Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পারিবারিক ও সামাজিক সঙ্কটের বৃত্তে প্রবাসীদের জীবন

মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত | প্রকাশের সময় : ৫ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

নিজের দেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে বসবাস করাই হলো প্রবাস। বাংলাদেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী প্রবাসে বাস করে। স্বাধীনতা পরবর্তী পাঁচ দশকে বাংলাদেশের বড় অর্জনগুলোর তালিকায় প্রবাসী আয় অন্যতম। এক কোটির বেশি বাংলাদেশি ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, যারা প্রতিনিয়ত দেশের টেকসই উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জনকারী এসব প্রবাসীর অধিকাংশের পরিবার-পরিজন কিন্তু দেশে থাকে। ইউরোপ-আমেরিকা বাদ দিলে অন্যান্য দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশি প্রবাসীদের খুব কম সংখ্যক পরিবার তাদের সাথে প্রবাসে থাকে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ফলে প্রবাসীরা এখন নিয়মিত দেশে অবস্থানরত পরিবার-পরিজনের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। ইচ্ছে হলেই আপনজনদের দেখা বা কথা বলা কোনো ব্যাপার না। তবে তা কেবল ভার্চুয়াল। এই যোগাযোগ আপাত দূরত্ব কমালেও মানসিক দূরত্ব ঠিকই থেকে যায় প্রবাসীদের সাথে দেশে অবস্থানরত পরিবার পরিজনের। অধিকাংশ প্রবাসী নিয়মিত দেশে আসতে পারে না, নানাবিধ জটিলতা কিংবা আর্থিক অসঙ্গতির কারণে। খুব কম প্রবাসী আছে যারা প্রতিবছর দেশে আসে বা আসতে পারে। এমনও প্রবাসী আছে, যারা অর্ধযুগ পরও দেশে আসতে পারে না প্রবাসের প্রতিকূলতা পেরিয়ে। অনেকেই আবার নিয়মিত যোগাযোগও সবসময় করতে পারে না।

যোগাযোগের এই ঘাটতি, নিজ পরিবার থেকে দীর্ঘদিনের বিচ্যুতি, মানসিক ও আবেগিক ভাব আদান-প্রদানের ব্যর্থতা, পরিবার-পরিজন কিংবা আত্মীয়-স্বজনের কোনো কাজে শারীরিক অনুপস্থিতি এবং আপনজনদের প্রতি নিজ দায়িত্ব-কর্তব্য যথাসময়ে সঠিকভাবে পালন করতে না পারার কারণে প্রবাসীদের সাথে দেশের পরিজনদের সৃষ্টি হয় মানসিক দূরত্ব এবং ভুল বুঝাবুঝির দেয়াল, যা অনেক ক্ষেত্রে তীব্র প্রভাব পড়ে প্রবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে। জীবনে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনয়ন, পরিবার-পরিজন তথা সন্তান-সন্তুতির উন্নত জীবন ধারণের ব্যবস্থা করতে গিয়ে প্রবাসে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দিচ্ছে কোটি প্রবাসী। তাদের স্বপ্ন থাকে নিজেদের উপার্জিত অর্থের বিনিময়ে দেশে অবস্থানরত আপনজনরা ভালো থাকুক। সন্তানরা পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হোক, বৃদ্ধ মা-বাবা শেষ বয়সে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে দিনাতিপাত করুক। কিন্তু এসব যোগান দিতে গিয়ে নিজের অজান্তেই হারিয়ে ফেলে ব্যক্তিজীবনের সকল প্রশান্তি। অনেক সময় জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। যাদের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছে, তারা কোন কারণে ভুল বুঝে বসে থাকে অথবা নিজে ঠিকমতো অর্থের যোগান দিতে না পারায় পরিবার-পরিজন নারাজ হয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এবং খারাপ আচরণ করে প্রবাসীদের সাথে। প্রবাসী মানেই মনে করা হয়, টাকার গাছ! মাস শেষে মোটা অংকের টাকা পাঠানোই যেন তাদের কাজ। কোনো কারণে টাকা পাঠাতে না পারলেই শুরু হয় বিপত্তি। বেঁকে বসে সব আপনজন। আবার এর উল্টো পিঠে দেখা যায়, আর্থিক স্বচ্ছলতার সুযোগে নিজের পরিবার উচ্ছন্নে যায়। আপনজনদের সাথে প্রবাসীর ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে সন্তানদের বা অনুজদের আদর-সোহাগ দেয়া বা শাসন করা কোনটাই হয়ে ওঠে না। ছেলে সন্তান, মা-বাবা বা আপনজনদের সাথে বসবাস করলে পারস্পরিক যে সহমর্মিতা, সহনশীলতা, আন্তরিকতা, শ্রদ্ধাবোধ এবং পারিবারিক শিক্ষা গড়ে ওঠে দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার ফলে সন্তান বা নিজ পরিবার এসব থেকে বঞ্চিত হয় এবং সম্পর্কটা হয়ে উঠে অনেকটা আনুষ্ঠানিক বা সৌজন্যের। প্রবাসীদের স্ত্রী কিংবা সন্তানরা সহজে প্রবাসী স্বামী কিংবা বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে চায় না। তাদের কাছে মনে হয়, এটি জোরারোপ করে চাপিয়ে দেয়ার মতো। বাবার কর্তৃত্ব সন্তানরা যেমন সহজে মানতে চায় না, তেমনি করে নিজ স্ত্রী বা পরিবারের অন্য সদস্যরাও সহজে মেনে নিতে চায় না। বিশেষ করে, সন্তানদের কাছে বাবা হয়ে উঠে অনেকটা বহিরাগত পরিচিতজনের মতো। এই যে মানসিক দূরত্ব কিংবা টানাপোড়েন এটি কিন্তু প্রবাসী ব্যতীত অন্যদের চোখে তেমন ধরা পড়ে না বা অন্যদের কাছে বিষয়টি সেভাবে মানে রাখে না। অধিকাংশ প্রবাসীর সন্তানেরা হয়ে পড়ে ‘মা’ নির্ভর। বাবাকে তারা দুই বছর তিন বছর পর কয়েক মাসের জন্য পায় মাত্র। বাকি সময়ের সকল কিছু যোগান দেয় তাদের মা। শিশুরা খুব ছোটকাল থেকেই যে কোনো সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ, স্পর্শ ইত্যাদিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাই শিশুদের কাছাকাছি বা সংস্পর্শে যারা থাকে তাদের প্রতি নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়। তাই মায়ের সাথেই তাদের সব সম্পর্ক বা আবেগ অনুভূতি। অপরদিকে প্রবাসীদের স্ত্রীরাও সন্তানের লালন-পালন, পরিবারের অন্যান্য আনুষাঙ্গিক কাজকর্ম, আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্ক রক্ষা করা বিপদ-আপদে উপস্থিত হওয়াসহ নানান কাজে প্রচন্ড মানসিক চাপে ভোগে। মানসিক এই চাপের কারণে অনেক সময় ঝগড়া বা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয় স্বামী বা শশুর-শাশুড়ি বা দেবর-ভাসুরের সাথে। এই ভুল বুঝাবুঝি এক সময় বড় আকার ধারণ করে, সংসারের অশান্তি সৃষ্টি করে। স্ত্রী তার প্রবাসী স্বামীকে বলে এককথা আর মা-বাবা বা ভাইবোন বলে অন্য কথা। অন্যদিকে প্রবাসী বেচারা প্রবাসজীবনের নানান প্রতিকূলতার মাঝে পারিবারিক এই দ্বন্দ্বের কারণে ঠিক মতো কাজে মনযোগ দিতে পারে না, ঘুমাতেও পারে না ঠিক মতো। স্ত্রীকে কিছু বলতে পারে না আর মা-বাবাকেও কিছু বললে সমস্যা। শ্যাম রাখে না কূল রাখে এই অবস্থার মধ্যে প্রবাসীদের বিষণ্ন সময় কাটে। সমস্যা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। প্রবাসীদের সন্তানদের পড়ালেখা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রাদি খরিদ, বিনোদনের ব্যবস্থা, রোগে-শোকে দেখভাল করার মতো কেউ থাকে না। যৌথ পরিবারে বসবাস করলেও বাড়ির অন্যান্য সদস্য প্রবাসীদের পরিবারের প্রতি শতভাগ মনযোগ দেয় না বা দেয়াটা সবসময় হয়ে ওঠে না। এটার বহুবিধ যৌক্তিক কারণও রয়েছে অবশ্যই। তাছাড়া নারীদের এমন কিছু প্রয়োজনীয়তা বা সমস্যা থাকে, যা স্বামী ব্যতীত কারো সাথে শেয়ার করা সম্ভব না। সব মিলিয়ে প্রবাসীদের স্ত্রীরা অনেক সময় তার পাশে কাউকে খুঁজে নেয় যে কীনা তার কাজ-কর্মে সাহায্য করবে। হতে পারে সে কোনো নিকটআত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী বা অন্য কেউ। তখন ঐ ব্যক্তির সাথে বিভিন্ন কাজেকর্মে কথা হয়, দেখা হয় বা সাথে বাইরেও যেতে হয় অনেক সময় এবং এটি করতে গিয়ে এক সময় সম্পর্কে আস্থা ও গভীরতা চলে আসে এবং ভুলে যায় তাদের পারিবারিক ও নৈতিক অবস্থানের কথা। মোবাইলে চলে অভিসার। স্বামীর অনুপস্থিতি, দীর্ঘদিনের ভালোবাসা বঞ্চিত মনে নতুন করে সৃষ্টি হয় প্রেমাসক্তি। একদিকে স্বামীর কাছ থেকে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে অন্যদিকে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, যার ফলে একসময় পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার এবং প্রায় ক্ষেত্রে ভেঙ্গে যায় সাজানো সংসার, ধুলোয় মিশে যায় একজন প্রবাসীর তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসার এবং নষ্ট হয় তার আগামী প্রজন্ম। যে প্রবাসীর জীবনে এমন ছন্দপতন ঘটে তার জীবনে আর ছন্দ ফিরে আসে না। সামাজিকভাবে হতে হয় হেয় প্রতিপন্ন, আত্মীয়স্বজনসহ সকলের কাছে নিজের ভার্বমর্যাদা নষ্ট হয় এবং সন্তানদের জীবনেও নেমে আসে অনিশ্চয়তার প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। তা ছাড়াও আরো ভিন্ন চিত্রও রয়েছে প্রবাসীদের জীবনে। একজন প্রবাসী তার কষ্টার্জিত অর্থ দেশে বাবা, ভাই কিংবা স্ত্রীর নামে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে যে, তাদের অর্থ আপনজনরা কখনো অপচয় করবে না বা নষ্ট করবে না। অনেক সময় দেখা যায়, তার টাকা দিয়ে জায়গা জমি কিনেছে। অথচ, তার নাম নেই অথবা তার একার নামে না কিনে পরিবারের সকল সদস্যের নামে কিনেছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, তার সব অর্থ মা-বাবা, ভাই-বোন অথবা স্ত্রী আয়েশি জীবনের পিছনে খরচ করে ফেলেছে। অথবা দেখা গেছে, প্রবাসী ভাইটি নিজের সকল আয় রোজগার মা-বাবা, ভাই-বোনকে বাদ দিয়ে নিজ স্ত্রীর কাছে জমা রেখেছে পরম বিশ্বাসে, আর তার স্ত্রী প্রবাসী স্বামীর সরলতার সুযোগে একাউন্টে থাকা সকল টাকা পয়সা নিয়ে অন্যের হাত ধরে চলে গেছে আপাত সুখের স্বপ্নরাজ্যে! প্রবাসে অবস্থানরত মানুষটি যখন এসব জানতে পারে, তখন তার আর কী-ই বা করার থাকে! নিঃস্ব হয়ে মুষড়ে পড়ে, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসে, সামনে এগিয়ে যাবার সামর্থ হারিয়ে ফেলে। এ নিয়ে কাউকে কিছু বললে বেড়ে যায় বিড়ম্বনা, তীব্র হয় সম্পর্কের অবনতি। অনেক সময় অনেক প্রবাসীর অকাল মৃত্যু ডেকে আনে এসব পরিস্থিতি।

প্রবাসে থাকা মানুষটির বিন্দু বিন্দু ঘামে হাসি ফুটায় দেশে থাকা চার-পাঁচ কোটি মানুষের মুখে। এই প্রবাসীদের আজ ও আগামীর জন্য আমাদের সুদূরপ্রসারী ভাবনা কী? একজন মানুষ দেশের সীমানা পাড়ি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যায় বিদেশি, গায়ে লেগে যায় ‘প্রবাসী’ তকমা। স্বদেশি-প্রবাসী ভাগাভাগি করতে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে যায় বিভাজনের এক দেয়াল। তার দেশপ্রেমেও সন্দেহ খুঁজে পায় দেশের মানুষ। ঠিক তেমনি করে আপনজনও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সন্দেহ করে। টাকা পয়সা নাই বললেও কখনো বিশ্বাস করে না। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে প্রবাসে এক একটি দিন পার করে প্রবাসীরা আর ভাবে আর কতদূর এই পথ পরিক্রমা। প্রবাস শুধু প্রবাস নয়, এর আরেক নাম ‘নির্বাসন’। প্রবাসে আর যা-ই থাকুক মানসিক প্রশান্তি নেই, আছে কেবল দুঃখ, বেদনা আর দীর্ঘশ্বাস!

লেখক: প্রাবন্ধিক, সৌদি আরব
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন