Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অবেশেষে ‘কর অব্যাহতি’ নিয়ে সমীক্ষা করবে এনবিআর

আইএমএফের পরামর্শ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

কর অব্যাহতি সুবিধা দেয়ার ফলে বছরে কী পরিমাণ রাজস্বের ক্ষতি হচ্ছে তার সঠিক তথ্য নেই। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ব্যাপকভিত্তিক কোনো গবেষণাও হয়নি। দীর্ঘ সময় পর সমীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআর। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শেই এই উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী আইএমএফ আগে থেকেই বলে আসছে, বাংলাদেশে কর অব্যাহতি বেশি। এ সুবিধা কমিয়ে আনতে সরকারকে বারবার তাগাদা দিয়ে আসছে ওয়াশিংটনভিত্তিক ঋণদাতা সংস্থাটি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে কর অব্যাহতি কমানো। নভেম্বর মাসে আইএমএফ মিশন বাংলাদেশ সফরে আসার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে বৈঠকে বিভিন্ন খাতে দেয়া কর অব্যাহতি সুবিধা কমাতে বলেছে। সরকার এখন সে পথেই হাঁটছে।
সূত্র জানায়, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে কর অব্যাহতির বিষয়ে জনগণকে একটি ধারণা দেয়া হবে সংসদে উপস্থাপিত বাজেটের মাধ্যমে। এতে এই সুবিধা দেয়ার কারণে বছরে কী পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে, কোন কোন খাতে সুবিধা দেয়া হয়েছে এবং সুবিধা দেয়ায় দেশের আর্থ-সামাজিক সুফল কতটুকু পাওয়া গেছেÑএসব বিষয় তুলে ধরা হবে। তার আগে কর অব্যাহতির বিষয়ে ব্যাপকভিত্তিক সমীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর।
আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও আমদানি শুল্কÑ এই তিন খাতে সুবিধা দেয়ার কারণে যে পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে, তা তুলে ধরা হবে সমীক্ষায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের নীতিনির্ধারকপর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, কর অব্যাহতি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক একটি সমীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোন পদ্ধতিতে করা হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সমীক্ষাটি এনবিআরের কর্মকর্তারাই করবেন। এ ক্ষেত্রে বিদেশি পরামর্শকের সহায়তা নেয়া হবে। নতুন বছরের জানুয়ারিতে কাজ শুরু হবে। প্রতিবেদন সম্পন্ন করতে পাঁচ থেকে ছয় মাস সময় লাগবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত এখন ৮ শতাংশ। যদি আয়কর বা প্রত্যক্ষ কর ধরা হয়, তাহলে আরও কম। মাত্র আড়াই শতাংশ। প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে এই অনুপাত ১৫ শতাংশের ওপরে। বর্তমানে বাংলাদেশে চলতি মূল্যে জিডিপির আকার প্রায় ৪০ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে কৃষি, রফতানি, শিল্প, সামরিক, রেমিট্যান্সসহ বিভিন্ন খাত কর হ্রাস, কর হার কম, কর অবকাশ, কর রেয়াতসহ নানা নামে সুবিধা ভোগ করছে। এসব সুবিধা দেয়ার পর যে পরিমাণ রাজস্ব আহরণ হয় তা খুবই কম।
অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আদায়যোগ্য রাজস্বের বড় একটি অংশ সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। এ কারণে কর ফাঁকির পরিমাণ বেশি। সবশেষ গত অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে সংগৃহীত রাজস্বের পরিমাণ ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা।
আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে জিডিপির যে আকার তার সঙ্গে রাজস্ব আদায় সংগতিপূর্ণ নয়। অর্থনীতির আকার অনুযায়ী, বছরে রাজস্ব আদায় হওয়া উচিত কমপক্ষে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। বাকি টাকা আদায় হচ্ছে না। এটা এনবিআরের বড় ব্যর্থতা বলে মনে করি। এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, জিডিপির ভিত্তিতে ৭০ শতাংশ জাতীয় ব্যয় ধরে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি, জিডিপিতে শিল্প, সেবা ও বেতন-ভাতা খাতের অবদান, আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং, মুদ্রা পাচার, কর ফাঁকি ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত হওয়া উচিত কমপক্ষে ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ। অথচ তা আছে ৯ শতাংশ। আশানুরূপ রাজস্ব আদায় না হওয়ার জন্য প্রধানত এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করেন তিনি।
এনবিআর সূত্র বলেছে, আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্কে অব্যাহতি সুবিধা আছে। এর মধ্যে বেশি সুবিধা ভ্যাটে। কৃষি, কৃষিজাত শিল্প রপ্তানির প্রায় পুরোটাই ভ্যাটের বাইরে। পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছে। পোশাক আমদানিকারকরা বিদেশ থেকে যেসব কাঁচামাল আনেন তাতে কোনো শুল্ক লাগে না। এ জন্য বন্ড লাইসেন্স দেয়া হয়। তবে শর্ত হচ্ছে, শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আনার পর তা দিয়ে পোশাকপণ্য তৈরি করে রপ্তানি করতে হবে। কিন্তু অনেক পোশাক কারখানার মালিক বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়ে রাতারাতি সম্পদশালী বনে গেছেন বলে অভিযোগ আছে। এনবিআরের ২০০৫ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শুধু বন্ড সুবিধা বাতিল করলে এই খাতে বছরে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে। অবশ্য এই সুবিধা রোধে এনবিআর এখন বন্ড ব্যবস্থাপনাকে অটোমেশন করেছে। আগামী বছর থেকে এর সুফল মিলবে।
সূত্র জানায়, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন অংশীজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর বিভিন্ন সময় প্রজ্ঞাপন জারি করে আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর ও আয়কর খাতে নানাভাবে অব্যাহতি সুবিধা দেয়।
আয়করে প্রায় ৫৮টি খাতে কর অব্যাহতি দেয়া আছে। ভ্যাটে আছে প্রায় এক হাজার পণ্য। আমদানি পর্যায়ে শতাধিক এসআরও আছে, যার মাধ্যমে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়া হয়েছে। সংসদ সদস্যরা বিলাসবহুল গাড়ি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছেন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা র‌্যাপিডের চেয়াম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাকের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কর অব্যাহতির ফলে বছরে ক্ষতি হচ্ছে জিডিপির আড়াই শতাংশ।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি ইআরএফ আয়োজিত এক সেমিনারে বলেন, আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক খাতে কর সুবিধা দেয়ায় বছরে রাজস্ব ক্ষতি দুই লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। যদিও এসব তথ্যের সঠিক ভিত্তি নেই। এজন্য বস্তুনিষ্ঠ একটি সমীক্ষা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআরের করনীতি বিভাগ।
২০০৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি এনালাইসিস ইউনিট আয়োজিত ‘ট্যাক্স এক্সপেনডিচার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে যে পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হয়, তা জিডিপির আড়াই শতাংশ। গোলাম মেযাজ্জেম ও লৎফুন নাহার বেগম যৌথভাবে গবেষণাটি করেন। জানা যায়, কর অব্যাহতির বিষয়ে গত বছর একটি সাময়িক সমীক্ষা চালায় এনবিআর। এতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন খাতে অব্যাহতি দেয়ার ফলে প্রতি বছর রাজস্ব ক্ষতি হয় মোট জিডিপির ২ দশমিক ২৮ শতাংশ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আইএমএফের পরামর্শ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ