বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রেল যাবে কক্সবাজার। জোরেশোরে চলছে কক্সবাজার অংশের জমি অধিগ্রহণের কাজ। এপ্রিল ২০১৭ থেকে কাজ শুরু হয়ে ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে দোহাজারী থেকে পর্যটন নগরী কক্সবাজার রেললাইন সম্প্রসারণের কাজ। বস্তুত রেলের উন্নয়ন মানে রাষ্ট্রের উন্নয়ন, রাষ্ট্রের মানুষের উন্নয়ন। দেশের ৫০ শতাংশ মানুষ বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে। এই দরিদ্র মানুষগুলোর যোগাযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়, যা সম্ভব রেলের মাধ্যমেই। তাছাড়া পরিবহনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে কিছু সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়, যা রেলওয়ে ছাড়া আর কোন মাধ্যমে এত সহজে করা সম্ভব নয়। যেমন রেলওয়েকে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্য এবং যাত্রীকে অতি স্বল্পমূল্যে পরিবহনে সাহায্য করতে হয়। অনেক সময় লাভজনক নয় এমন লাইন চালু রাখতে হয় দেশের জনগণের যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করতে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোনসহ যে কোন দুর্যোগ কবলিত এলাকার মানুষদের সাহায্যার্থে ত্রাণ ও পুনর্বাসন সামগ্রী নামমাত্র মূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হয়। কাজেই রেলের উন্নয়ন মানে রাষ্ট্রের উন্নয়ন, রাষ্ট্রের নাগরিকদের উন্নয়ন।
তবে অত্যন্ত আনন্দের খবর হলো, ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটয়ার্কের সাথে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রাম ও পর্যটন নগরী কক্সবাজারের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশে রাখবে যুগান্তকারী ভূমিকা। দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুনধুম প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এর নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হবে ভারত থেকে বাংলাদেশ হয়ে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও কোরিয়া হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত। প্রকল্পের আওতায় তিন বছরের মধ্যেই চালু হচ্ছে ঢাকা-কক্সবাজার রেল যোগাযোগ।
চট্টগ্রাম-দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমার রেল প্রকল্পটির একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। ১৮৮০ সালে মিয়ানমার রেলওয়ে চট্টগ্রাম হতে রামু ও কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের জন্য সার্ভে করেছিল। সে পরিপেক্ষিতে ১৯০৮ সালে থেকে ১৯০৯ সালের মধ্যে মিয়ানমার রেলওয়ে আরও বিশদ সার্ভে পরিচালনা করে। চট্টগ্রামের সঙ্গে আকিয়াবের (মিয়ানমার) রেল যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে দোহাজারী হতে রামু হয়ে আকিয়াব পর্যন্ত ১৯১৭ সাল থেকে ১৯১৯ সালে পুনরায় সার্ভে করা হয়। সে মোতাবেক চট্টগ্রাম হতে দোহাজারী পর্যন্ত মিটার গেজ রেললাইন স্থাপন করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কক্সবাজার হতে রামু পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি।
১৯৫৮ সালে পূর্ববাংলা রেলওয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের জন্য সার্ভে পরিচালনা করে। এর উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম হতে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলওয়ে সংযোগ স্থাপন করা। জাপান রেলওয়ে টেকনিক্যাল সার্ভিস (জেআরটিএস) ১৯৯১ সালে রেলওয়ে লাইনটি ট্রাফিক সম্ভাবনা যাচাইয়ের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে (জেআরটি ১৯৭৬-৭৭ সালে ডাটা সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করে। ১৯৯২ সালে ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য পেসেফিক কমিশন অধিবেশনে সম্মতিপ্রাপ্ত এশিয়ান ল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলাপমেন্ট নামের প্রকল্পের আওতায় ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের তিনটি ইউরো-এশিয়ার সংযোগ বোর্ডের মধ্যে সাউদার্ন করিডর অন্যতম রুট। এ বিবেচনায় সর্বশেষ-দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মিয়ানমারের কাছে ঘুনধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন মিটার গেজ নির্মাণের জন্য এক হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প ২০১০ সালের ৬ জুলাই অনুমোদন দেয় একনেক। কিন্তু পরবর্তীতে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা না পাওয়ায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন আটকে ছিল। এ অবস্থায় ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর একনেক বৈঠকে সিঙ্গেল লাইন ট্র্যাককে মিটার গেজের পরিবর্তে ডুয়েল গেজ ট্র্যাককে নির্মাণের নির্দেশনা দেয়া হয়।
সে অনুযায়ী প্রকল্পটি সংশোধন করে ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত এবং রামু হতে মিয়ানমারের নিকটবর্তী ঘুনধুম পর্যন্ত মোট ১২৯ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণের মাধ্যমে পর্যটন নগরী কক্সবাজার সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের যোগাযোগ স্থাপনসহ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, নতুন এ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত থাকছে ৯টি রেল স্টেশন। সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকোরিয়া, ডুলাহাজরা, রামু ঈদগা হয়ে কক্সবাজার। রেল স্টেশনগুলোর ডিজাইন করা হয়েছে সেখানকার প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের উপর ভিত্তি করে। এর মধ্যে কক্সবাজার রেল স্টেশনটির ডিজাইন করা হয়েছে সমুদ্রের ঝিনুক আদলে। আরও আনন্দেও খবর হলো, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন যাবে কখনও পাহাড় ঘেঁষে, কখনও গভীর জঙ্গলের পাশ দিয়ে। ফলে ট্রেনের যাত্রীরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ট্রেনে ভ্রমণ করবেন।
তবে এসব সম্ভাবনা বাস্তবরূপ দিতে প্রয়োজন রেলের জন্য নতুন বগি ও ইঞ্জিন আমদানি করা। জানা যায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ২৭০টি নতুন রেলবগি আনা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ইন্দোনেশিয়া থেকে ১৫টি বগি এসে পৌঁছেছে। কিন্তু সমস্যা হলো ইঞ্জিন বাড়ছে না। তবে ইঞ্জিন আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আসতে দুই থেকে তিন বছর সময় লেগে যেতে পারে। এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইঞ্জিনের সংকটের কারণে রেলের কোনো বিভাগেই কাক্সিক্ষত সংখ্যায় ট্রেন চলাচল করছে না। রেলের পূর্বাঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় ৫০টি ইঞ্জিনের ঘাটতি রয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলে ঘাটতি ২০-২৫টি। যার কারণে রেলের সময়সূচিতে ঘটছে ব্যাঘাত। রেলের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে ২৯৪টি ইঞ্জিন রয়েছে। এরমধ্যে ২৭০টি চালানো হচ্ছে। অর্ধেকের বেশি ইঞ্জিনের মেয়াদকাল শেষ হয়ে গেছে। সাধারণত ইঞ্জিনের মেয়াদকাল ২০ বছর। কিন্তু রেল বহরে ৫৫-৬০ বছরের পুরনো ইঞ্জিনও আছে। মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাওয়ায় অনেক ইঞ্জিন মেরামতের জন্য দীর্ঘসময় কারখানায় ফেলে রাখতে হয়। ফলে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে রেলের ৩৪০টি ট্রেনের এক-তৃতীয়াংশই ঠিকমত সময়সূচি মেনে চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে ৭০টি ইঞ্জিন আমদানি করা হবে। পূর্বাঞ্চলীয় রেলে এখন দিনে গড়ে ৪৯টি ইঞ্জিনের ঘাটতি রয়েছে। ৩০টি বিকল ইঞ্জিন কারখানায় পড়ে আছে। রেলে তিন বছর ধরে ইঞ্জিনের সংকট চলছে। বগি এর আগেও আনা হয়েছে। ২০০৮ সালে চীন থেকে ৮০টি বগি আনা হয়। পূর্বাঞ্চল রেলের জন্য আরো ৭০টি মিটারগেজ বগি আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলের জন্য ২০১৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১১টি ইঞ্জিন আমদানি করা হয়েছিল। এরপর আর ইঞ্জিন আনা হয়নি। সূত্র আরও জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটসহ বিভিন্ন রুটে ৫টি ট্রেন বাড়াতে চায় রেলওয়ে। এসব ট্রেন হবে ১৫ বগির। নতুন বগি আসার পর এগুলো চালু করা হবে।
আমাদের সীমিত সম্পদ, জনসংখার আধিক্য, নিম্ন আয় ও কৃষিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থায় রেলের গুরুত্ব ব্যাপক। যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করতে, বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, পণ্য পরিবহনে, অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের ব্যাপক প্রসার এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে রেলকে আধুনিকায়ন অত্যন্ত জরুরি। শিল্পায়ন, নগরায়ন, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও এ দেশের আর্থসামাজিক অচলায়তনের ধারা ভেঙে পুঁজি ও শিল্পনির্ভর সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণে রেলওয়ে পালন করেছে অভূতপূর্ব ভূমিকা। অর্থাৎ পুরো সমাজ জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে রেলপথের সুবাদেই। কাজেই রেলকে আধুনিকায়নের বিকল্প নেই।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।