Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অরক্ষিত লাখ লাখ মানুষ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও খাবার পানির তীব্র সঙ্কট

আইলার ৯ বছরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা উপকূলবাসীর

| প্রকাশের সময় : ২৫ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আবু হেনা মুক্তি ও আক্তারুজ্জামান বাচ্চু : কোন প্রকার বাস্তবমুখী নতুন প্রকল্প প্রণয়ন কিম্বা উপকূলের বসবাসরত প্রায় ৪ হাজার পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেই নিরবে নিভৃতে কেটে গেল আইলার ৯টি বছর। এখনো খুলনার কয়রা, দাকোপ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও বাগেরহাটের শরনখোলা, মংলার শত শত পরিবার গৃহহীন। সরকারের কাবিখা, ভিজিডি, ভিজিএফ ও একশো দিনের কর্মসূচী বিভিন্ন সময়ে বাস্তবায়িত হলেও বিভিন্ন জনপদে এখনো চলছে অন্ন, বস্ত্র,বাসস্থান ও খাবার পানির জন্য তীব্র সঙ্কট সর্বগ্রাসী আইলা আজো উপকুলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত হাজার, হাজার মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে।এছাড়া পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে রয়ে গেছে শুভঙ্করের ফাঁকি।
জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৫ মে প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড় আইলার তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়েছিল খুলনার কয়রা উপজেলাসহ গোটা দক্ষিণ উপকূলের বিস্তিন্ন জনপদ। আইলার জলোচ্ছসের তান্ডবে উপকূলের শতাধীক মানুষের প্রানহানিসহ বিলিন হয়েছিল ঘরবাড়ী রাস্তাঘাট দালানকোটাসহ সব কিছু। ক্ষণিকের মধ্যে গৃহহীন হয়ে পড়ে লাখো পরিবার । লক্ষ লক্ষ হেক্টর চিংড়ি আর ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যায়। ধ্বংস হয়ে যায় উপকুল রক্ষা বাঁধ আর অসংখ্য ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শতশত বছরের পুরান জনপদগুলির কোন চিহ্নই ছিলনা। আইলার ৯ বছর অতিবাহিত হলেও আজও অরিক্ষিত উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। বাস্তবায়ন হয়নি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রæতি। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মোকাবেলা করে ঘুরে দাড়ানোর মনোবল আর প্রাণশক্তি উপকূলীয়লের মানুষের সহজাত প্রবণতা। মা মাটি প্রকৃতি যেমন সবকিছু উজাড় করে মানুষকে সহায় করেছে তেমনি প্রকৃতির রুদ্র রোষেও ক্ষতবিক্ষত হতে হয় নিমেষেই। তবু শত বাঁধা বিপত্তি প্রতিকূলতার মাঝেও লোনা হাওয়ার মানুষগুলো বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন দেখে। সিডরের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই গত ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলায় লন্ডভন্ড করে দেয় গোটা উপকূলীয় অঞ্চল। গত ৯ বছরে অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে নিজের ঘরে মাথা গোজার ঠাই করেছে কয়েক লাখ পরিবার। অবশ্য এখনো মানুষের দুর্দশার শেষ নেই। দু‘মুঠো ভাতের জন্য জীবনের সাথে রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে তাদের। আইলার পর থেকে এসব এলাকায় সুপেয় পানির সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। খাবার পানির জন্য ছুটতে হচ্ছে মাইলের পর মাইল। আইলা কবলিত এ অঞ্চলের রাস্তাঘাট, উপকুলীয় বেড়িবাধ এখনও ঠিকমত সংস্কার হয়নি। ফলে উচ্চ বিত্ত থেকে শুরু করে নিম্মবিত্ত সবাই চালাচ্ছে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। আইলার আঘাতের পর থেকে বিভিন্ন এলাকা উদ্ভিদ শূন্য হয়ে পড়ে। কৃষি ফসল ও চিংড়ি উৎপাদন বন্ধ থাকায় গোটা এলাকাজুড়ে তীব্র কর্মসংস্থানের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কর্মহীন মানুষ অনেকেই এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে বাইরে চলে গেছে। অপরদিকে, বনদস্যুদের অত্যাচারে সুন্দরবন, কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর উপর নির্ভরশীল এ এলাকার মানুষের জীবন যাপন দূর্বিসহ হয়ে পড়েছে। ফলে বিকল্প কর্মসং¯’া‡নর †কান ব্যব¯’া না থাকায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছেননা উপকুলীয় এ জনপদের প্রায় ৮০ হাজার মানুষ।
এদিকে, অধিকাংশ বাঁধ মেরামত হলেও বেশকিছু বাঁধ এতোদিনেও পাউবো আটকাতে পারেনি। তবে সরকার আইলার মানুষের পাশে থেকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরনা জুগিয়েছে, করেছে সংগ্রামী। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সুদীর্ঘ বেদনা বিধুর অধ্যায় আইলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জীবন থেকে ৯ বছর কেড়ে নিলেও সংগ্রাম মুখর জীবনের অধিকারী কালজয়ী এসকল উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ শত প্রতিকুলতার মাঝেও ঘুরে দাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। দুর্যোগে ক্ষতবিক্ষত মানুষগুলোর জীবনে যেন ভোরের সোনালী সূর্য উকি দিচ্ছে। উন্নয়ন বঞ্চিত বৃহত্তর খুলনার মানুষের শেষ ভরসাস্থল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদন্যতায় সরকার আইলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কয়েক দফায় শতর্ধো কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। আইলা দুর্গত এলাকার উন্নয়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬শ কোটি টাকার যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল তা এখন শেষের দিকে।
সূত্রমতে, কয়রা উপজেলায় আইলার সময় গুরুত্বপূর্ণ ২৭টি পয়েন্টে ভেড়ী বাঁধ ভেঙে গোটা কয়রার পানির নিচে তলিয়ে যায়। বর্তমানে সব কয়টি বাঁধ আটকানো হয়েছে। তবে আটকানো বাঁধগুলো এখনো দুর্বল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যে প্রতিশ্রæতি ছিল সে অনুযায়ী বাধের উচ্চতা হয়নি। যে কারণে প্রতি অমাবশ্যা পূর্ণিমার গোনে বিভিন্ন পয়েন্টর ভেড়ীবাধের উপর দিয়ে জোয়ারের পানি উপছে পড়ায় এলাকাবাসী আতংকে দিন কাটাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে ভেড়ীবাঁধ ভাঙা শুরু হয়েছে। এছাড়া চিংড়ি ঘের করার কারণে সহস্রাধিক জায়গায় ভেড়ীবাঁধ ফুটো করায় তা মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যা অবিলম্বে সংস্কার না করা হলে যে কোন মুহূর্তে অঘটন ঘটতে পারে। অপরদিকে দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ২০ হাজার মানুষ এখনো ভিটে ছাড়া। গোটা ইউনিয়নটি এখনো বিরানভূমি রয়েছে। কোন রাস্তাঘাট নেই। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। খোলা মাঠে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।
আইলায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা স্থায়ী এবং সদূর প্রসারী। ১০ লাখ মানুষের মধ্যে এখনো সবাইকে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি। অবর্ননীয় কষ্টে রয়েছে তারা। কিছু কিছু গ্রামে এখনো প্রতিদিন জোয়ার ভাটা হচ্ছে। আইলা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা দেখলে এখনো মানুষ আতকে ওঠে। মনে হবে এখানে কোন বসতি ছিল না। নতুন সভ্যতার জন্ম হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেয়া দুর্গত মানুষ আর ত্রাণের দিকে চেয়ে থাকতে চায় না। তারা নিজ বাড়িঘরে আবার ঘর গৃহস্থালী করতে চায়। মাথা উচু করে এ লড়াইয়ে জিততে চায়। কারন উপক‚লীয় অঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করেই বেঁচে আছে।
সূত্রমতে, আজ থেকে ৯ বছর আগে দক্ষিণ উপকূলবাসীর জন্য এই দিনটি ছিল অভিশপ্ত। এ দিনটির কথা মনে করলে ভয়ে শিউরে ওঠে উপকূলবাসী। স্বজন হারানোদের মনে করিয়ে দেয় তাদের প্রিয়জনের কথা, কবর দেওয়ার জায়গা অভাবে অনেকের লাশ শিয়াল কুকুরে ছিড়ে খেয়েছে। কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে দুর্যোগের সাথে লড়াই করে টিকে থাকলেও এখনো পর্যন্ত সেই ক্ষতি পুষিয়ে উপকূল এলাকায় গড়ে উঠেনি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যাবস্থা। প্রতিবছর মে মাস এলে উপকূলের লাখ লাখ মানুষ আতঙ্কে থাকে কোন রকম জোড়া তালি দেয়া পাউবোর বেড়ি বাঁধের অবস্থা এতই নাজুক যেন তেন দুর্যোগ এলেই বাঁধ ঘেঙে আবারও বিপদ ঘটাতে পারে। নেই বেড়িবাঁধ, নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার। মানুষ নিরাপদ আশ্রয়স্থলে ছুটে যাওয়ার নেই কোন ব্যাবস্থা। ৯ বছরেও বাস্তবায়ীত হয়নি প্রধান মন্ত্রীর প্রতিশ্রæতি নির্মান হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ। আইলা পরবর্তী কয়রা সফরে এসে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন প্রতিশ্রæতির মধ্যে অন্যতম উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মান করে বাধের পার্শে গাছ লাগিয়ে সবুজবেষ্টনী গোড়ে তোলা কিন্ত ৯বছর পার হলেও টেকসই বাাঁধ নির্মান হয়নি। বিগত ৯ বছরে পাউবোর বরাদ্দ কৃত অর্থের সিংহ ভাগ লুটপাট হয়েছে কতিপয় পাউবো কর্মকর্তার সাথে সখ্যতা করে ৪/৫ জনের একটি চক্র কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প তৈরি করে প্রক্কলীত ব্যায় কয়েক গুন বেশি দেখিয়ে বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাট করেই চলেছে। ফলে উপকূলীয় এলাকাটিতে টেকসই বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হচ্ছেনা। এলাকাবাসীর মনে দুর্যোগ আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। ঘুর্নিঝড় আইলার ৯ বছর অতিবাহিত হলেও উপজেলার ১৩০ কিঃমিঃ পাউবোর ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ, ¯øুইজ গেট নির্মাণ-পুননির্মাণ, বাঁধের উচ্চতা বৃদ্ধির কাজ সম্পন্ন হয়নি। স্থানীয় গ্রামীন অবকাঠামো সোজা হয়ে দাড়াতে পারেনি এখানেও বরাদ্দকৃত অর্থের সিংহ ভাগ লোপাট অব্যাহত রয়েছে। অধিকাংশ স্থানে খাবারপানির তীব্র সঙ্কট রয়েই গেছে। স্যানিটেশন ব্যাবস্থার উন্নতি হলেও জনবল সঙ্কট, দুর্নীতি ও নানা কারনে সাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ ১৮০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংষ্কার কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। সংষ্কার ও রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্র ঝুকিপুর্ণ হয়ে পড়েছে। এসব কেন্দ্রে মানুষের বসবাস কিম্বা আশ্রয় গ্রহন নিরাপদ নয় বলে জানিয়েছেন এলাকার মানুষ। নির্মাণাধীন আশ্রয় কেন্দ্রগুলিতে চলছে ব্যাপক দুর্নীতি তাছাড়া নির্মানাধীন আশ্রয় কেন্দ্র গুলি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত না হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে এলাকাবাসী। অতিসত্তর আইলা কবলীত এই এলাকায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ-পুননির্মাণ, সংষ্কার ও উপকূলীয় অরক্ষিত বেড়িবাঁধ দ্রæত মেরামত করে ও পাউবোর বাঁধ থেকে অবৈধ পাইপ গেট তুলে দিয়ে উপকূলবাসীকে দুর্যোগের ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসী।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ