পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলায় নদীভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গঙ্গা, পদ্মা ও যমুনা অববাহিকা অঞ্চলে ভাঙন তীব্র হয়ে উঠছে। এতে সড়ক, জনপদ, হাটবাজার, কৃষিজমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসা, বসতভিটাসহ স্থাবর সম্পদ ও ঐতিহ্য নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য বছরের মতো এ বছর উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে নদীভাঙন কম হলেও ঝুঁকি কমেনি বলে নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআই এস)Ñএর এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ বছর উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১২ জেলার ১৮০০ হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হতে পারে। এতে ফসলি জমির পাশাপাশি ঘরবাড়ি হারাতে পারে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ। এবার যমুনার ১৪টি, গঙ্গার ৭টি ও পদ্মার ১টি স্থানে ভাঙন বেশি হতে পারে। নদী অববাহিকায় যেসব জেলায় ভাঙন তীব্র হতে পারে সেগুলো হচ্ছে, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, রাজবাড়ি, ফরিদপুর ও মাদারীপুর। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাঙন রোধে আজও টেকসই বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হয়নি। সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব এবং অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে নদী রক্ষায় যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়, সেগুলো কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙ্গে যায়। প্রতি বছরই বাঁধ ভাঙে, আবার তা মেরামত করা হয়। এতে বিপুল অর্থের অপচয় হচ্ছে।
নদীভাঙন দেশে নতুন কিছু নয়। বছরের পর বছর ধরেই নদী ভাঙছে। লাখ লাখ মানুষ সম্পদ ও বসতভিটা হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। অসংখ্য সম্পদশালী পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। ফসলি জমি ও স্থাপনা নদীগর্ভে হারিয়ে কী অপরিসীম অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, তার সঠিক কোনো হিসাব নেই। শুধু নদীভাঙনই নয়, গত কয়েক দশক ধরেই কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের ভাঙন তীব্র হয়ে উঠেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বালিভর্তি বড় বড় জিও ব্যাগ দিয়েও ভাঙন ঠেকাতে পারছে না। সমুদ্র সৈকত ভাঙার পেছনে জলবায়ুর পরিবর্তন যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ। সৈকতের কাছে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে সৈকতে ব্যাপক ভাঙন ধরেছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। ইনকিলাবের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত কয়েক বছরে সমুদ্র সৈকতের ডায়বেটিক হাসপাতাল পয়েন্ট থেকে হিমছড়ি পয়েন্ট পর্যন্ত অন্তত ৩০টি পয়েন্টে শক্তিশালী ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে ড্রেজিংয়ের স্থানে বড় গর্ত হয়ে সৈকতের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় ভাঙন বেড়েছে। ২০০০ সালের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষণাকারি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পরিদর্শন করে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, আগামী ৪০ বছরে সাগর ভূ-ভাগের অনেক ভেতরে চলে আসবে। তাদের এ আশঙ্কার আলামত পরিদৃষ্ট হয়ে উঠেছে। বিগত বছরগুলোতে সৈকতের নাজিরারটেক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পয়েন্ট হয়ে মেরিনড্রাইভের বেলি হ্যাচারি পর্যন্ত এক কিলোমিটার সৈকত সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। সৈকতের প্রাকৃতিক জৈব সুরক্ষা নষ্ট, যথেচ্ছ ড্রেজিং এবং অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন ও স্থাপনা নির্মাণ সৈকতের ভাঙন তরান্বিত করছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। একদিকে অপরিকল্পিত ড্রেজিং, অন্যদিকে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে যতই জিও ব্যাগ দিয়ে প্রতিরক্ষা বুহ্য তৈরি করা হোক না কেন, তাতে ভাঙন ঠেকানো যাবে না। নদীভাঙনের ক্ষেত্রে বন্যা ও নাব্যসংকট অন্যতম কারণ হলেও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন ভাঙনকে ভায়াবহ দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ড্রেজিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। যেমন খুশি তেমনভাবে বালু উত্তোলন করায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় গভীর গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় ভারসাম্য নষ্ট হয়ে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এমনকি এই ভাঙন সংশ্লিষ্ট এলাকা ছাড়িয়ে দূরবর্তী এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতি ও উদাসীনতার কারণে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ বাবদ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, ভাঙন রোধে আজও টেকসই বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে নদীর তীর রক্ষায় ও বিভিন্ন স্থানে বাঁধ নির্মাণে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়, সে অনুপাতে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব এবং অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে নদী রক্ষায় যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়, সেগুলো কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে যায়। এতে যেমন জনগণের বিপুল অর্থের অপচয় ও লুটপাট হচ্ছে, তেমনি তাদের সম্পদও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শুধু বন্যা, নাব্যসংকট ও অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারণে যে ভাঙন হয় তা নয়, অসংখ্য ডিপটিউবওয়েলের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভ ফাঁপা হয়ে ভূমিধ্বসে ভাঙন সৃষ্টি হয়। অনেক সময় ভূমিচ্যুতি ঘটে ভূমিকম্পের শঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। ভাঙন ও ভূমিধ্বসের এসব কারণ দেশে ব্যাপকহারে বিদ্যমান। উল্লেখ্য, বিশ্বের ১০টি সার্বোচ্চ নদী ভাঙনপ্রবণ দেশের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া শীর্ষ সারিতে রয়েছে। বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে দেশটির রাজধানী জাকার্তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। দেশটির জাভা অঞ্চলে ভাঙনের কারণে মোট জিডিপি’র শতকরা ২ ভাগ ক্ষতি হয়। ঢাকার অদূরে মুন্সিগঞ্জে যে ভাঙনের প্রবণতা তাতে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর প্রভাব রাজধানীতে পড়তে খুব বেশি সময় লাগবে না। সুনামির প্রভাব যেমন দূরবর্তী এলাকায় গিয়ে পড়ে, তেমনি মুন্সিগঞ্জের ভাঙন প্রবণতা একসময় ঢাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে।
বন্যা ও মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ের কারণে বছরের পর বছর ধরে সমুদ্র সৈকত ও নদীভঙন যেভাবে তীব্র আকার ধারণ করেছে, তা অব্যাহত থাকলে দেশের ভূখÐের মানচিত্র বদলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। নদীভাঙনে প্রতিবছর সম্পদ বিনষ্ট ও মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার মধ্য দিয়ে যে ক্ষতি সাধিত হয়, তা অপূরণীয়। সরকার জিডিপি’র আকার বৃদ্ধির হিসাব করলেও নদীভাঙনে জিডিপি’র কত ক্ষতি হয়, তার যথাযথ হিসাব করে বলে প্রতীয়মান হয় না। বছরের পর বছর নদীতীর ও সমুদ্র সৈকত রক্ষা বাঁধ নির্মাণে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও লক্ষ-কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা হচ্ছে না। উভয়ক্ষেত্রেই বিপুল আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। অপরিকল্পনা ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে অর্থনীতির এই ক্ষতি সরকারকে আমলে নিতে হবে। নদীর যেসব এলাকায় ড্রেজিংয়ের অনুমতি দেয়া হয়, সেসব এলাকায় পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং করা হচ্ছে কিনা এবং তার প্রভাব ও ভাঙনের শঙ্কা কতটা, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিরুপণ করে অনুমোদন দিতে হবে। প্রয়োজনে ড্রেজিং স্থলে ট্র্যাকিং ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে সঠিকভাবে ড্রেজিং করা হচ্ছে কিনা তা শনাক্ত করা যায়। নদীশাসনের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। নদী ও সৈকত ভাঙন রোধে বছরের পর বছর লাখ লাখ কোটি টাকা ব্যয় হবে, অথচ মানুষের সম্পদ রক্ষা হবে না, তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। নদীভাঙন রোধে টেকসই বাঁধ ও প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।