Inqilab Logo

বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৬ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

চরম আতঙ্কে উপকুলীয় জনগোষ্ঠী

নাজুক বেড়িবাঁধ : নদীভাঙন অব্যাহত

জাহাঙ্গীর কবীর মৃধা, বরগুনা থেকে : | প্রকাশের সময় : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০১ এএম

 উপক‚লীয় জেলা বরগুনার পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর ভাঙ্গন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এসব নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে বসতবাড়ি, গাছপালা ও ফসলী জমি বিলীন হয়ে যাবার আত আতঙ্কে রয়েছে জেলাবাসী।
বরগুনা জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২২টি পোল্ডারের ৩৭ পয়েন্টে ১৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। জেলার সাড়ে ৯০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, মহাসেনসহ একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এ বাঁধ সম্পূর্ণ মেরামত হতে না হতেই ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে একাধিক স্থানের বাঁধ ভেঙে গেছে।
পাউবো সূত্রে জানা যায়, বরগুনা জেলায় ২২টি পোল্ডারে প্রায় সাড়ে ৯০০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে ৩৭টি পয়েন্টে ১৮ কিলোমিটার বাঁধ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া বাকি যেসব বাঁধ রয়েছে, সেখানেও পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে।
এগুলোর মধ্যে বরগুনার পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদের তীব্র ভাঙনে বরগুনা সদর উপজেলার ছোট বালিয়াতলী, নলটোনা, লাকুরতলা, ডালভাঙ্গা, আঙ্গারপাড়া, জাঙ্গালিয়া, পাতাকাটা, গুধিঘাটা, গুলিশাখালী, চালিতাতলী, নলী, পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া, চরলাঠিমারা, রুহিতা, জিনতলা, পদ্মা, বামনা উপজেলার রামনা, শফিপুর, চেচাং, শিংড়াবুনিয়া, বড় তালেশ্বর, আমতলী উপজেলার পশরবুনিয়া, পশ্চিম ঘটখালী, পূর্বচিলা, বেতাগী উপজেলার বলইবুনিয়া, দেশান্তরকাঠী, ঝোপখালী, তালতলী উপজেলার তেতুলবাড়িয়া এবং নিশানবাড়িয়া এলাকার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এসব এলাকায় তীব্র ভাঙনে হারিয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি, ফসলি জমিসহ অসংখ্য গাছপালা।
আড়পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের আব্দুল খালেক হাওলাদার বলেন, পায়রা নদীর ভাঙনে ওই এলাকার শত শত ঘর-বাড়ি ও হাজার হাজার একর ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। নদীর পাড়ের এসব মানুষকে রক্ষা করতে ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ৮শ’ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে মাত্র ৩শ’ কিলোমিটার বাঁধের সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, বাকী ৫শ’ কিলোমিটার বাঁধের সংস্কার করা খুবই জরুরী হয়ে পড়ছে। প্রতিবছর এপ্রিল-আগষ্ট মাসে উপক‚লে জোয়ারের উচ্চতা অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় বেড়ে যায়। ভরা পূর্ণিমায় জোয়ারের এ উচ্চতা স্বাভাবিকের তুলনায় ৭-১০ ফুট বেড়ে যায়। ভরা অমাবশ্যা বা পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করেই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় উপক‚লে আঘাত হানে। এসকল ঝড়ের প্রভাবে উপক‚লীয় এলাকার নদ-নদীসহ সাগর হয়ে পড়ে চরম উত্তাল। তখন ঝড়ের প্রভাবে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ¡াসের আশঙ্কা থাকে প্রবল।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বরগুনা জেলায় ৮০৫ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার পরও নানা কারণে জেলার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ বাঁধের উচ্চতা বাড়েনি। জেলার প্রায় ৫০০ কিলোমিটার বাঁধের উচ্চতা ১৩ ফুটের একটু বেশি। অন্যদিকে পূর্ণিমার জোয়ার ও জলোচ্ছ¡াস মিলিয়ে ১৫ থেকে ১৮ ফুট উচ্চতায় নদ-নদীর পানি প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা করার পাশাপাশি প্লাবিতও হয়ে থাকে।
বরগুনা সদর উপজেলার আজগরকাঠি গ্রামের শাহনেওয়াজ সেলিম দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ‘ঝড়-বন্যার সময় কর্তৃপক্ষের বাঁধ নির্মাণে টনক নড়ে। এসব থেমে গেলে তাদের আর খবর থাকে না। বর্ষা মৌসুম আসলেই বাঁধ নির্মাণ করার জন্য আসেন তারা। যার কারণে বাঁধের স্থায়িত্ব থাকে না।’
এ বিষয়ে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তÍতি কর্মসূচির (সিপিপি) বরগুনা সদর উপজেলার টিম লিডার মো. জাকির হোসেন মিরাজ বলেন, ‘জেলার নদী তীরবর্তী বিভিন্ন স্থানে ৪-৫ ফুট উচ্চতারও বেড়িবাঁধ রয়েছে। এছাড়াও সিডর, আইলা, মহাসেন ও ইয়াসে যেসব বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাও পুরোপুরি মেরামত করা হয়নি। একারণেই বরগুনার মানুষ জলোচ্ছ¡াসে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
পায়রা নদীর করাল গ্রাসে প্রায় ৬০০ মিটার এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রবল স্রোতে বেড়ীবাধ দ্রæত ভেঙ্গে যাচ্ছে। গত বছর জিও ব্যাগ দিয়ে সাময়িক ভাবে তুলাতলা এলাকায় ভাঙ্গন রোধ করা গেলেও এবার বর্ষার শুরুতে ওই এলাকা আবার ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। পায়রা নদীর তীরবর্তী রামরা ও তুলাতলা এলাকায় প্রায় শতাধিক দোকান রয়েছে। অধিকাংশ দোকান মালিকরা তাদের দোকার সরিয়ে নিয়েছেন। কিছু দোকান নদী গর্ভে চলে গেছে। ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রবল স্রোতে রামরা তুলাতলা এলাকার প্রায় ৬০-৭০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তখন পায়নি কোন সরকারী সহায়তা। ওই ব্যবসায়ীরা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতে আবারও ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নূরুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ‘জেলায় ১৩ ফুট বা তার একটু বেশি উচ্চতার প্রায় ৫০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। নানা কারণে এসব বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। তাই আমাদের শঙ্কা অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে যদি ১৩ ফুটের অধিক উচ্চতায় নদ-নদীর পানি প্রবাহিত হয়, তাহলে এই সকল বাঁধ প্লাবিত হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘কোনো এলাকার বা কোনো স্থানের বাঁধ প্লাবিত বা ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করলে ওই এলাকা পুরোপরি নিমজ্জিত হবে না। কারণ বরগুনা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর নির্মাণের ফলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পানি প্রবাহের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই যে এলাকায় পানি প্রবেশ করবে, ওই এলাকায়ই পানি আবদ্ধ থাকবে।’
স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শমভু বলেন, ভাঙনকবলিত এলাকার ভাঙ্গন ঠেকাতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। কনক্রিটের বøক নির্মাণ করে নদী শাসন করার কাজ প্রক্রিয়াধীন।

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ