Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মূল্যস্ফীতির আসল তথ্য জানতে চেয়েছে আইএমএফ

বিবিএস’র সঙ্গে বৈঠক তিন মাস পরপর জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য প্রকাশের পরামর্শ বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠক আজ রফতানিতে নগদ সহায়তা কমানোর পরামর্শ দিতে পারে আইএমএফ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

গত আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে পেট্রল, অকটেন, ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম সাড়ে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর আগে কখনোই জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে এতটা বাড়ানো হয়নি। তাই আগস্ট মাসের শুরু থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। এ ছাড়া যাতায়াত, পোশাক, শিক্ষাসামগ্রীর মতো খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামও বেড়েছে। তখন থেকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করছেন দেশের অর্থনীতিবিদেরা। কিন্তু প্রতি মাসে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করার কথা থাকলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তা করেনি। শেষ পর্যন্ত একসঙ্গে দুই মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এবার মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশের বিলম্বের কারণ ও আসল তথ্য জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। একই সঙ্গে সঠিক সময়ে যেন এ তথ্য প্রকাশ করা হয় সে বিষয়েও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তিন মাস পরপর জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য দেওয়ার কাজের বর্তমান অবস্থা ও অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশে আইএমএফ মিশন প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বিবিএস মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. মতিয়ার রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে এসব প্রস্তাব তুলে ধরেছে আইএমএফ।

বিবিএসের হিসাবে, গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ হয়েছে। আগস্ট মাসে গত ১১ বছর ৩ মাসের (১৩৫ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। ২০১১ সালের মে মাসের পর মূল্যস্ফীতি আর কখনোই ৯ শতাংশের বেশি হয়নি। মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, মজুরি সেই হারে বাড়েনি। বিবিএসের হিসাবে, গত আগস্ট মাসে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। আর সেপ্টেম্বর মাসে তা হয় ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। অর্থাৎ জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে, মজুরি সেই হারে বৃদ্ধি না পাওয়ায় ভোক্তার প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বিবিএস মহাপরিচালকের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের বৈঠকের একটি সূত্র জানিয়েছে, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ভিত্তি বছর পরিবর্তন করতে চার বছর ধরে চেষ্টা করে না পারলেও তিন মাস পরপর জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য দিতে চায় বিবিএস। তবে আইএমএফের নির্দেশিকা মানতে গিয়ে ত্রৈমাসিক তথ্য দেওয়ার কাজ শুরু করেছে সরকারি সংস্থাটি। বিবিএস কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি পরিমাপ করা হয় ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরে। এটি পরিবর্তন করে ২০১৫-১৬ অর্থবছর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০১৭ সালে। কিন্তু গত পাঁচ বছরেও ভিত্তি বছর পরিবর্তন করতে পারেনি সংস্থাটি। কয়েক বছরেও জিডিপির ভিত্তি বছর পরিবর্তন করতে না পারলেও এখন ত্রৈমাসিক তথ্য দিতে চায় বিবিএস। বর্তমানে বিবিএস বছরে দুবার জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য দেয়। বছর শেষে একটা সাময়িক এবং পরবর্তী সময়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়। তবে এ পদ্ধতি বাতিল করে প্রবৃদ্ধির তথ্য বছরে তিনবার প্রকাশ করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। যেন দেশের আর্থিক স্বাস্থ্যের অগ্রগতি সব সময় জানা যায়।

আইএমএফের সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে বিবিএস ডিজি বলেন, এটা তেমন কোনো বৈঠক নয়, রুটিন বৈঠক বলা যায়। আইএমএফ কোয়ার্টারলি জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চেয়েছে। আমরাও এ বিষয়ে কাজ করছি। তবে এটা বললেই হবে না। কারণ জানতে চাইলেই হবে না। আমরা যাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে প্রবৃদ্ধি তথ্য প্রকাশ করবো তাদেরও সে প্রস্তুতি থাকা লাগবে। সবাইকে এ বিষয়ে আমরা প্রস্তুত করছি। তিনি বলেন, আইএমএফ প্রতিনিধিদল আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। আমরাও সভা-সেমিনার করছি, কীভাবে এটা করা যায়। কবে থেকে কোয়ার্টারলি তথ্য প্রকাশ করতে পারবো তা এখন বলা যাবে না। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় সবাই এটা করছে, আমাদেরও করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ে আইএমএফ কোনো সুপারিশ বা পরামর্শ দিয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মতিয়ার রহমান বলেন, তারা কোনো সুপারিশ বা পরামর্শ দেননি। তবে আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশে বিলম্বের কারণ জানতে চেয়েছে। আমরা এ বিষয়ে তাদের বলেছি। তথ্য প্রকাশ করতে উপরের পর্যায় থেকে অনুমতি লাগে, এটা পেতে আমাদের দেরি হয়েছে। এ কারণেই মূলত মূল্যস্ফীতির তথ্য দিতে দেরি হয়েছে। এর বাইরে অন্য কোনো কারণ নেই।

বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠক আজ : এবার রফতানিতে নগদ সহায়তা কমানোর পরামর্শ দিতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ। এর পাশাপাশি সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবির খাদ্য সহায়তায় ভর্তুকি কমানো যায় কিনা সে বিষয়টি ভেবে দেখার পরামর্শ দেয়া হতে পারে। এছাড়া স্বল্পোন্নত বা এলডিসি উত্তরণ, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ), অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নতকরণ এবং বিনিয়োগে ওয়ানস্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দিবে সংস্থাটি। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছিল আইএমএফ। আজ বুধবার সকালে সচিবালয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সঙ্গে বৈঠক করবে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। এই বৈঠক শেষে বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করা হতে পারে।

জানা গেছে, সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চায়। তবে এক্ষেত্রে সংস্থাটির বেশকিছু শর্ত বা সুপারিশ মানতে হবে বাংলাদেশকে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিভিন্নখাতে সরকারের দেয়া ভর্তুকি কমানো। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে আইএমএফের পরামর্শ মেনে। এবার রফতানিতে নগদ সহায়তার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে। বাংলাদেশের প্রায় ৪০-৪৪টি পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের নগদ সহায়তা ১০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত দেয়া হয়ে থাকে। মূলত রফতানিখাত প্রসার ও রফতানি বাড়াতে সরকার এ ধরনের প্রণোদনা দিয়ে থাকে।

এতে করে দেশে কয়েক বছরে বেশকিছু রফতানিখাতের সৃষ্টি ও প্রসার বেড়েছে। একইভাবে খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার ও দেশের কোটি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা হিসেবে টিসিবি ফ্যামিলি কার্য প্রবর্তন করেছে। এখন চিনির দাম বাড়ায় খোলা ট্রাকে বাজার মূল্যের তিনভাগের একভাগ মূল্যে চিনি বিক্রি করছে টিসিবি। এতে করে সাধারণ মানুষ কিছুটা হলে স্বস্তি পাচ্ছে। কিন্তু আইএমএফ মনে করে এখাতে সরকার প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। একইভাবে দেশি-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে ব্যবসার পরিবেশ উন্নতি সূচকে আরও কয়েক ধাপ এগোতে হবে বাংলাদেশকে। এ ব্যাপারে ওয়ানস্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি বা স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হবে।

ওই সময়ের পর রফতানিতে কোটা ও শুল্কমুক্ত সুবিধা ছাড়া বাংলাদেশ কিভাবে বাজার ধরে রাখতে সক্ষম হবে সে বিষয়ে জানতে চায় আইএমএফ। সংস্থাটি মনে করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মের মধ্যেই যাতে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। এজন্য এফটিএ ও পিটিএ করার ব্যাপারে বেশ সর্তক অবস্থান গ্রহণ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাইয়ের ওপর আরও গভীর পর্যবেক্ষণের তাগিদ দেয়া হতে পারে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়া নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ। সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশাস্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতর-অধিদফতরের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করছে। আইএমএফের কাছে ৪৫০ কাটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। ডিসেম্বরের মধ্যে ১৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী সরকার, তবে ঋণ পেতে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। তাদের কর্মসূচির আওতায় ৬৮০ কোটি ডলার পর্যন্ত ঋণ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। সম্ভাব্য ৯টি কিস্তিতে তারা তিন বছর ধরে ঋণ দিতে পারে। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ হতে পারে ২০ বছরের মতো এবং এর মধ্যে বেশ কয়েক বছর গ্রেস পিরিয়ড থাকবে। সিরিজ বৈঠকে এসব শর্ত নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে দর-কষাকষি করবে বাংলাদেশ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আইএমএফ

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ