Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিনিয়োগে বাধা দূর করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের শ্লথ গতি অন্তরায় হয়ে রয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই বিনিয়োগে মন্দাভাব বিরাজ করছে। বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে, ২০২১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে যে স্বতঃস্ফূর্ত বিনিয়োগ এবং ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি প্রয়োজন, তা কাক্সিক্ষত মানের নয়। এ কথায়ই উঠে এসেছে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ও ইইউর মধ্যকার দ্বিতীয় বিজনেস ক্লাইমেট সংলাপ শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে। সংবাদ সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পাঁচটি ইস্যুকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছে। পাঁচটি বাধা হচ্ছে: স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, সহজীকরণ, সহযোগিতা, বাস্তবায়ন এবং বৈষম্য। ইইউর রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইইউ মনে করে, ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো, বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি না হওয়া। তিনি বলেন, শুধু রফতানি দিয়েই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য অর্জিত হবে না। এর পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং আমদানি দুটোই বাড়াতে হবে।
দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দাভাব নিয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে এবং মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধির কথাও বলা হয়েছে। বাস্তবত এর সার্বিক সুফল সাধারণ মানুষ পুরোপুরি ভোগ করতে পারছে না। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে তাকালে সেখানে ব্যবসায়ীদের করুণ মুখ দেখতে হয়। বড় বড় শিল্প-কারখানার মালিকরা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানি খাত গার্মেন্ট শিল্প বেশ কয়েক বছর ধরেই ধুঁকছে। এ খাতে শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। এ খাতে নতুন বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। উল্টো দেশের বিনিয়োগ পরিবেশের সমস্যা ও অনিশ্চয়তার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান বিদেশে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলছে। অন্যান্য খাতে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নতুন কারখানা গড়ে তোলা হলেও গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে মালিকরা সেসব কারখানা চালু করতে পারছে না। বিনিয়োগকারিরা উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়া, নিরাপত্তাহীনতা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কায়ও হাতগুটিয়ে নিয়েছেন। কেউ কেউ অর্থ বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। আমদানির নামে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার বৃদ্ধিও বিনিয়োগ পরিস্থিতির মন্দাভাব নির্দেশ করে। দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ অনুকূল হলে এটি হওয়ার কথা নয়। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা একটি বড় সমস্যা হয়ে রয়েছে। বিনিয়োগকারীকে প্রতি পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। এত সমস্যা মোকাবেলা করে বিনিয়োগকারীর পক্ষে আগ্রহ ধরে রাখা কঠিন। স্বাভাবিকভাবেই তারা বিনিয়োগ না করে অর্থ অন্যত্র সরিয়ে নেবে, না হয় ব্যাংকে ফেলে রাখবে। এর ফলে যা হয়েছে, ব্যাংকগুলো ব্যাপক তারল্য সংকটে পড়েছে। আমানতকৃত অর্থের বোঝা বইতে না পেরে আমানতকারীদের সুদের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে উল্টো তাদের লোকসান গুণতে হচ্ছে। এক হিসেবে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলোতে এক লাখ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। বিনিয়োগ পরিবেশ যদি উন্নত হতো, তবে ব্যাংকগুলোকে এই তারল্য সংকটে পড়তে হতো না। এমনকি শিল্পখাতে ঋণের সুদ আঠার পার্সেন্ট থেকে প্রায় দশ পার্সেন্ট করেও উদ্যোক্তাদের উৎসাহী করে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোতে আমানতকারীদের সুদের হার কমিয়ে দেয়ায়, তারা এখন বেশি সুদ পাওয়ার আশায় সঞ্চয়পত্র কেনার দিকে ঝুঁকেছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি কি! পরিস্থিতি যদি গতিশীল হতো, তবে ব্যাংকগুলোতে ঋণ প্রদানের প্রবাহ যেমন বৃদ্ধি পেতো, তেমনি কর্মচাঞ্চল্যও সৃষ্টি হতো। নির্বিঘœ ও নিরাপত্তামূলক পরিবেশের নিশ্চয়তা বিনিয়োগের অন্যতম পূর্বশর্ত হলেও, দেশে এর ঘাটতি রয়েছে। বড় বড় প্রকল্পে জাপানের বিনিয়োগ এবং তাদের কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকলেও নিরাপত্তার অভাবে অনেকে দেশে গিয়ে ফিরতে চাচ্ছেন না। এতে প্রকল্পগুলোর কাজে ব্যঘাত ঘটছে। এই কয়েক দিন আগে অস্ট্রেলিয়া নতুন করে বাংলাদেশে তার নাগরিকদের চলাচলে সতর্কতা জারি করেছে। এসবই বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক সংকেত দিচ্ছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে সমুদ্র বন্দরের ব্যবহার প্রধানতম মাধ্যম হলেও এতে প্রায়শই নানা সমস্যা দেখা দেয়। রপ্তানি কার্যক্রম দ্রুত করতে যে মসৃণ সেবা প্রয়োজন তা যথাযথভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। বলা বাহুল্য, সরকার তার নিজ স্বার্থে বিনিয়োগের খরার কথা স্বীকার করবে না। তবে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন এবং অর্থনীতির নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখেন, তারা ভাল করেই জানেন, দেশে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। আগামী পাঁচ বছরে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত এবং প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ অর্জন করতে হলে বিনিয়োগের এই দৈন্যদশা কাটিয়ে উঠতেই হবে।
টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের গতি বৃদ্ধির বিকল্প নেই। পিয়েরে মায়দুন যথার্থই বলেছেন, কেবল রপ্তানি বাণিজ্য দিয়ে উন্নতি করা বা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ এবং তার মাধ্যমে উৎপাদন কার্যক্রম গতিশীল করতে হবে। দেশে বিগত কয়েক বছর ধরে আক্ষরিক অর্থে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম নেই। এটা ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য খুবই ইতিবাচক। তারপরও কেন বিনিয়োগ গতিশীল হচ্ছে না, তা বোধকরি ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। রাজনৈতিক পরিবেশ আপাত স্থিতিশীল মনে হলেও যে কোনো মুহূর্তে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। এই আশঙ্কা বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বড় ভয়। এ ভয় দূর করা সরকারের দায়িত্ব। এছাড়া ইইউ যে পাঁচ সমস্যার কথা বলেছে, সেগুলোও বিবেচনায় নেয়া উচিত। একই সঙ্গে দেশে সুশাসনের ভিত শক্ত করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। অনুমোদন থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের কার্যক্রম সহজীকরণ ও সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করতে হবে। তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থের নিরাপত্তা দিতে গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগসহ অবকাঠামো সুবিধা দিতে হবে। সর্বোপরি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার আশঙ্কা রয়েছে, তা দূরীকরণে উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি স্বাবলীল ও যৌক্তিকতার মধ্যে না থাকে, তবে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন