মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
যখনই কোনো বিশ্বশক্তি সঙ্ঘাতের মুখোমুখি হয়, তখনই পৃথিবীজুড়ে অস্থিরতা তৈরি হয় এবং এর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে সাব-সাহারান আফ্রিকা, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া কোথাও আর্থ-সামাজিক স্বস্তি বা স্থিতিশীলতার আশা করাটা অর্থহীন। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি গত মাসে বিশ্বের বেশিরভাগ অংশকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে একটি শীতল যুদ্ধ ইতোমধ্যেই বিদ্যমান এবং এটি একটি চরম যুদ্ধে পরিণত হতে পারে, কারণ চীনও তাইওয়ানকে একত্রিত করার লক্ষ্যে রয়েছে। এক অর্থে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং এটি ইউক্রেনে শুরু হয়েছে। কারণ এ সঙ্ঘাতের প্রভাব রাশিয়া ও ইউক্রেনের সীমানা পেরিয়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের আরোপিত বহুবিধ অর্থনৈতিক অবরোধ বা বিধিনিষেধ গোটা বিশে^র জনগণকে আরো একটি ভয়াবহ পারমাণবিক যুদ্ধের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে উস্কানি গোটা বিশ^কে একটি মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যার রেশ কয়েক মাস পেরিয়ে কয়েক যুগ পর্যন্তও থেকে যেতে পারে এবং আরো একটি তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ বা পরমাণু আক্রমণ হলে বধ্যভূমিতে পরিণত হবে গোটা বিশ^।
এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু নেতা পুতিনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এগিয়ে এসেছেন। মার্কিন আপত্তি সত্ত্বেও প্রধান তেল রফতানিকারকদের উৎপাদন হ্রাস করার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে সউদী আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত রাশিয়ার সাথে সহযোগিতা করেছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার নতুন ক্ষেত্রগুলো বিবেচনার সময় ইউক্রেন-সম্পর্কিত মধ্যস্থতাকে পূর্বের সফলভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সাথে কাতারের জ্বালানি সহযোগিতা নিয়ে উত্তেজনা প্রশমিত করতে অক্টোবরের মাঝামাঝি পুতিনের সাথে দেখা করেছিলেন।
আলবার্টার প্রধানমন্ত্রী ড্যানিয়েল স্মিথ এ বছরের শুরুতে বলেছিলেন যে, যুদ্ধের সমাধানের একমাত্র উপায় হল যদি ইউক্রেন নিরপেক্ষ থাকে। বেলারুশিয়ান নেতা আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো এ মাসের শুরুতে বলেছেন যে, তিনি পুতিনের সাথে একমত হয়েছেন যে, ‘ইউনিয়ন স্টেটের পশ্চিম সীমান্তে উত্তেজনার সাথে সম্পর্কিত একটি যৌথ আঞ্চলিক জোট থাকা উচিত।’ রাশিয়া এবং বেলারুশের মধ্যে ‘ইউনিয়ন স্টেট’ তাদের সামরিক বাহিনী, ব্যাংকিং এবং অন্যান্য খাতকে একাত্মতা ঘোষণা করে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন সেক্রেটারি অফ স্টেট হেনরি এ কিসিঞ্জার বলেছেন যে, ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে রাশিয়াকে ইউক্রেনের ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়া উচিত। সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে কিসিঞ্জার ইউক্রেনে রাশিয়াকে বিব্রতকর পরাজয়ের সম্মুখীন না করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সতর্ক করেছেন যে, এটি ইউরোপের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার অবনতি ঘটাতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলোর ইউরোপের প্রতি রাশিয়ার গুরুত্বের কথা মনে রাখা উচিত এবং এ মুহূর্তের মেজাজে আচ্ছন্ন হওয়া উচিত নয় এবং কিসিঞ্জার পশ্চিমাদেরও চাপ দিয়েছেন ইউক্রেনকে তার পূর্ববর্তী অবস্থার ফিরে যাওয়ার জন্য আলোচনায় বাধ্য করতে। একটি ঊর্ধ্বতন পশ্চিমা সামরিক সূত্র বলেছে, ‘সামরিক পদক্ষেপ এককভাবে অকার্যকর। এটি তখনই সত্যিকার অর্থে কার্যকর হয়, যখন এটি অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার সাথে একত্রিত হয়। এবং আমরা যথেষ্ট কূটনীতি দেখছি না।’ রাশিয়ার সাথে সমাঝোতার পরামর্শের কারণে সমালোচিত হওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধে কূটনীতিকে নোংরাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কিসিঞ্জারের পাশাপাশি ইলন মাস্ক এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট ডেভিড স্যাকস সম্প্রতি রাশিয়ান পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন। বিলিয়নিয়ার বিনিয়োগকারী বিল অ্যাকম্যানও তাদের সাথে খোলাখুলিভাবে যোগ দিয়ে বলেছেন যে, ইউক্রেনকে রাশিয়ার সাথে শত্রুতা বন্ধ করার বিনিময়ে ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার যে কোনো দাবি সমর্থন করা উচিত। তিনি বলেন, ‘হাজার হাজার জীবন বাঁচবে এবং ইউক্রেনের পুনর্গঠনের জন্য সম্পদ বিনিয়োগ করা যেতে পারে এমন যুদ্ধের পরিবর্তে, যা কেবল আরো ধ্বংস ও মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাবে’।
করোনার ভয়াবহতা এখনও বহু দেশে বিদ্যমান। মানুষ এখনও ভুগছে ও মৃত্যুবরণ করছে। বিশ^ অর্থনীতি এখনও সচল ও শক্ত অবস্থানে পৌঁছেনি। কিন্তু এতে বিশ্বনেতাদের কোনো মাথাব্যাথা আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মাস এমনকি কয়েক বছরও যুদ্ধ চলতে পারে। যদিও ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি ইতোমধ্যেই বলেছে যে, তারা চায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হোক, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো যুদ্ধ বন্ধের বিরুদ্ধে। তারা ইউক্রেনকে সহায়তা অব্যহত রেখেছে। কারণ, রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্ঘাত ইউরোপ-ন্যাটোর স্বার্থই দীর্ঘায়িত হচ্ছে, যা ঐ দেশগুলোর তৈরি অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, যুদ্ধসামগ্রী এবং ক্ষমতার নজিরবিহীন প্রদর্শনী, রফতানি ও বিল্ডির মহাসুযোগকে ত্বরান্বিত করেছে। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে যে কারোর মনে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এ যুদ্ধের পরিণতি কী এবং সবখানে অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য সঙ্কট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আতঙ্ক, ভয় এমনকি পরমাণু যুদ্ধেরও আশঙ্কা নিয়ে বিশে^ আসলে কোন দিকে এগোচ্ছে?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøলাদিমির পুতিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমূলক দাবি ছিল, তার দেশের দরজায় প্রতিবেশী ইউক্রেনকে কোনোভাবেই যেন ন্যাটো সদস্য করা না হয়। পশ্চিমা জোট রাশিয়ার সার্বিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। পুতিনের আশঙ্কা যে, এমনটি হলে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোভুক্ত রাশিয়াবিরোধী পশ্চিমা জোট যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইউক্রেনকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তুলতে সর্বাত্মকভাবে মদদ দেবে, যা রাশিয়ার সার্বিক নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের ওপর হুমকি সৃষ্টি করবে, এমনকি সুযোগ পেলে তারা অতর্কিতে চঈ্রর্মুখী আক্রমণ করে গোটা রাশিয়াকে ভেঙেচুরে আরো খণ্ডবিখণ্ড করে দেবে। পুতিনের দাবি ও আশঙ্কাকে কোনভাবেই উড়িয়ে দেয়ার অবকাশ নেই। ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ^ বড় কাতর। তাদের এই মানবিকতা প্যালেস্টাইন ইস্যু বা রোহিঙ্গা ইস্যু বা কাশ্মির ইস্যুতে বিশ^ দেখতে পায় না। পশ্চিমা জোটের এ দ্বিমুখী নীতির ফলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সীমানা পেরিয়ে একটি নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার বা নয়া বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার এক প্রাণান্তকর প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। উজবেকিস্তানের সমরখন্দে অনুষ্ঠিত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) সাম্প্রতিক বৈঠকে পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্পষ্ট বলেছেন যে, পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবের বাইরে বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে এশীয় নেতাদের এবং নতুন রূপ দিতে হবে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে। সম্ভবত, ইতোমধ্যই শুরু হয়ে গেছে একটিু নতুন মেরুকরণ।
যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি সত্ত্বেও সম্প্রতি দৈনিক জ্বালানি তেলের উৎপাদন ২০ লাখ ব্যারেল কমানোর ঘোষণা দিয়েছে সউদী আরব নেতৃত্বাধীন ওপেকপ্লাস। এ যুদ্ধের মধ্যেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়ার তেল কিনছে চীন, ভারত ও তুরস্ক। উত্তর কোরিয়া একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ছে। ইরান হুমকি দিয়ে বলেছে যে, তারা পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে সরবে না।
মেক্সিকো বলেছে, তারা রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাবে। ভেনেজুয়েলা বলছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে অতিরিক্ত তেল দেবে না। মার্কিন-ইউরোপ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো রাশিয়া থেকে প্রয়োজনীয় জ¦ালানি তেল, গ্যাস আমদানি অথবা রাশিয়া থেকে রফতানির ওপর চরম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে শুধু রাশিয়াই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ এবং সমগ্র বিশে^র ধনী-গরিব দেশগুলি ইতোমধ্যেই চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
সউদী আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের পর রাশিয়া বিশে^র তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অবস্থানে রাশিয়ার স্থান। রাশিয়ার তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় আমেরিকা-যুক্তরাজ্যসহ সমগ্র বিশে^ জ¦ালানি তেল ও এর ওপর নির্ভরশীল উৎপাদন ব্যবস্থা, পরিবহন, যোগাযোগ, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পশ্চিমা আধিপত্যের লড়াইয়ে বিশ^বাসীর ক্রয় ক্ষমতা হারানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, যুক্তরাজ্যসহ পাশ্চাত্যের ধনী অস্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবসায়ী দেশগুলোকেই দায়বদ্ধ থাকতে হবে। ধনী দেশগুলোর জন্য হয়তো বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি হবে। কিন্তু উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর জন্য বাসাবাড়ি ও কলকারখানায় ব্যবহৃত গ্যাস ও তেলের চাহিদার পূরণ করা খুবই কঠিন হবে। ফলে রাশিয়ার দাবি মেনে যুদ্ধ বন্ধ করাই এ মহাসঙ্কটের একমাত্র সমাধান। তথ্যসূত্র : ফাইনান্সিয়াল টাইম্স। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।