Inqilab Logo

বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিবিসি ভিন্ন কায়দার রাজনীতি করছে, অভিযোগ জয়শঙ্করের

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৯:৩৯ এএম

গুজরাটের দাঙ্গায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা নিয়ে তৈরি বিবিসির তথ্যচিত্রটিকে নজিরবিহীন ভাষায় আক্রমণ করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, এটার টাইমিং মোটেও ‘অ্যাক্সিডেন্টাল নয়’ এবং এটা হলো ‘আরেকটা কায়দায় রাজনীতি করা’।

ভারতের বার্তা সংস্থা এএনআইয়ের সম্পাদক স্মিতা প্রকাশকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বিবিসির প্রতি ইঙ্গিত করে জয়শঙ্কর আরো বলেছেন, যাদের সরাসরি রাজনীতির ময়দানে নামার সাহস নেই, তারাই এভাবে এনজিও বা সংবাদমাধ্যমের আড়াল নিয়ে রাজনীতি করে থাকে।

গত মাসে যুক্তরাজ্যে বিবিসির ওই তথ্যচিত্রটির প্রথম পর্ব সম্প্রচারিত হওয়ার পরই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটিকে একটি ‘প্রচারধর্মী কাজ’ ও ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচায়ক’ বলে খারিজ করে দিয়েছিল।

তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে এখন যে ভাষা ও ভঙ্গী ব্যবহার করে সরাসরি বিবিসিকে আক্রমণ করেছেন, তা ভারতেও প্রায় অভূতপূর্ব।

গত সপ্তাহে বিবিসির দিল্লি ও মুম্বাই অফিসে ভারতের আয়কর দফতর যে ‘সার্ভে’ চালিয়েছে, তা নিয়ে কিন্তু জয়শঙ্কর কোনো মন্তব্য করেননি। বিষয়টি অবশ্য সরাসরি তার মন্ত্রণালয়ের অধীনেও পড়ে না।

এদিকে ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক এন রাম বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলে দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদির সমর্থক ও অনুগামীদের কাছে তার ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল করে তুলতেই বিবিসির দফতরে আয়কর হানা চালানো হয়েছে।

ভারতের প্রথম সারির সম্পাদকদের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তিগতভাবে এই বিষয়ে মন্তব্য করলেন, যদিও ভারতের এডিটর্স গিল্ডের পক্ষ থেকে এর আগে এই পদক্ষেপের নিন্দা করে সাংগঠনিকভাবে একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে মঙ্গলবার রাতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ওই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবিসির পাশে থাকার বার্তা দিয়ে বলেছে, তারা চায় বিবিসির সম্পাদকীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকুক।

ঠিক কী বলেছেন জয়শঙ্কর?
‘পডকাস্ট উইথ স্মিতা প্রকাশ’ অনুষ্ঠানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, একটা তথ্যচিত্রকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা কিংবা বিশেষ কোনো চ্যানেলকে ভারতে সম্প্রচার করতে না-দেয়া, এসব পদক্ষেপকে তিনি কতটা সমীচীন মনে করেন?

জবাবে জয়শঙ্কর বলেন, ‘একটা কথা আছে না, অন্য কায়দায় যুদ্ধ করা? এটাকে আমি বলব অন্য কায়দায় রাজনীতি করা। হঠাৎ করে কেন এই সব রিপোর্ট, মতামত, বক্তব্যের ধূম পড়ে গেল? এগুলো যে সামনেও আবার হবে না তাই বা কে বলতে পারে?’

‘আপনি একটা ডকুমেন্টারি বানাবেন? বেশ, ১৯৮৪তে দিল্লিতে তো অনেক কিছু ঘটেছিল। সেগুলো নিয়ে আমরা কেন কোনো ডকুমেন্টারি দেখছি না?’, প্রায় চার দশক আগেকার ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর শিখ-বিরোধী দাঙ্গার দিকে ইঙ্গিত করে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন তিনি।

বিবিসির ডকুমেন্টারি ঠিক এই সময় আসাটা যে নিছক সমাপতন বলে তিনি মনে করেন না, সেটাও স্পষ্ট করে দেন জয়শঙ্কর।

তার কথায়, ‘আপনি কি মনে করেন (এই তথ্যচিত্রের) টাইমিংটা নেহাতই অ্যাক্সিডেন্টাল? তাহলে একটা কথা বলি, ভারতে নির্বাচনী মরশুম শুরু হয়ে গেছে কি না বলতে পারবে না, লন্ডন বা নিউ ইয়র্কে কিন্তু সেটা নির্ঘাত শুরু হয়ে গেছে।’

নয়তো ২০ বছর আগেকার একটা ঘটনা এখন শুধু ‘সত্যের সন্ধান’ করতে তুলে আনা, এটা মোটেই বিশ্বাস্য নয় বলেও যুক্তি দেন জয়শঙ্কর।

দেশের বাইরে থেকে ভারতের একটা খুব চরমপন্থী ছবি তুলে ধরার একটা চেষ্টা বিগত এক দশক ধরেই চলছে বলে তিনি মন্তব্য করে বলেন, ‘ভারতের সরকার, ক্ষমতাসীন দল বিজেপি, প্রধানমন্ত্রী, সবাইকেই এভাবে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে।’

তার ভাষায় যারা এভাবে পর্দার আড়াল থেকে রাজনীতি করছে, তাদের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ‘এই লোকগুলোর আসলে রাজনীতিতে আসার সাহস নেই। নিজেদের এনজিও বা মিডিয়া সংস্থা বলে তারা একটা টেফলন আস্তরণে মোড়া থাকতে চাইছেন। কিন্তু আসলে তারা স্রেফ রাজনীতিই করছেন।’

ব্রিটিশ সরকার পার্লামেন্টে যা বলল
এদিকে ভারতে বিবিসির অফিসে আয়কর ‘সার্ভে’র পর ব্রিটিশ সরকার পার্লামেন্টে এ বিষয়ে তাদের প্রথম বিবৃতিতে এই ঐতিহ্যবাহী সংবাদ প্রতিষ্ঠানের পাশে থাকার জোরালো বার্তা দিয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার একজন জুনিয়র মিনিস্টার ডেভিড রাটলে মঙ্গলবার পার্লামেন্টে বলেছেন, আয়কর দফতরের ‘চলমান তদন্ত প্রক্রিয়া’ নিয়ে তারা কোনো মন্তব্য করবেন না। তবে ব্রিটেন মনে করে, মতপ্রকাশের অধিকার ও মিডিয়ার স্বাধীনতা যেকোনো ‘শক্তিশালী গণতন্ত্রে’র একটি অপরিহার্য অংশ।

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বিবিসির সাথে আছি। আমরা বিবিসির তহবিলের জোগান দিই। আমরা মনে করি, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই, বিবিসির সম্পাদকীয় স্বাধীনতা বজায় থাকুক।’

বিবিসি যে ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন টোরিদের, বিরোধী লেবার পার্টিরও সমালোচনা করে থাকে এবং তাদের এই অধিকার থাকাটা খুব জরুরি বলে সরকার মনে করে, সেটাও রাটলে সভায় মনে করিয়ে দেন।

রাটলে বলেন, ‘এই স্বাধীনতাটাই আসল জিনিস, আর এটার গুরুত্বটা সারা দুনিয়ায় আমরা আমাদের বন্ধুদেরও জানাতে চাই, যার মধ্যে ভারতের সরকারও আছে।’

এর আগে ওয়েস্টমিনস্টারে জরুরি প্রশ্নর আকারে এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন নদার্ন আয়ার্ল্যান্ডের এমপি জিম শ্যানন।

শ্যানন বলেন, ভারতের নেতার বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক একটি তথ্যচিত্র প্রচার করার পরই বিবিসিকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভয় দেখাতে সে দেশের কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে।

কেন ব্রিটিশ সরকার এখনো বিবিসির পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দেয়নি, ওই প্রশ্নেও সরকারকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেন তিনি।

আর এর পরই ফরেন, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) পার্লামেন্টারি আন্ডার সেক্রেটারি ডেভিড রাটলে হাউস অব কমন্সে ওই বিবৃতি দেন।

ভারতে মিডিয়ার প্রতিক্রিয়া
ভারতের জাতীয় স্তরের বেশির ভাগ দৈনিক বিবিসির বিরুদ্ধে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপের কড়া নিন্দা করে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে, যার মধ্যে দ্য হিন্দু, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বা দ্য টেলিগ্রাফের মতো বহু পত্রিকা রয়েছে।

তবে এখানে ব্যতিক্রম হল দিল্লি থেকে প্রকাশিত সবচেয়ে বড় দু’টো ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া ও হিন্দুস্তান টাইমস, তারা এখন পর্যন্ত তাদের সম্পাদকীয় কলামে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এই আয়কর সার্ভের ‘টাইমিং’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে মন্তব্য করেছে, ‘যেখানে প্রক্রিয়াটাই শাস্তির পদ্ধতি (প্রসেস ইজ পানিশমেন্ট) বলে দেখা হয়, এটা তারই প্রথম ধাপ বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।’

আয়কর নিয়ে কর্তৃপক্ষের তোলা প্রশ্নগুলোর জবাব বিবিসিকেই দিতে হবে, ওই কথা উল্লেখ করলেও সার্ভের পাশাপাশি বিজেপি মুখপত্ররা যেভাবে বিবিসিকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ ও ‘আবর্জনা’ বলে চিহ্নিত করছেন, তা পুরো প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে তারা মন্তব্য করেছে।

কলকাতা থেকে প্রকাশিত দ্য টেলিগ্রাফ লিখেছে, দেশে কারো কোনো রিপোর্ট অপছন্দ হলেই ওই মিডিয়া হাউসকে নিশানা করাটা সরকার অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে। কিন্তু এবারে তারা নিশানা করেছে যুক্তরাজ্যের পাবলিক ব্রডকাস্টারকে, যার জন্য ভারতীয় কূটনীতিকে ‘বিস্তর ঝড়ঝাপটা’ সামলাতে হতে পারে।

দ্য হিন্দু তাদের সম্পাদকীয় শুরুই করেছে এই মন্তব্য দিয়ে, ‘ব্রিটেনের জনপ্রিয় পাবলিক ব্রডকাস্টারের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দেয়ার জন্যই আয়কর দফতরের এই পদক্ষেপ।’

এদিকে দ্য হিন্দু পত্রিকা-গোষ্ঠীর কর্ণধার ও সাবেক প্রধান সম্পাদক এন রাম বলেছেন, ‘এই পদক্ষেপ আরো বেশি করে মোদির ভক্তদের একটা বার্তা দিতেই যে তিনি এতটাই শক্তিশালী যেকোনো ব্যক্তি বা কোনো সংস্থার সাথে টক্কর দিতেও তিনি পিছ পা নন।’

সাংবাদিক করণ থাপারকে দেয়া ওই সাক্ষাৎকারে এন রাম পাশাপাশি এ কথাও বলেছেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নরেন্দ্র মোদি সরকারের তুলনায় বিবিসির গ্রহণযোগ্যতা ‘অনেক বেশি’। সূত্র : বিবিসি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ