পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
‘আল্লাহু আকবর’ (আল্লাহ সবার চেয়ে বড়)। দু’টি শব্দের এই বাক্যটি আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের প্রতীক। এটি মুমিনের ঈমানের বহিঃপ্রকাশ। এটি সৃষ্টিকর্তার প্রতি সৃষ্টিজগতের স্বভাবজাত ঘোষণা। অতি বড় নাস্তিকও বিপদে পড়লে আল্লাহকে ডাকে। কিন্তু যুগে যুগে শয়তান মানুষের এই স্বভাবধর্মের উপর হানা দিয়ে তাদের সরল পথ থেকে বিচ্যুত করেছে। শিরক ও কুফরের চাকচিক্য দিয়ে তাওহীদকে আড়াল করতে চেয়েছে। নবী-রাসূলগণ যুগে যুগে মানুষকে আল্লাহ্র দাসত্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পক্ষান্তরে শয়তান মানুষকে তার নিজের প্রতি দাসত্বের আহ্বান জানিয়েছে। অবশ্য এজন্য সে আল্লাহকে ‘রব’ হিসাবে স্বীকার করেছে। অতঃপর ক্বিয়ামত পর্যন্ত দীর্ঘ হায়াত লাভ ও সে পর্যন্ত মানুষকে পথভ্রষ্ট করার অনুমতি প্রার্থনা করেছে। আল্লাহ তার সে প্রার্থনা মনজুর করেছেন। সাথে সাথে বলে দিয়েছেন, তুমি আমার মোখলেছ বান্দাদের কখনোই পথভ্রষ্ট করতে পারবে না (হিজ্র ৩৬-৪২)। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ যখন পথভ্রষ্ট হয়েছে, তখন তাদের পাপের প্রতিফল হিসাবে একে একে পৃথিবীর ৬টি জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। তারা হলো কওমে নূহ, আদ, ছামূদ, লূত, মাদিয়ান ও কওমে ফেরাঊন। এরপরেও শয়তান থেমে যায়নি। ইরাকের সম্রাট নমরূদের উপর সওয়ার হয়ে সে তাওহীদের আপোসহীন বাণীবাহক জীবন্ত ইব্রাহীমকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে ভস্ম করতে চেয়েছে। কিন্তু আল্লাহ্র হুকুমে আগুন ঠাণ্ডা হয়ে যায় ও ইব্রাহীমের উপর শান্তিদায়ক হয়ে যায়’ (আম্বিয়া ৬৯)।
পরবর্তীতে ইব্রাহীম ও তার জ্যেষ্ঠপুত্র ইসমাইলের হাতে গড়া কা’বাগৃহের খাদেম ও তত্ত্বাবধায়ক কুরায়েশ বংশের নেতাদের উপর সওয়ার হয়ে শয়তান তাদেরকে মূর্তিপূজায় প্রলুব্ধ করে। ফলে তাওহীদের স্বচ্ছ আকাশে শিরকের কালো ছায়া ঘনীভূত হয়। ‘আল্লাহু আকবর’-এর সাথে লাত-মানাত, ওযযা-হোবলের জয়ধ্বনি ওঠে। শিরকের শিখণ্ডী হলেও তারা কিন্তু কথায় কথায় আল্লাহ্র নামে শপথ করত। সবকাজে আল্লাহকেই সাক্ষী মানত। অতঃপর আল্লাহ চাইলেন বিশ্বের এই সেরা বংশটিকে খালেছ তাওহীদে ফিরিয়ে আনতে। তাই তাদের মধ্য থেকেই পাঠালেন বিশ্বনবী ও শ্রেষ্ঠনবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-কে। সেই সাথে পাঠালেন চিরন্তন সত্যের উৎস কুরআন ও সুন্নাহ। শয়তান সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করল এই দুর্বার তাওহীদী আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য। মক্কার প্রায় সব নেতাকে শয়তান কব্জায় নিল। ফলে শুরু হলো হিজরত ও নুছরতের পালা। ছড়িয়ে গেল তাওহীদের দাওয়াত হাবশা, ইয়াছরিব ও পারস্য এলাকায়। জান্নাত পাগল হৃদয়গুলি সব জমা হয়ে গেল শেষনবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর ঝাণ্ডাতলে। শুরু হলো সম্মুখ সমর। একে একে সৃষ্টি হলো বদর, ওহোদ, খন্দক ও সবশেষে তাবুকের বিজয়াভিযান। সবখানেই শ্লোগান ছিল ‘আল্লাহু আকবর’।
মুসলমান দৈনিক আযান-এক্বামত ও সালাতে, ঈদায়জনে, হজ্জ ও ওমরাহতে, আইয়ামে তাশরীক্বে, জানাযাতে সর্বত্র ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি উচ্চারণ করে। হজ্জের অনুষ্ঠানসমূহে বিশেষ করে ৩টি জামরায় শয়তানের প্রতি কংকর নিক্ষেপের সময় উচ্চ কণ্ঠে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে। অর্থাৎ এটি শয়তানের বিরুদ্ধে আল্লাহ্র একত্বের ও বড়ত্বের দ্ব্যর্থহীন শ্লোগান।
ইতিহাসের পবিত্রতম শ্লোগান হলো ‘আল্লাহু আকবর’। এই শ্লোগান বিশ্বাসী হৃদয়ে বিদ্যুতের চমক সৃষ্টি করে। এর ফলে তার মধ্যে বিশ্বজয়ী শক্তির উত্থান ঘটে। আল্লাহ্র পথে সবকিছুকে সে তুচ্ছ জ্ঞান করে। আল্লাহ্র উপর ভরসা করে সে নির্ভীকচিত্তে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার মূল চেতনা হলো ‘আল্লাহু আকবর’। এই চেতনাই পূর্ববঙ্গকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পৃথক রাজনৈতিক মর্যাদা দিয়েছে। এই চেতনাই পূর্ববঙ্গকে ‘বাংলাদেশ’ নামে পৃথিবীর বুকে পৃথক রাষ্ট্রীয় মানচিত্র দান করেছে। পিছন দিকে তাকালে দেখতে পাই, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানের ১৪ সেপ্টেম্বর সিলেট আগমন উপলক্ষে ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ সালে প্রচারিত বিজ্ঞাপন: নারায়ে তকবীর, আল্লাহু আকবর। দেখতে পাই ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০-এর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিজ্ঞাপনের শীর্ষে ‘আল্লাহু আকবর, আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’। দেখতে পাই ১৯৭০ সালের ৬ নভেম্বর বগুড়ার গুজিয়া হাইস্কুল মাঠে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত বিরাট জনসভার বিজ্ঞাপনের শীর্ষে ‘আল্লাহু আকবর’। শুনতে পাই ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রবিবার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) প্রধান অতিথির ভাষণ শেষে শেখ মুজিবের ভরাট কণ্ঠের গগণভেদী সমাপ্তি শ্লোগান ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর’ (সূত্র : ঢাকা, দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ জানুয়ারি সোমবার ১৯৭১/১৯ পৌষ ১৩৭৭)।
অতঃপর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ভোরের দিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসায় ৪ দিন যাবত বন্দি মেজর জিয়া সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলে সিপাহী-জনতা হাজারো কণ্ঠে ‘নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে তাকে বরণ করে নেয়। সেই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দল ‘বিএনপি’ নেতাদের এখন এই শ্লোগানে এলার্জী কেন? এর বিরুদ্ধে বস্তুনিষ্ঠ তকমাধারী সাংবাদিক ও কোনো কোনো পত্রিকার গাত্রদাহ কেন?
‘আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান যে এদেশের মানুষকে কীরূপ উজ্জীবিত করে, সেটা অতি সম্প্রতি সবাই দেখেছে। গত ১২ অক্টোবর বুধবার বিকালে চট্টগ্রামের পলো গ্রাউণ্ড ময়দানে বিএনপি আয়োজিত জনসভায় সাবেক এক বিএনপি নেতার পুত্রের ‘নারায়ে তাকবীর’ শ্লোগানের সাথে সাথে লাখো জনতার কণ্ঠে উচ্চারিত ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি। কিন্তু পরের দিন বিএনপির স্থানীয় প্রবীণ নেতা সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বলে দিলেন যে, ‘এটি তাদের দলীয় শ্লোগান নয়। বরং দাতার ব্যক্তিগত শ্লোগান’। এতে দলের মধ্যে ও সারাদেশে জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এর মাধ্যমে নেতারা কাদের খুশি করতে চান? রাজনৈতিক দলগুলি কি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে? নাকি নেপথ্যের অন্য কারও? পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে যখন ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান দিতে অস্বীকার করায় প্রকাশ্য রাজপথে নিরীহ মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়, যখন সেদেশে মাইকে আযান দিতে নিষেধ করা হয়, তখন এইসব রাজনীতিকের মুখে কুলুপ আঁটা থাকে কেন? আল্লাহ বলেন, ‘যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না, তাদের সামনে যখন এককভাবে কেবল আল্লাহ্র কথা বলা হয়, তখন তাদের অন্তরগুলো ভয়ে সংকুচিত হয়ে যায়। আর যখন তাকে বাদ দিয়ে অন্যদের কথা বলা হয়, তখন তারা উল্লসিত হয়’ (যুমার ৪৫)। রাসূল (সা.) বলেন, ‘আযান ও এক্বামতে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি শুনলে শয়তান বায়ু নিঃসরণ করতে করতে ছুটে পালায় ও পরে ফিরে আসে’ (বু. মু. মিশকাত হা/৬৫৫)।
মনে রাখা আবশ্যক যে, ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর একে একে জুনাগড়, মানভাদড়, গোয়া, হায়দরাবাদ, কাশ্মীর এবং সবশেষে ১৯৭৫ সালের ১ মে সিকিম প্রভৃতি স্বাধীন রাজ্যগুলি প্রতিবেশী বৃহৎ দেশটির গ্রাসে চলে যায় কেবল নেতাদের ভুলের কারণে। অতএব, নেতারা সাবধান! পরিশেষে বলব, কথায় ও কর্মে ‘আল্লাহু আকবর’ শ্লোগানের সত্যিকার অনুসারীরাই এদেশে সর্বদা বিজয়ী থাকবে এবং তারাই আল্লাহ্র রহমত লাভে ধন্য হবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক: আমীর, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ ও সাবেক অধ্যাপক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।