পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইউক্রেন যুদ্ধ ক্রমশ জটিল, প্রাণঘাতি ও দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে চলেছে। বিশ্বের অন্যতম ব্রেড বাস্কেট তথা খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা অঞ্চল রাশিয়া ও ইউক্রেনের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে এমনটা ঘটবে, জানা কথা। পশ্চিমারা রাশিয়ার উপর সামরিক আগ্রাসনের দায় চাপাচ্ছে, এটাও যুদ্ধেরই আরেক কৌশল। রাশিয়া অনেক আগে থেকেই ইউক্রেনে তার কৌশলগত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে পশ্চিমাদের প্রতি বারবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছে। ইউক্রেনে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নস্যাৎ করে সেখানে সিআইএ নিয়ন্ত্রিত সামরিক ক্যু এবং বশংবদ শাসক বসানোর পর ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার তোড়জোড় সৃষ্টির প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়ান ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। লৌকিক- ঐতিহাসিকভাবে ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলটি রুশ ভাষা ও রুশ বংশোদ্ভুত মানুষের সংখ্যাধিক্য থাকায় স্বাভাবিকভাবেই রুশ বিরোধি যেকোনো রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পদক্ষেপ এ অঞ্চলের মানুষের সমর্থন পায় না। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনে ডনবাস এলাকার গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর পতনের পর সেখানকার অধিবাসিদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিতে দেখা গেছে। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে দোনেস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরেজিয়া অঞ্চলে অনুষ্ঠিত গণভোটে রাশিয়ান ফেডারেশনের সাথে একিভুত হওয়ার পক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার রায় দেয়। রাশিয়ান সেনাবাহিনী অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রভাবমুক্ত ভোট নিয়ে সংশয় থাকলেও সেখানকার অধিবাসিদের উপর রাশিয়ান ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাব ও ইউক্রেনের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভোটের এমন ফলাফলকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সামরিক প্রক্সির বিরুদ্ধে এটি রুশ বংশোদ্ভত ইউক্রেনীয়দের ব্যালট প্রতিবাদ বলে আখ্যায়িত করলেও তা অত্যুক্তি হবে না। ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে শুরু থেকেই পশ্চিমারা রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সমাধানের কোনো পথ খোলা রাখেনি। রাশিয়ার নিরাপত্তার ইস্যু এবং কূটনৈতিক সমাধানের বদলে রাশিয়ার উপর কঠোর অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ইউক্রেনে প্রচুর সমরাস্ত্র ও শত শত কোটি ডলারের সামরিক বাজেট দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধকে আমেরিকার একটি প্রক্সি যুদ্ধে পরিনত করেছে। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের কথা বলে সেখানকার সাধারণ মানুষের সামগ্রিক নিরাপত্তাকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ইউক্রেনের হাতে অস্ত্র আর অর্থ দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং অন্যতম পারমানবিক-সামরিক পরাশক্তি রাশিয়াকে পরাস্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয়। এটি আফগানিস্তান থেকে রাশিয়া এবং আমেরিকার সামরিক ব্যর্থতার মত কোনো ঘটনার বিষয় নয়। একে অনেকটা কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের সাথে তুলনা করা যায়। ফ্লোরিডা থেকে মাত্র আশি কিলোমিটার দূরে কিউবায় যদি রাশিয়া শক্তিশালী মিসাইল ও সেনাবাহিনী পাঠায় এবং আমেরিকা নিজের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে কিউবা দখল করে নেয়ার জন্য সামরিক অভিযান চালালে যে ধরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো, ইউক্রেনে এখন প্রায় অনুরূপ অবস্থা বিরাজ করছে। কূটনৈতিক সমঝোতার পর আমেরিকা আর কখনো কিউবা দখল বা হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেনি, রাশিয়াকেও কিউবার নিরাপত্তার অজুহাতে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিতে হয়নি। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে তেমন একটি রাজনৈতিক-কূটনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন। তবে দুই পক্ষে আরো লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং হাজার হাজার কোটি টাকার যুদ্ধব্যয় এবং অপূরণীয় অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির মুখে বিশ্ব মহাসংকটে পতিত হলেই কেবল এ ধরণের উদ্যোগ দেখা যেতে পারে।
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতেই জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ায় সারাবিশ্বে খাদ্যশস্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যায়। খাদ্য রফতানিকারক দেশ ইউক্রেনের বন্দরগুলোতে অপেক্ষমান খাদ্যবাহী জাহাজগুলো অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য আটকে পড়ে। এহেন বাস্তবতায় তুরস্ক এবং জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি প্রাথমিকভাবে ১২০ দিনের জন্য একটি খাদ্য পরিবহন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকি কিছুটা দূর হয়েছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝিতে চুক্তি নবায়নের কথা থাকলেও চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে এ সপ্তাহে ক্রিমিয়ায় কৃষ্ণসাগরে রুশ জাহাজ ইউক্রেনের ড্রোন হামলার শিকার হওয়ার পর রাশিয়া খাদ্য নিরাপত্তা চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ায় আবারো খাদ্যশস্য আমদানির উপর নির্ভরশীল দেশগুলো নতুন করে অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হল। রফতানি করতে না পারলে লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য গুদামে পঁচবে, অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষ খাদ্যের দুর্মূল্য ও দুর্ভীক্ষের সম্মুখীন হবে। জাতিসংঘ মহাসচিব এন্থনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক রাশিয়ার প্রতি চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন। যুদ্ধের সময়ও খাদ্য সরবরাহ প্রশ্নে রাশিয়া ও ইউক্রেনের চুক্তি খুবই ইতিবাচক একটি দৃষ্টান্ত। তবে কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের মত ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘ কেন কূটনৈতিক উদ্যোগ নিচ্ছে না? চীন, তুরস্ক এবং জাতিসংঘের সমন্বিত উদ্যোগে ইউক্রেন সমস্যার একটি রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সমাধান অসম্ভব নয়। তবে ইউনিপোলার বিশ্বব্যবস্থায় জাতিসংঘের প্রভাব ও সক্ষমতা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্যোগ ছাড়া জাতিসংঘ এখন কার্যত ঠুটো জগন্নাথ হয়ে পড়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধকে প্রলম্বিত করে রাশিয়ার অর্থনীতি ও সামরিক শক্তি ধ্বংসের পশ্চিমা ছক সবাই বুঝতে পারছে। তবে প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইউনিপোলার বিশ্বের পরিসমাপ্তির সংকল্প তুলে ধরেছেন। ডলারের বিকল্প মুদ্রা হিসেবে রুবল-ইউয়ান এবং যৌথ উদ্যোগে বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ সফল হলে তা বিশ্বের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য ব্যবস্থাকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে আসতে পারে। সম্প্রতি মস্কো ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্থা ভ্যালদাই ডিসকাশন ক্লাবের মুখোমুখি হয়ে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন সমসাময়িক বিশ্বব্যবস্থা ও তার ভবিষ্যত সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অ্যাকাডেমিসিয়ান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবের মধ্য দিয়ে নিজের বিস্তারিত বক্তব্য তুলে ধরেছেন। সে ডিসকাশন পর্বে রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর পাশাপাশি চীন, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভেনেজুয়েলা, দক্ষিণ আফ্রিকার মত দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে নিজ দেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্বমূলক ও অ্যাকাডেমিক প্রশ্ন রেখেছেন। আবার কানাডার মত ন্যাটোভুক্ত এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মত মার্কিন মিত্র দেশের প্রতিনিধিও সেখানে পুতিনকে প্রশ্ন করার সুযোগ গ্রহণ করেছেন। রাশিয়া বাংলাদেশের পুরনো মিত্র এবং উন্নয়ন অংশীদার হলেও ভ্যালদাই ডিসকাশন ক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধির অংশগ্রহণ না থাকা বিস্ময়কর। এ দেশের একশ্রেণীর বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এক সময় মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা মেলতো। এখন তারা কোথায়? পশ্চিমা মূল ধারার গণমাধ্যমগুলো ভ্যালদাই ডিসকাশন ক্লাবের আলোচনা নিয়ে কিছুটা নীরবতা অবলম্বন করলেও পশ্চিমা বামপন্থী ও লিবারেল লেখক-কলামিস্টরা পুতিনের অবস্থানকে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার গ্যাড়াকল ভাঙ্গার বিপ্লবী অবস্থান হিসেবেই তুলে ধরেছেন।
এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা বিশ্বকে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের চেয়েও অনেক বেশি অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। সোভিয়েত আমলের সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার পতনের পর মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের প্রতিরক্ষা বাজেট এবং সামরিক ইনস্টলমেন্ট অনেকাংশে কমিয়ে আনার কথা থাকলেও একটি ইউনিপোলার বিশ্বব্যবস্থার উপর ন্যুনতম চ্যালেঞ্জকে দমন করার লক্ষ্যে তারা ন্যাটো জোটের সম্প্রসারণসহ সামরিক বাজেট বাড়িয়েই চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির অন্যতম শক্তি রাশিয়ার মর্যাদা ও নিরাপত্তার বিষয়টিকে অবজ্ঞা ও অগ্রাহ্য করার অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে ইউক্রেনে পশ্চিমাদের ভূমিকার দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। আফগানিস্তান, ইরাক, ওয়ার অন টেররিজম, সিরিয়ায় প্রক্সিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করেও কেনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে না পারলেও এসব যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশগুলোর অবকাঠামো ধ্বংস, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং রিজার্ভ ফান্ডের শত শত বিলিয়ন ডলার ফ্রিজ করে দিয়ে কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্য ও দুর্ভীক্ষের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। প্রথম গাল্ফ ওয়ারের পর ইরাকের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে সেখানকার লাখ লাখ শিশু অপুষ্টি, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কারণে শিশুমৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। নিউজউইকের সাংবাদিক লেসলি স্টাল তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব মেডেলিন অলব্রাইটের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে ১৯৯৬ সালে প্রশ্ন করেছিলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরাকে ৫ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়েছে, যা কিনা হিরোশিমায় নিহতের সংখ্যার চেয়েও বেশি, আপনি কি মনে করেন এটাই উচিৎ মূল্য? তিনি শান্ত গলায় জবাব দিয়েছিলেন, ‘আ ভেরি হার্ড চয়েজ, বাট দ্য প্রাইস- উই থিঙ্ক দ্য প্রাইস র্ওথ ইট।’ রাষ্ট্রের ভাগ্য এবং তৃতীয় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবন নিয়ে পশ্চিমাদের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পার্ল হারবারে জাপানি বোমা বর্ষণের প্রতিশোধ নিতে জাপানের দুটি শহরের লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করতে বিশ্বে প্রথমবারের মত পারমানবিক বোমা ব্যবহার করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া বা ফিলিস্তিনীরা কখনোই মার্কিনীদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়নি। ইউক্রেনে প্রক্সি যুদ্ধের আগ পর্যন্ত রাশিয়াও মার্কিনীদের নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে উঠতে চায়নি। কিন্তু তারা দূরতম সম্ভাবনাকেও পায়ে পিষে নস্যাৎ করে দিতে যেকোনো দেশের উপর ভয়াবহ সামরিক আগ্রাসন চাপিয়ে দিতে এক মুহূর্ত দেরি করেনা। মার্কিন নেতৃত্বাধীন এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বৈষম্য, নিরাপত্তাহীনতা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্য আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। অন্যদেশের উপর যুদ্ধব্যয় চাপিয়ে, গচ্ছিত অর্থ চুরি করে, জ্বালানি সম্পদ লুন্ঠন করে যুদ্ধব্যয় যোগান দিতে গিয়ে বিশ্বের শতকোটি মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা চরম ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাদী অর্থনীতি ও মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের স্বার্থে বিশ্বকে একটি অন্তহীন যুদ্ধের চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এ কারণে বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের পক্ষে জাতিসংঘসহ বিশ্ব সংস্থাগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ ব্যর্থ অথবা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনোই প্রত্যক্ষ নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে না পড়লেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা বাজেট বিশ্বের জন্য অন্যতম অর্থনৈতিক ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পেছনে মার্কিন নিরাপত্তা বা মার্কিন জনসাধারণের কোনো স্বার্থ নেই। এটি শুধুই এমআইসি ও কর্পোরেট হেজিমনিক এজেন্ডায় বিশ্বকে একটি অন্তহীন যুদ্ধের বাজারে পরিনত করার নীলনকশার অংশ। ‘ওয়ার্ল্ড বেয়ন্ড ওয়ার’ নামের একটি বৈশ্বিক প্রস্তাবনার থিসিস পেপারে বলা হয়েছে, বিশ্বের সামরিক বাজেটের মাত্র ৩ ভাগ অর্থ দিয়ে বিশ্বের ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট বাকি দুনিয়ার সম্মিলিত সামরিক বাজেটের চেয়েও বেশি। ওয়ার অন টেররিজম শুরুর পর থেকে মার্কিন সামরিক বাজেট প্রতিবছরই বেড়ে চলেছে। জাতিসংঘ ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির দেয়া হিসাব মতে, বিশ্বকে ক্ষুধামুক্ত করতে বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার অর্থের প্রয়োজন। আর ২০১৯ সালের পেন্টাগনের সামগ্রিক বাজেট ধরা হয়েছিল ১.২৫ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১২২৫ বিলিয়ন ডলার। এর ৩ ভাগ আলাদা রাখলে অঙ্কটা দাঁড়ায় সাড়ে ৩৭ বিলিয়ন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রধান সামরিক বা নিরাপত্তা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হিসেবে চীন, রাশিয়া এবং ইরানকে উল্লেখ করে থাকে। এসব দেশের সম্মিলিত সামরিক বাজেট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক। বিশ্বের বার্ষিক সামরিক বাজেট ২ ট্রিলিয়ন ডলারের সমান। এর মানে হচ্ছে, বিশ্বের সামরিক বাজেটের শতকরা ১.৫ ভাগ খরচ করলে বিশ্বকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাজেট বৃদ্ধি না করলে এবং চীন-রাশিয়া বা ইরানের মত দেশগুলোর জন্য নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি না করলেও তাদেরও সামরিক বাজেট বৃদ্ধির প্রয়োজন হতোনা। যুদ্ধ শুধু যুদ্ধের হুমকি সৃষ্টি করে। যুদ্ধের বাস্তব ফল ধ্বংসযজ্ঞ, গণহত্যা, দুর্ভীক্ষ এবং অর্থনৈতিক সংকট।
আগামী বছর বিশ্বে একটি অর্থনৈতিক মহামন্দা ও দুর্ভীক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। ইউক্রেনে যুদ্ধপরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলার মধ্য দিয়ে বিশ্ব যেন সে দিকেই এগুচ্ছে। বিশ্বসংস্থাগুলোর পাশাপাশি আমাদের সরকারও আগামী বছর একটি দুর্ভীক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করে বার্তা দিয়েছে। জ্বালানি, বিদ্যুত, সার ও সেচের সংকটের পাশাপাশি সিত্রাংয়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের খাদ্য উৎপাদনে লক্ষমাত্রা অর্জনে অশনি সংকেত দিচ্ছে। অন্যদিকে, বিশ্বের প্রধান গম রফতানিকারক দেশ ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ধরণের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ এক ভয়াবহ দুর্ভীক্ষ প্রত্যক্ষ করেছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে ও অপুষ্টিজণিত রোগে মারা গেছে। অর্থনৈতিক শোষণমুক্তির কথা বলে দেশের মানুষকে স্বাধীনতার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল। সেই দেশটির স্বাধীনতার সূচনালগ্নেই চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য, বঞ্চনা ও লুণ্ঠন-দুর্নীতির শিকার হয়ে বিশ্বের সামনে তলাবিহিন ঝুড়ির অপবাদের সম্মুখীন হয়েছিল। এ দেশের লাখ লাখ রেমিটেন্স যোদ্ধা, কৃষক এবং রফতানিমুখী পোশাক শিল্পখাতের উদ্যোক্তা ও লাখ লাখ শ্রমিকের ঘাম ঝরানো শ্রমে বিদেশিদের সব হিসাব-নিকাশ ভ্রান্ত প্রমান করে এ দেশ উন্নয়নের সোপানে পা রাখতে সক্ষম হয়েছে। কেন স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে সে দেশে আবারো দুর্ভীক্ষের ডঙ্কা শোনা যাচ্ছে। দেশটি আবারো নজিরবিহীন লুটপাটের পরিনতির শিকার। গত ১৫ বছরে দেশ থেকে অন্তত ১০ লক্ষকোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার চরম ফল ভোগ করতে চলেছি আমরা। গত কয়েক বছর ধরে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও ভবিষ্যত প্রশ্নে মানিলন্ডারিং সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলেও একদিনের জন্যও অর্থপাচার বন্ধ করা যায়নি। এ জন্য দেশে গণতন্ত্র না থাকা, নিরাপত্তাহীনতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করা হচ্ছে। আগামী বছরে সম্ভাব্য দুর্ভীক্ষ এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের জন্য প্রথমেই দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।