান ও গতি দুই-ই কমেছে। বর্তমানে দেশে ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। কিন্তু একটিতেও গবেষণার কোনো পরিবশে তৈরি হয়নি। ক্লাসের বাইরে আমাদের শিক্ষকদের জ্ঞান সৃষ্টির নেশায় মত্ত থাকার কথা ছিল। কিন্তু তারা এখন নানান বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। তদুপরি তারা অধিকতর রাজনৈতিক নেতা বনে গিয়েছেন। তাদের গবেষণার নেশার জায়গায় স্থান পেয়েছে অর্থ, স্বার্থ আর রাজনৈতিক পদলেহন।
বিরাজমান এহেন পরিবেশে গবেষণাপ্রিয় অনেক শিক্ষার্থী দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছে। পড়াশোনার সুযোগ নিয়ে প্রতি বছর বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে অগনিত শিক্ষার্থী। বিদেশে গিয়ে তারা সুনামের সাথে গবেষণাকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এদের একটি বড় অংশই আর দেশে ফিরছে না। নিরাপত্তা আর চাকরির অনিশ্চয়তার কারণে তারা দেশের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। তাদের কাজে লাগিয়ে আজ অন্য দেশ বিজ্ঞান গবেষণায় এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের যোগ্যতা ও পরিশ্রমের কঠোরতা থাকা সত্ত্বেও আমরা তাদের কাজে লাগাতে পারছি না।

গবেষণা না থাকায় আমাদের বিশ^বিদ্যালয়গুলো ছেলে-মেয়েদের অনৈতিক প্রেমের কারখানায় পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া ইডেন কলেজের ঘটনা তারই বাস্তব প্রমাণ বহন করে। একই কারণে গবেষণাকেন্দ্রগুলো নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে। ফলে যারা একটু আধটু গবেষণা করতে আগ্রহী তারা তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। আমরা কেবলই কাগজে কলমে গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে রেখেছি। আমাদের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে। জীবন মানের পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণায় পিছিয়ে থাকায় তার কাক্সিক্ষত ফল আমরা পাচ্ছি না।

আমাদের দেশের মেধাবীদের দক্ষ কর্মীতে পরিণত করা দরকার। দেশের বাইরে থাকা উদ্ভাবকদের ঘরে ফিরিয়ে আনা দরকার। শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষাবিদদের হাতে ন্যস্ত হওয়া দরকার। মনে রাখা দরকার, যোগ্য ব্যক্তিদের সম্মান না করলে নিশ্চিত আমাদের ভুগতে হবে। আমরা মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান চাই। আমরা শিক্ষাখাতে কাক্সিক্ষত বাজেট চাই। যুগোপযোগী ও কর্মমুখী শিক্ষা চাই। জীবনমুখী এমন শিক্ষা চাই, যা আমাদের কেবল সনদই দেবে না; বরং মানবিক ও দক্ষ মানবসম্পদ উপহার দেবে।

লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]



 

Show all comments
  • Oliullah ৫ নভেম্বর, ২০২২, ৭:১৩ পিএম says : 0
    অসাধারণ লিখনী, ধন্যবাদ স্যার
    Total Reply(0) Reply
  • Oliullah ৫ নভেম্বর, ২০২২, ৭:১৩ পিএম says : 0
    অসাধারণ লিখনী, ধন্যবাদ স্যার
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন