Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ফিলিস্তিনি ও আরবদের বিরুদ্ধে বর্বরতার জন্য ব্রিটেনকে ক্ষমা চাইতে বলা হচ্ছে

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১১ অক্টোবর, ২০২২, ১১:০৭ এএম

১৯৩৮ ফিলিস্তিনে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর সাধারণ মানুষ ও তাদের সমর্থনকারী আরবদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে ব্রিটিশ সেনা। সে সময় তাদের বর্বরতা ও নৃশংসতা নাৎসীদেরকেও হার মানায়। সেসব যুদ্ধাপরাধের জন্য এখন ব্রিটেনকে ক্ষমা চাইতে বলা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন তুলে ধরা হল।

মেশিনগান বসানো সাঁজোয়া যান নিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যরা আল-বাসায় ঢোকার পর সেই ফিলিস্তিনি গ্রামটির মানুষ বুঝতে পেরেছিল - সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতা কী জিনিস। প্রথমে শুরু হলো সেই রোলস-রয়েস সাঁজোয়া যানের ওপর বসানো মেশিনগান থেকে গ্রামটির ওপর গুলিবর্ষণ। তারপর এলো রয়াল আলস্টার রাইফেলস বাহিনী। তাদের হাতে জ্বলন্ত মশাল। তারা গ্রামটির বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিল। পুরো গ্রাম ছাই হয়ে গেল।

একে একে ধরে আনা হলো গ্রামবাসীদের। তারপর সৈন্যরা তাদের মধ্যে থেকে পুরুষদের নিয়ে একটা বাসে ওঠালো। বাসটিকে বাধ্য করা হলো ল্যান্ড মাইনের ওপর দিয়ে চালাতে। মাইন বিস্ফোরিত হলো, নিহত হলো বাসের সবাই। ব্রিটিশদের মধ্যে একজন পুলিশ ছিলেন যার তোলা ঘটনাস্থলের ছবিতে দেখা যায়, ফিলিস্তিনি মহিলারা নিহত স্বজনদের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করছে, তার পর সেগুলো একটা গর্তে কবর দেয়া হচ্ছে।

ফিলিস্তিনিদের বিদ্রোহের 'শাস্তি' : এটা ১৯৩০এর দশকের ঘটনা। তার দু'দশক আগেই অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে, ফিলিস্তিন তখন ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে। তখন ১৯৩৮ সালের হেমন্তকাল। ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনে এক বিদ্রোহ শুরু হয়। সেই সময় আল-বাসায় একটা ঘটনা ঘটলো। রাস্তার পাশে পেতে রাখা বোমায় চারজন ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হলো। কারা এই বোমার জন্য দায়ী - তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু স্থানীয় ব্রিটিশ কম্যান্ডার সেখানকার সবগুলো ফিলিস্তিনি গ্রামের বিরুদ্ধে 'শাস্তিমূলক' পদক্ষেপ নেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই ঘোষিত নীতির একটি অংশ ছিল আল-বাসার ওপর অভিযান।

সেই অভিযানে যে নৃশংসতা চলেছিল - তার বিস্তারিত বর্ণনা প্রকাশ পায় ব্রিটেন ফিলিস্তিন ত্যাগ করার কয়েক দশক পরে। সেই বর্ণনা দিয়েছেন সৈন্য এবং গ্রামবাসীরা। এসব তথ্যপ্রমাণ নিয়ে একটি ফাইল তৈরি হয়েছে, এবং তার ব্রিটিশ সরকারের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে। এর লক্ষ্য - ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগগুলোর জন্য যুক্তরাজ্যের সরকারকে জবাবদিহি করানো।

তিনশ' পাতার নথিপত্রসমৃদ্ধ এই আবেদনে বলা হচ্ছে, ১৯১৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসনের সময় যেসব নির্যাতন-নিপীড়ন ঘটেছিল, ব্রিটেনকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করতে এবং ক্ষমা চাইতে হবে। উল্লেখ্য সেই ১৯৪৮ সালেই ব্রিটেন ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় এবং সেখানে ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা ঘোষণা করা হয়। ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসনের সময়কার ঐতিহাসিক দলিলপত্র পরীক্ষা করে দেখেছে বিবিসি। এতে হত্যা, নির্যাতন, মানবঢাল হিসেবে ফিলিস্তিনিদের ব্যবহার, বহু লোককে একযোগে শাস্তি দেবার উপায় হিসেবে বাড়িঘর ভেঙে দেয়ার প্রবর্তন - ইত্যাদির প্রমাণ পাওয়া যায়।

এসব ঘটনার অনেকটাই ঘটেছিল ব্রিটিশ বাহিনীর তৎকালীন আনুষ্ঠানিক নীতিনির্দেশিকার আওতায়, অথবা উর্ধতন কর্মকর্তাদের অনুমোদনক্রমে। আল-বাসার হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া দু'জন ফিলিস্তিনির একজনের ছেলে ঈদ হাদ্দাদ্ । বিবিসিকে তিনি বলছেন, "আমি চাই যে আমার পিতামাতা তাদের তরুণ বয়সে যে দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন তার কথা লোকে জানুক। যারা সেসময় নিহত হয়েছিলেন, তাদের পক্ষ থেকেও এখন আমাদের কথা বলতে হবে।"

ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ওই সময়কালে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ব্যাপারে ওঠা ঐতিহাসিক অভিযোগগুলোর ব্যাপারে তারা সচেতন এবং এ ব্যাপারে কোন তথ্যপ্রমাণ দেয়া হলে তা বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করে দেখা হবে। ফিলিস্তিনিদের করা এই ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন তাকে আবার চাঙ্গা করে তুলতে পারে। তা ছাড়া এ বিষয়টিকে চলমান ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের প্রেক্ষাপটেও দেখা হচ্ছে।

ইতিহাসের ওই পর্বে ব্রিটেনের ভুমিকাকে দুই সম্প্রদায় দু'ভাবে দেখে থাকে। তবে ব্রিটিশ শাসনের ভিন্ন ভিন্ন কালপর্বে দুটি পক্ষই বৈরিতা, নিপীড়ন ও প্রতিশ্রুতিভঙ্গের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। একজন সুপরিচিত ফিলিস্তিনী ব্যবসায়ী ও সাবেক রাজনীতিবিদ হচ্ছেন মুনিব আল-মাসরি। তার বয়েস এখন ৮৮, তিনি থাকেন অধিকৃত পশ্চিম তীরের নাবলুস শহরে। কিশোর বয়সে, ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ সৈন্যদের গুলিতে তিনি আহত হয়েছিলেন। তিনি বলছেন, ব্রিটেনের ভূমিকা তার জীবনে অনেক প্রভাব ফেলেছে। "আমি দেখেছি, কীভাবে মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছে। তখন আমাদের কোন সুরক্ষা ছিলনা, আমাদের রক্ষা করারও কেউ ছিল না। "

আল-মাসরির অনুরোধে এই প্রকল্পের সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো স্বাধীনভাবে পর্যালোচনার জন্য দু'জন সিনিয়র আন্তর্জাতিক আইনজীবী এতে জড়িত হয়েছেন। এদের একজন হলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রধান কৌঁসুলি লুইস মোরেনো ওকাম্পো, আর ব্রিটিশ ব্যারিস্টার বেন এমারসন কেসি - যিনি মানবাধিকার ও সন্ত্রাসদমন বিষয়ে জাতিসংঘের একজন বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার।

এমারসন বলছেন, ব্রিটিশ বাহিনীর কিছু সদস্য পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর যেসব অপরাধ চালিয়েছে বলে তারা তথ্যপ্রমাণ পেয়েছেন - তা হতবাক করার মত। বিবিসিকে তিনি বলেন, "এগুলোর মধ্যে কিছু আছে যা এতই গুরুতর যে তা সেই সময়েও আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন বলে বিবেচিত হতে পারতো। এবছরের শেষ দিকে লন্ডনে যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে এই ফাইলটি উপস্থাপন করবেন আল-মাসরি। এই ফাইলে ১৯৩৯ সালের গ্রীষ্মকালে ঘটা আরো একটি নৃশংসতার উল্লেখ আছে।

পশ্চিমতীরের একটি গ্রাম হালহুলে সেবার এক অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালিয়েছিল ব্ল্যাকওয়াচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা। স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্রিটিশ সৈন্যদের বর্ণনায় দেখা যায়, কিভাবে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছিল এবং বন্দুকের মুখে গ্রামবাসীদের ধরে ধরে আনা হয়েছিল। এর পর প্রায় ১৫০ লোককে একটি মসজিদের পেছনের একটা জায়গায় জড়ো করা হয়। কিছু লোককে ঢোকানো হয় কাঁটাতারের তৈরি খাঁচায়। "এই লোকেরা ছিল কৃষক, তারা কোন বিপ্লবী ছিল না। বিপ্লবীরা লুকিয়ে ছিল পাহাড়ে" - বলছিলেন এ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদ আবু রায়ান। তার বয়স এখন ৮৮। ব্রিটিশ সৈন্যরা জোর করে তাদের বাড়িতে ঢুকে ছাদের ওপর অবস্থান নিয়েছিল।

হালহুল গ্রামের সেই খাঁচায় আটকানো হয়েছিল যাদের - তাদের অনেককেই চিনতেন আবু রায়ান। দু'সপ্তাহ ধরে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বন্দী অবস্থায় থাকার পর পানির অভাবে ১৩ জন মারা গিয়েছিল। পালাবার চেষ্টার সময় গুলি করা হয় অন্তত আরো একজনকে। হালহুলে গ্রামের বাড়িতে বসে আবু রায়ান বিবিসিকে বলছিলেন, "বন্দীদের অনেকে গাছের শিকড়বাকড় খাবার জন্য মাটি খুঁড়ছিল। অনেকে শরীর ঠান্ডা রাখাতে ভেজা মাটি গায়ে মাখাচ্ছিল।"

সেসময়কার একজন ব্রিটিশ কর্মকর্তা তৎকালীন জেলা কমিশনার এডওয়ার্ড কিথ-রোচ এক ব্যক্তিগত চিঠিতে অবশ্য মৃতের সংখ্যা কিছুটা কম বলে দেখান। তিনি লেখেন, "৪৮ ঘন্টা পর বেশির ভাগ লোকই অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে বৃদ্ধ ও দুর্বল ১১ জন মারা যায়। আমাকে নির্দেশ দেয়া হয় যে এ ঘটনার কোন বিচারবিভাগীয় তদন্ত করা হবে না।"

ব্ল্যাক ওয়াচ রেজিমেন্টের একজন সাবেক কর্মকর্তা লে. কর্নেল লর্ড ডগলাস গর্ডন এঘটনার এক ব্যতিক্রমী বর্ণনা দেন কয়েক দশক পর। তিনি বলেন, সেসময় 'ভালো খাঁচা' ও 'খারাপ খাঁচা' নামে দুটি আলাদা জায়গা ছিল। ভালো খাঁচায় ছিল তাঁবু এবং সার্বক্ষণিক পানির ব্যবস্থা। এর পাশেই ছিল খারাপ খাঁচাটি, যাতে কোন আশ্রয় ছিল না এবং সেখানে থাকা লোকদের দিনে মাত্র এক পাইন্ট পানি দেয়া হতো।

ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা : ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইনে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। রাজকীয় ব্রিটিশ বাহিনী অটোমান তুর্কী সৈন্যদের তাড়িয়ে দিয়ে ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার ব্যালফুর ১৯১৭ সালে জায়নিস্ট আন্দোলনের কাছে অঙ্গীকার করেন যে সেখানে ইহুদিদের জন্য একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করা হবে। ওই ঘোষণা পরে "ব্যালফুর ডিক্লারেশন" নামে পরিচিতি পায়।

যুক্তরাজ্যকে ওই অঞ্চলটি শাসনের ম্যান্ডেট দেয়া হয়। এ সময় ইহুদিদের অভিবাস এবং জমি অধিগ্রহণ বাড়তে দেয়া হয় - যার ফলে ফিলিস্তিনি আরবদের সাথে উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং প্রায়ই তা সহিংসতার রূপ নেয়। ফিলিস্তিনে তিন দশকব্যাপী ব্রিটিশ উপস্থিতির সময় তাদের নীতি ছিল বিশৃঙ্খল। ক্রমবর্ধমান সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আনতে সৈন্যরা হিমশিম খাচ্ছিল। এসব সহিংসতা যেমন ফিলিস্তিনি ও ইহুদিদের মধ্যে ঘটছিল তেমন উভয় জনগোষ্ঠীরই সশস্ত্র দলগুলো বিভিন্ন সময় ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাচ্ছিল।

'উগ্র ও চাঞ্চল্যকর' নৃশংসতা : ফিলিস্তিনে ১৯৩৬ সাল থেকে "অ্যারাব রেবেলিয়ন" (আরব বিদ্রোহ) নামে একটি বিদ্রোহী তৎপরতা শুরু হয়। এর জবাবে ব্রিটেন বিপুল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করে ওই অঞ্চলে। সামরিক ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ম্যাথিউ হিউজ একটি বই লিখেছেন কীভাবে ফিলিস্তিনে ব্রিটেন নিয়ন্ত্রণ কায়েম রেখেছিল - তা নিয়ে। বইটির নাম "ব্রিটেন'স পেসিফিকেশন অব প্যালেস্টাইন।

তিনি বলছেন, ফিলিস্তিনে ব্রিটেন যে নৃশংসতা চালায় তা ছিল "উগ্র এবং চাঞ্চল্যকর" ও ব্যতিক্রমী। তার মতে, এখানে তাদের বর্বরতার স্তর কিছু উপনিবেশে যেমনটা করা হতো ততটা ছিল না। হিউজ বলেন, সেসময় চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, কারফিউ, শাস্তি হিসেবে আটকাদেশ, বাড়িঘর বা শস্য বাজেয়াপ্ত করা এবং রাস্তাঘাট ও সামরিক ঘাঁটি নির্মাণকাজে জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করার মত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। "পুরো দেশটাই একটা কারাগারের মত জায়গায় পরিণত হয়েছিল" - বলছেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, যুক্তরাজ্যের যে সামরিক নীতি ছিল তার আওতায় সৈন্যরা "গোষ্ঠীগতভাবে শাস্তি দেবার" সুযোগ পেতো। এর আওতায় প্রায়ই দাঙ্গাকারীদের বাড়িঘর ভেঙে দেয়া হতো, আর ছিল "প্রতিশোধ নেয়া" এবং গুলি করা। সন্দেহভাজন কেউ যখন দৌড়ে পালাচ্ছে সেসময় তাদেরকে গুলি করার ঘটনাও সাধারণ ব্যাপার ছিল।

ব্রিটিশ সৈন্য ও পুলিশদের স্মৃতিচারণ : লন্ডনের ইম্পেরিয়াল ওয়ার মিউজিয়ামের আর্কাইভে ফিলিস্তিনে কাজ করা ব্রিটিশ সৈন্য ও পুলিশদের স্মৃতিচারণ আছে। রেকর্ড করা মৌখিক এসব বিবরণে 'শাস্তিমূলক' ঘেরাও, মানবঢাল হিসেবে ফিলিস্তিনিদের ব্যবহার এবং অত্যাচারের বিস্তারিত বিবরণ আছে। ম্যানচেস্টার রেজিমেন্টের একজন কর্মকর্তা ফ্রেড হাউব্রুককে তার স্মৃতিচারণে বলতে শোনা যাচ্ছে, তারা ফিলিস্তিনিদের গ্রামে গিয়ে কিছু বাড়িঘর ভেঙেচুরে দিতেন এবং এগুলোর বাসিন্দারা চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারতো না।

ওই রেজিমেন্টেরই আর্থার লেন নামে আরেকজন সৈন্য বর্ণনা করছেন, তারা কারাগার থেকে তিন থেকে পাঁচজন ফিলিস্তিনি বিদ্রোহী "ধার করতেন।" "তাদের গাড়ির বনেটের ওপর বসিয়ে দেয়া হতো, কাজেই পাহাড়ের ওপর থেকে (কোন ফিলিস্তিনি) দেখতো যে এই ট্রাকে একজন আরব বসে আছে, তাই সে এটাকে উড়িয়ে দেবার কথা ভাবতো না। আর বিদ্রোহীটির কপাল খারাপ হলে পিছন থেকে আসা ট্রাক হয়তো তাকে আঘাত করতো। কিন্তু তাদের কুড়িয়ে নেয়ার ঝামেলা কেউ করতো না। তাকে ফেলে রেখে যাওয়া হতো।"

এই সৈন্যটি বর্ণনা দেন - "রানিং দ্য গন্টলেট" নামে আরেকটি প্রথা ছিল। এতে দুই সারি ব্রিটিশ সৈন্যের মাঝখান দিয়ে ফিলিস্তিনি সন্দেহভাজনদেরকে দৌড়াতে বাধ্য করা হতো। সে সময় সৈন্যরা রাইফেলের বাঁট ও কুড়াল দিয়ে তাদের আঘাত করতো। "এর ফলে যে মারা যেতো, তাকে বাইরের কোন গ্রামে ফেলে দেয়া হতো।"

'নোংরা পন্থা' : ইসরাইলি ইতিহাসবিদ টম সেগেভ বলছেন, যুক্তরাজ্য শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনি আরব ও ইহুদি - উভয় গোষ্ঠীকেই নিয়ন্ত্রণের জন্য নোংরা পন্থার আশ্রয় নিয়েছিল। বিবিসিকে তিনি বলেন, ১৯৩৭ সালেই ব্রিটিশরা বুঝেছিল যে তাদের সেখান থেকে চলে যেতে হবে এবং আরব ও ইহুদিদের সংঘাতের কোন সমাধান সম্ভব নয়। সেগেভ বলেন, অনেক ইসরায়েলিই ব্যালফুর ঘোষণার জন্য কৃতজ্ঞ বোধ করে। তবে ১৯৪০এর দশক নাগাদ ব্রিটিশ ও ইহুদিবাদীদের মধ্যে উত্তেজনা খুবই বেড়ে গিয়েছিল এবং কিছু ইহুদি মনে করতো - ব্রিটিশরা তাদের সাথে প্রতারণা করছে।

জার্মানিতে নাৎসীদের ইহুদি নিধনযজ্ঞের পর বেঁচে যাওয়া যে লোকেরা ফিলিস্তিনে আসার চেষ্টা করছিল - তাদের জাহাজ ফিরিয়ে দেবার ঘটনাও ঘটিয়েছিল ব্রিটেন। "তারা ছিল কঠোর শাসক। তারা চেয়েছিল 'তোমরা শান্ত থাকো, তোমাদের সমস্যা নিয়ে আমাদের ভুগিও না। কে ঠিক, কে ভুল - তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না," বলেন সেগেভ,"এবং তারা খুবই খারাপ কর্মপদ্ধতি বাস্তবায়ন করেছিল।"

আল-মাসরি যুক্তি দিচ্ছেন, পরবর্তীকালে যে সংঘাত সৃষ্টি হয় তাতে ফিলিস্তিনিরা সম্পূর্ণরূপেই বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে। ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া কিছু জরুরি ক্ষমতা নতুন প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল রাষ্ট্রও কাজে লাগায়। "ব্রিটেনের উচিত ক্ষতিপূরণ দেবার পথ তৈরি করা, এবং সাহসের সাথে এটা বলা যে 'আমরা যা করেছি তার জন্য আমরা দুঃখিত,'" বলেন আল-মাসরি। সূত্র: বিবিসি।



 

Show all comments
  • Ehsan Elahi Jahir ১১ অক্টোবর, ২০২২, ১২:১৯ পিএম says : 0
    মর্মান্তিক! বৃটেনের বিচার দাবী করছি এবং জারজ রাষ্ট্র ইসরাইলের বিলুপ্তি কামনা করছি।
    Total Reply(0) Reply
  • হাসান করিম ১১ অক্টোবর, ২০২২, ১২:২৮ পিএম says : 0
    বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যে নারকীয় হত্যা যঙ্গ চালিয়ে আসছে তা নাৎসী হিটলার কেউ হার মানায় । আজ হোক কাল হোক এর দায় তোমাদের পরিশোধ করতেই হবে। এটা ইতিহাসের অলঙ্ঘনীয় নিয়ম। প্রস্তুত হোন বৃটেন বাসি।
    Total Reply(0) Reply
  • হাসান করিম ১১ অক্টোবর, ২০২২, ৪:২০ পিএম says : 0
    বৃটিশরা বিশ্বব্যাপী যে নিপীড়ন,নিরযাতন, লুন্ঠন ও হত্যাযঙ্গ চালিয়েছে তা নাৎসী দেরকেও হারমানিয়েছে। ক্ষমা চাইলেই কি হয়ে গেল? অপরাধের চরম মুল্য তাদের পরিশোধ করতে হবে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যুক্তরাজ্য


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ