Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিল্প হতে হবে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব

তামান্না তাবাসুম কবীর | প্রকাশের সময় : ৪ নভেম্বর, ২০২২, ১:২২ এএম

টেকসই শিল্প বলতে, টেকসই উপায়ে শিল্প প্রক্রিয়াগুলির বিকাশ বুঝায়। এটি সাধারণত টেক্সটাইল, ই¯পাত, সিমেন্ট, কাগজসহ অন্যান্য শিল্প, যেগুলো উৎপাদনে অধিক শক্তি ব্যবহার করে থাকে তাদের শিল্পের সবুজায়নকে বোঝায়। টেকসই শিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে: ১) বর্জ্য পানির পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনা, ২) বায়ুদূষণ চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণ, ৩) বিপজ্জনক কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ৪) পুনর্ব্যবহার, ৫) শিল্পের বর্জ্য পানির পরিকল্পিত শোধনাগার, ৬) নিরাপদ রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা, ৭) পরিবেশবান্ধব এবং নবায়নযোগ্য কাঁচামাল ব্যবহার, ৮) বর্জ্য প্রতিরোধ করতে রাসায়নিক সংশ্লেষণ ডিজাইন, ৯) নিরাপদ রাসায়নিক পণ্য ডিজাইন, ১০) ব্যবহারের পরে অবনমিত করার জন্য নিরাপদ রাসায়নিক পণ্য ডিজাইন। অর্থাৎ কাঁচামাল দেওয়া, পণ্য তৈরি করা, পণ্য ডিজাইন করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবেশগত সুরক্ষা অনুশীলন করাই টেকসই শিল্পের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্বাভাবিকভাবেই শিল্পায়নের প্রসার সমৃদ্ধ হবে এবং উন্নয়নের ধারা ক্রমশ বাড়তে থাকবে। আর এই ধারা মানবসভ্যতার অনুক‚লে রাখার জন্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। তাই, টেকসই শিল্প এমন একটি ধারণা, যা বিশ্বকে সবুজ উন্নয়ন উপভোগের সুযোগ করে দেবে।

মানুষের স্বাস্থ্য: ১) বাতাসে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের কম নিঃসরণ ফুসফুসের ক্ষতি কমাবে, ২) পানিতে বিপজ্জনক রাসায়নিক বর্জ্য কম নির্গমন, যা পরিষ্কার পানির সহজলভ্যতা বাড়াবে, ৩) বিষাক্ত পদার্থের কম ব্যবহার, যাতে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম কম প্রয়োজন হবে এবং দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমাবে (যেমন, আগুন বা বিস্ফোরণ) ৪) ক্রমাগত বিষাক্ত রাসায়নিক নির্ম‚লে নিরাপদ খাদ্য শৃঙ্খল তৈরি হবে। পরিবেশ: ১) অনেক রাসায়নিক (যেমন, কীটনাশক), ব্যবহার করার সময়, উৎপাদনের সময় নির্গমনসহ বা নি®পত্তির মাধ্যমে পরিবেশে চলে আসে এবং ক্ষতি করে। কিন্তু সবুজ রাসায়নিকগুলি হয়তো পচনশীল হয় বা আরও ব্যবহারের জন্য পুনরুদ্ধার করা যায়, যা পরিবেশ রক্ষায় সহযোগী, ২) নিরাপদ রাসায়নিক ব্যবহার করায় গাছপালা এবং প্রাণীর ক্ষতির সম্ভাবনা কম, ৩) বৈশ্বিক উষ্ণতা, ওজোনস্তর ক্ষয় এবং ধোঁয়াশা তৈরির সম্ভাবনা কম, ৪) বাস্তুতন্ত্রে কম রাসায়নিক ব্যাঘাত, ৫) ল্যান্ডফিলের কম ব্যবহার; বিশেষ করে বিপজ্জনক বর্জ্য ল্যান্ডফিল। ৫) নিরাপদ রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা অনুশীলন শিল্প ব্যবসাগুলির পরিবেশগত নির্গমনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের প্রভাবগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে। এই ব্যবস্থাপনা ক্ষতিকর কাঁচামালের উপর নির্ভর করা এড়িয়ে যায় যেগুলি একবার পানি বা বাতাসে ছেড়ে দিলে বিষাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেমন: ক্রোমিয়াম, পারদ এবং সীসা ধারণকারী বিপজ্জনক উপাদানগুলি বাদ দিয়ে এগুলোর পরিবেশবান্ধব বিকল্পগুলোর সাথে প্রতিস্থাপন। অতএব, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পর্যন্ত সবুজ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে বর্তমান সময়ে টেকসই শিল্প অতীব জরুরি বিষয়।

দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে শিল্প খাতের ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করতে হলে শিল্পোন্নয়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু সেই শিল্পকে হতে হবে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব। শিল্পের জন্য কোনো কৃষিজমি বিনষ্ট করা যাবে না। বনভ‚মি ধ্বংস করা যাবে না। জীববৈচিত্র্য নষ্ট করা যাবে না। মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দদূষণের মাধ্যমে উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের জীবনকে বিপন্ন করে তোলা যাবে না। শিল্পে ব্যবহৃত জ্বালানি হবে নবায়নযোগ্য আর উৎপাদিত পণ্যও হবে পরিবেশবান্ধব। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিল্প পরিবেশবান্ধব নয়। শিল্প কারখানার তরল বর্জ্য নদী-নালা, খাল-বিলে নিক্ষেপ করা হয়। নেই কোনো পরিকল্পিত পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনা। শিল্প বর্জ্য দ্বারা আমাদের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর পানি শিল্প দ্বারা দূষিত হচ্ছে। শিল্পের বর্জ্যে সালফিউরিক অ্যাসিড, ক্রোমিয়াম, অ্যামোনিয়াস সালফেট, ক্লোরাইড ও ক্যালসিয়াম অক্সাইড থাকে। এগুলো চুয়ানো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভ‚গর্ভের পানিতে মিশে মাটির ওপরের ও নিচের উভয় পানির উৎসকে দূষিত করে। অন্তত ২৯টি শিল্প-কারখানা টঙ্গী অঞ্চলের তুরাগ নদ এবং ৪২টি বৃহৎ শিল্প শীতলক্ষ্যা নদীতে বর্জ্য নিক্ষেপ করে। শিল্পগুলো পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় এর ফলে প্রতিনিয়ত পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। পানিদূষণ: শিল্প দূষণের প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং বহু বছর ধরে বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করার জন্য দায়ী। বেশিরভাগ শিল্পে কাজের জন্য প্রচুর পরিমাণে পানির প্রয়োজন হয়। ফলে পানির সাথে ভারী ধাতু, ক্ষতিকারক রাসায়নিক এবং এমনকি তেজষ্ক্রিয় বর্জ্যও সং¯পর্শে আসে। এগুলো প্রায় সময় সাগরে বা নদীতে ফেলা হয় আর এসবের ফলস্বরূপ, আমাদের পানির উৎসগুলিতে উচ্চ পরিমাণে শিল্প বর্জ্য রয়েছে, যা আমাদের বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। একই পানি কৃষকদের দ্বারা সেচের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, যা উৎপাদিত খাদ্যের গুণমানকে প্রভাবিত করে। পানিদূষণ ইতোমধ্যে অনেক ভ‚গর্ভস্থ পানি স¤পদকে মানুষ এবং বন্যপ্রাণীর জন্য অকেজো করে দিয়েছে। মাটিদূষণ: শিল্প বর্জ্য যখন মাটির সং¯পর্শে আসে তখন মাটির পুষ্টিগুণ ও উর্বরতা নষ্ট করে দেয়। এর ফলে মাটিদূষণ কৃষিতে সমস্যা সৃষ্টি করছে এবং স্থানীয় গাছপালা ধ্বংস করছে। এটি আরও দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যাও সৃষ্টি করছে তাদের জন্য যারা প্রতিদিন এই ধরনের মাটির সং¯পর্শে আসছে। বায়ুদূষণ: বায়ু দূষণের ফলে বিভিন্ন অসুস্থতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শিল্পায়নের প্রসারের সাথে সাথে এটি মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। বন্যপ্রাণী বিলুপ্তি: শিল্পদূষণের বিষয়টি হতে দেখা যাচ্ছে যে, এটি প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করছে, যার অর্থ বন্যপ্রাণীগুলি মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। আবাসস্থল হারিয়ে যাচ্ছে, প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিবেশের পুনরুদ্ধার করা কঠিন হয়ে উঠছে। অগ্নিকান্ড, তেজষ্ক্রিয় পদার্থের বিস্ফোরণের মতো বড় শিল্প দুর্ঘটনাগুলি থেকে দ্রæত পরিত্রাণ পাওয়াও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণ, সেগুলি স্বল্প সময়ের মধ্যে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। বৈশ্বিক উষ্ণতা: শিল্প দূষণ বৃদ্ধির সাথে সাথে বৈশ্বিক উষ্ণতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিল্পের মাধ্যমে ধোঁয়া এবং গ্রিনহাউস গ্যাস বাতাসে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে। হিমবাহের গলে যাওয়া; মেরু ভালুকের বিলুপ্তি; বন্যা; সুনামি এবং হারিকেন ইত্যাদি বৈশ্বিক উষ্ণতার কিছু প্রভাব। বাংলাদেশের শিল্পগুলো পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় তাই এক্ষেত্রে টেকসই শিল্প বিনির্মাণে অতিশীঘ্র উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

বর্জ্য পানির পরিকল্পিত শোধনাগার স্থাপন, বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণ, নবায়নযোগ্য কাঁচামাল ব্যবহার, পুনর্ব্যবহার ইত্যাদিসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে টেকসই শিল্প বিনির্মাণ সম্ভব। এক্ষেত্রে অবশ্যই এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কেননা, এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে পরিবেশের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশল নীতির প্রয়োগ, যার ফলে মানব স্বাস্থ্য রক্ষিত হয়, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষিত হয় এবং মানব জীবনের মানোন্নয়ন স¤পর্কিত পরিবেশজনিত বিষয়ের উৎকর্ষ সাধন ঘটে।

লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন