চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মহানবী (সা.)-এর সুদর্শন চেহারা থেকে ঠিকরে পড়ত নূরের জ্যোতি। তাঁর আলোতে চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠত। মুখমণ্ডল সবসময় হাস্যোজ্জ্বল থাকত। তাঁর চেহারা মোবারকে মুচকি হাসির রেখা ফুটে ওঠলে, নবীজির সান্নিধ্যে থাকা সৌভাগ্যধন্য সাহাবিদের চোখে- পৃথিবীর সব সৌন্দর্যকেও হার মানিয়ে দিত। পূর্ণিমার চাঁদও মলিন মনে হতো। আল্লাহ তাআলা বলেন. (হে নবী!) ‘আমি তোমাকে সৃষ্টি জগতের রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭)। সাহাবায়ে কেরাম স্বচক্ষে দেখে নবীজির জ্যোতির্ময় চেহারা মোবারকের সৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে যা বর্ণনা করেছেন, তার কিছু বিবরণ তুলে ধরছি। জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, ‘ আমি একবার পূর্ণিমা রাত্রির স্নিগ্ধ আলোতে রাসুল (সা.)-কে লাল চাদর ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় দেখলাম। তখন আমি একবার তাঁর দিকে ও একবার চাঁদের দিকে তাকাতে থাকলাম। মনে হল তিনি যেন পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে অধিকতর সুন্দর। (তিরমিযি : ২৮১১)। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসুল (সা.) প্রফুল্লচিত্তে গৃহে প্রবেশ করে বলতে লাগলেন, ‘হে আয়েশা! তুমি কি দেখনি, মুজাযযিয আল-মুদলিজী আমার ঘরে প্রবেশ করে উসামা ও যায়েদকে একটি চাদর মুড়ি দিয়ে তাদের মাথা ঢাকা ও পা বের করা অবস্থায় দেখতে পেল। সে বলল, এই পাগুলোর কতক অপর কতক থেকে। (বুখারি : ২৩৪৯)।
হজরত কাব (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) আনন্দিত হলে তাঁর চেহারা মোবারক চাঁদের টুকরার মতো আলোকিত হয়ে যেতো। আমরা রাসুল (সা.)-কে সবসময় এমনই দেখতে পেতাম। (বুখারি : ৪৪১৮)। আয়েশা (রা.) তাঁর নির্দোষিত প্রমাণের আয়াত অবতীর্ণ হওয়া সম্পর্কে বলেন, ‘আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর আমি তাঁর (নবীজির) কাছে আসি। তিনি মাথা ওঠালেন। তাঁর চেহারায় খুশির আভাস দেখতে পেলাম। তিনি নিজ কপালে হাত বুলিয়ে বলেছেন- ‘হে আয়েশা! সুসংবাদ গ্রহণ কর। আল্লাহ তোমার নির্দোষ হওয়ার ব্যাপার আয়াত অবতীর্ণ করেছেন।’ (বুখারি : ৪১৪১, মুসলিম : ২৭৭০)।
রাসুল (সা.) ইন্তেকালের পূর্বে কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। কয়েক ওয়াক্ত নামাজ- জামাতে শরিক হতে পারেন নি। তাঁরই নির্দেশে মসজিদে নববিতে আবু বকর (রা.) নামাজ পড়াতেন। আনাস (রা.) রাসুল (সা.)-এর জীবনের অন্তিম মুহূর্তের বিবরণ তুলে ধরে বলেন, ‘রাসুল (সা.) হুযরার পর্দা সরিয়ে সাহাবায়ে কেরামের দিকে তাকালেন। তাদের নামাজরত দেখে স্মিত হাসলেন। তাঁর চেহারাকে বইয়ের সাদা কাগজের মত চকচকে মনে হল (বুখারি : ২৮০, মুসলিম : ৪১৯) নবীজিকে আল্লাহ যে শ্রদ্ধাভীতি দান করেছেন, এর সাথে হাসিটাও ছিল সামঞ্জস্য পূর্ণ।
আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-কে কখনও এমনভাবে হাসতে দেখি নি যে, তার মুখের ভিতরের আলজিহ্বা দেখা যায়। বরং সবসময় মুচকি হাসতেন। (বুখারি : ৬০৯২)। সাহাবায়ে কেরাম জাহেলি যুগের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতেন, রাসুল (সা.) এগুলো শুনে মৃদ হাসতেন। কখনও চুপ থাকতেন। ইবনুল কায়্যুম (রহ.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) মাঝে-সাঝে মুচকি হাসতেন বিষয়টি এমন না। বরং সবসময় মুচকি হাসি দিতেন। সর্বোচ্চ এতটুকু হতোÑ দুই পাশের দাঁতগুলো ভেসে উঠত। তিনি হাসির সময় হাসতেন আশ্চর্যের মুহূর্তে আশ্চর্য হতেন। লক্ষণীয় বিষয় হল, ‘তিনি কখনও অট্টহাসি দিতেন না। হাসি-কান্না মানুষের স্বভাবসম্মত বিষয়। মানবতত্ত্বের একটি নিগূঢ় রহস্য। আত্মা ও শরীরের সমন্বয়ে গঠিত এ দেহে কিভাবে প্রাকাশ পায় কেউ জানে না। আত্মিক ও দৈহিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। কান্না-হাসি এগুলোও আল্লাহর দেওয়া, বান্দার মনের অবস্থা প্রকাশ করার মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনিই হাসান ও কাঁদান।’ (সুরা নাজম : ৪৩)।
অনেক সময় মানুষ কারণ ছাড়া অহেতুক হাস্য-রসিকতায় মেতে ওঠে, যা অনুচিত। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘তোমরা অধিক হেসো না। কেননা তা অন্তরকে নিষ্প্রাণ করে দেয়।’ (তিরমিযি : ২৩০৫)। রাসুল (সা.) সবসময় মানুষের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল চেহারা এবং উদার মন নিয়ে কথা বলতেন। যার ফলে প্রত্যেক সাহাবি মনে করতেন, নবীজির কাছে আমিই সবচেয়ে প্রিয়। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.)-এর অনুপম আদর্শের কিছু নুমুনা সাহাবাদের বর্ণনা থেকে পায়া যায়। আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস (রা.) বলেন, ‘আমি কাউকে রাসুল (সা.)-এর চেয়ে বেশি মৃদ হাসতে দেখিনি। (তিরমিযি : ৩৭২১)।
আবু যর (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) আমাকে বলেছেন, ‘কোনো সৎকাজকে ক্ষুদ্র মনে করো না। যদিও তা তোমার ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে সাক্ষাতের দ্বারা হয় (মুসলিম : ২৬২৬)। জাবের (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সকল নেক কাজ সদকা। তোমর ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাও একটি নেক কাজ। (তিরমিযি : ১৯৭০)। আবু যর (রা.) থেকে আরেক বর্ণনায় এসেছে, ‘তোমার ভাইয়ের সামনে তোমার হাসিও সদকা (তিরমিযি : ১৯৭০)।
মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করলে সদকার সওয়াব পাওয়া যায়। ‘সদকা’ অর্থাৎ দান, যার বিনিময়ে আল্লাহ আখেরাতে পুরস্কৃত করবেন। নবীজির হাসিমুখে কথা বলার এ আদর্শ অনুসরণ করলে, প্রতিটি মানুষের জীবন হবে অনেক সুন্দর হবে। সবসময় অন্তরে প্রশান্তি অনুভব হবে। মন ভালো থাকবে। চেহারায় প্রফুল্লতা ফুটে ওঠবে। শরীর মন দু’টোই সতেজ থাকবে। সমাজ জীবনে সব শ্রেণীর মানুষের সাথে সম্পর্কের সেতুবন্ধন গড়ে ওঠবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।