পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সারাবিশ্বে প্লাস্টিক পণ্য এক বিশাল সমস্যা। বাংলাদেশের জন্য সমস্যাটি আরও প্রকট ও ভয়াবহ। এর কারণ প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারে মানুষের অসচেতনতা। যাচ্ছে তাইভাবে প্লাস্টিক ব্যবহার করছে। চারপাশ প্লাস্টিক বর্জ্যে সয়লাব। প্লাস্টিক ব্যবহার ও এর বর্জ্য দেশের পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত ১৫ বছরে দেশের নগরগুলোতে এর ব্যবহার তিনগুণ বেড়েছে। ২০০৫ সালে ঢাকার বাইরে অন্যান্য নগরে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল ৩ কেজি, ২০২০ সালে সেটি হয়েছে ৯ কেজি। ঢাকা শহরে ৯ কেজি থেকে বেড়ে প্রায় ২৩ কেজি হয়েছে। দেশে সারাবছর যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়, তার ১০ শতাংশ প্লাস্টিক পণ্য থেকে আসে। এর ৪৮ শতাংশ মাটিতে পড়ে, ৩৭ শতাংশ পুনরায় ব্যবহৃত হয়। ১২ শতাংশ পড়ে খাল ও নদীতে, ৩ শতাংশ নালাতে গিয়ে মেশে। মাটিতে পড়া প্লাস্টিকের বড় অংশ পলিথিন ব্যাগ, পণ্যের মোড়ক ও প্যাকেট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই প্লাস্টিকের প্রায় অর্ধেক মাটি ও পানিতে থেকে যায়। তৈরি করে মারাত্মক দূষণ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। শুধু তাই নয়, দেশের নদ-নদী, খাল-বিল ও নালায় গিয়ে এসব প্লাস্টিক জমা হয়ে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। এতে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। এক গবেষণায় ২০২১ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনার একটি কর্মপরিকল্পনার সারসংক্ষেপও তুলে ধরা হয়। এই সময়ের মধ্যে প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনা, প্লাস্টিক বর্জ্য ৩০ শতাংশ কমানো এবং ২০২৬ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার ৫০ শতাংশে উত্তীর্ণ করার কথা বলা হয়েছে।
পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার পরও শুধু রাজধানীতেই প্লাস্টিক বর্জ্য বেড়েছে তিন গুণের বেশি, যা খুবই উদ্বেগজনক। অথচ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার কিংবা পলিথিনের বিকল্প তৈরিতে কোনো উদ্যোগ নেই। নগরবাসীর অসচেতনতার কারণে প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে। সরকার পলিথিনের পরিবর্তে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের কথা বললেও, দেশের পাটকলগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ পাটের ব্যাগ ব্যবহারে উৎসাহ হারাচ্ছে। দেখা গেছে, রাজধানীর খাল-নর্দমা পরিষ্কার করে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় প্লাস্টিকের বোতল। এ কারণে, বর্ষা এলেই রাজধানীজুড়ে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ব্যবহারের পর প্লাস্টিকবর্জ্য বিভিন্ন জলাশয়ে ও যত্রতত্র ফেলে দেওয়ায় পরবর্তী সময়ে তা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ছে। সেখান থেকে জলজ প্রাণী তা গ্রহণ করছে। এসব প্রাণীর মাধ্যমে তা আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। ফলে তা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে। প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে সামুদ্রিক পরিবেশ মারাতœকভাবে বিপন্ন হচ্ছে, মৎস্যসহ অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সমুদ্রে বিচরণকারী কোন কোন পাখির পাকস্থলির ৮০% জায়গা প্লাস্টিক বর্জ্যে দখল করে থাকে। এগুলো হজম হয় না, যার ফলে পাখিগুলো না খেতে পেরে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়।
সাধারণত প্লাস্টিক পঁচতে ১৫ থেকে ১০০০ বছর লাগতে পারে। সূর্যের আলোর মাধ্যমে প্লাস্টিক ব্যাগ বা সামগ্রী ভেঙ্গে ছোট ছোট কণায় পরিণত হয়। প্লাস্টিকের কণাগুলো সমুদ্রে ভাসমান বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে এক একটা বিষাক্ত পিলে পরিণত হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সমুদ্রের এই ক্ষুদ্র ভাসমান প্লাস্টিক কণাগুলো পরিবেশের তুলনায় ১০০০ গুণ বেশি বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ শোষণ করে থাকে। গবেষণা অনুযায়ী, সমুদ্রে এক পাউন্ড প্লাঙ্কটনের বিপরীতে ছয় পাউন্ড প্লাস্টিক বর্জ্য বিদ্যমান।
প্লাস্টিকে থ্যালেট নামক কেমিক্যাল পদার্থ থাকে যা প্লাস্টিকের নমনীয়তায় সাহায্য করে। এই থ্যালেটগুলো প্লাস্টিক সামগ্রী থেকে খাদ্যে বা পানিতে মিশে যায়। থ্যালেট সিন্থেটিক ইস্ট্রোজেন হিসেবেও কাজ করে। থ্যালেটের কারণে প্রাণীর শরীরে হরমোনের ভারসম্য নষ্ট হয়ে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস বা লোপ পায়। সিন্থেটিক ইস্ট্রোজেন পুরুষ মাছ বা প্রাণীকে স্ত্রী মাছে বা প্রাণীতে রূপান্তরিত করতে পারে। এর ফলে কোন প্রজাতির সেক্সের অনুপাত বিনষ্ট হয়ে ঐ প্রজাতির মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটতে পারে। শংকার বিষয় হচ্ছে, এই ক্ষতিকর থ্যালেটের ব্যবহার ব্যাপক। প্যাকেজিং সামগ্রী থেকে শুরু করে ফার্মাসিউটিক্যাল, খেলনা, গাড়ির পার্টস, কসমেটিক্স, ডিটারজেন্ট, পেইন্ট, ইলেক্ট্রিক্যাল সামগ্রীসহ যত্রতত্রভাবে থ্যালেট ব্যবহার করা হচ্ছে। প্ল্যাস্টিক সামগ্রীতে বিসফেনল নামক অত্যন্ত ক্ষতিকর প্লাস্টিসাইজারও থাকে, যা সিন্থেটিক ইস্ট্রোজেন হিসেবে কাজ করে। এটি ক্যান্সার-এর কারণ হতে পারে এবং প্রজনন ক্ষমতাও নষ্ট করে দিতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে জানা গেছে। কানাডার সরকার ইতোমধ্যে বিসফেনলের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
শুধুমাত্র প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে প্রতি বছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী মারা যাচ্ছে। পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকে আছে সামুদ্রিক সিস্টেমের কারণে। খাদ্য ও অক্সিজেন সরবরাহের মাধ্যমে সমুদ্র পৃথিবীর প্রাণীকুলের অস্তিত্ব রক্ষা করে। আমাদের অবহেলা ও দাযয়িত্বহীনতার কারণে সামুদ্রিক পরিবেশ বিপন্ন হতে চলেছে। পরিবেশ দূষণের এই দায়ভার আমাদেরকেই বহন করতে হবে। এজন্য ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য আমাদেরকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।
আইন করে ২০০২ সালে প্লাস্টিক জাতীয় পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে তাহলে ১০ বছরের কারাদÐ বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা এমনকি উভয় দÐ হতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ২,৮৯৭টি অভিযান চালানো হয়েছে। জরিমানার পাশাপাশি পলিথিন ব্যবহারের কারণে ৯১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে বিনাশ্রম কারাদÐ দেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় ১২০০ কারখানায় নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন ২ কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রাজধানীতে ২০০৫ সালে প্রতিদিন গড়ে ১৭৮ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হতো, সেখানে ২০২০ সালের হিসাব দাঁড়িয়েছে ৬৪৬ টনে। এই বর্জ্য নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা প্রভৃতি ভরাট করে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে এবং সামান্য বৃষ্টিতেই পানিবদ্ধতা সৃষ্টি করছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু মানুষই নয়, সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্যও প্লাস্টিক বর্জ্য ডেকে আনে ভয়ংকর বিপদ। সামুদ্রিক কচ্ছপ এইসব বর্জ্য খেলে তাকে সাগর পাড়ে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। বাহ্যিক দিক দিয়ে কোন আঘাতের চিহ্ন থাকে না। ময়না তদন্ত দেখা যায় এর কারণ প্লাস্টিক। কচ্ছপকে বলা যায় সুবিধাবাদী জীব। হাঁ করে যা সামনে পায়, সব কিছুই গিলে ফেলে। সমুদ্রের আবর্জনাও কচ্ছপ গিলে ফেলে এবং এক পর্যায়ে হজম করতে না পেরে দ্রæত মারা যায়।
বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট জার্নালের এক গবেষণায় বলা হয়, দেশের পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে ৮৭ শতাংশই পরিবেশবান্ধব সঠিক ব্যবস্থাপনায় নির্মূল করা হচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, অনেক দেশে এক মাসেও সে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য হয় না। অন্যদিকে, বাংলাদেশে যেখানে জৈব বর্জ্য বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ, সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্যরে বৃদ্ধির হার সাড়ে ৭ শতাংশ। দেশের ৬১ শতাংশ মানুষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছে। এসব তথ্য ও পরিসংখ্যান নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। আমরা নিজেরাই খাদ্যচক্রে বিষ সংক্রমিত করছি, পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছি অথচ সবাই নির্বিকার। এর চেয়ে সর্বনাশা ঘটনা আর কি হতে পারে?
বিশ্বব্যাংকের এক হিসাব বলছে, প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষ দশে। ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর এগুলোর ৮০ শতাংশ মাটিতেই ফেলা হচ্ছে। সেগুলোর ঠাঁই হচ্ছে নালা—খাল-–নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে। নদী হয়ে সাগরে যাওয়া প্লাস্টিক ও পলিথিন–দূষণে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ষষ্ঠ স্থানে। জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়সহ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণা বলছে, ঢাকা মহানগর প্লাস্টিক ও পলিথিনের বোমার ওপর বসে আছে। এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বড় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
ক্ষতিকারক জেনেও মানুষের মধ্যে দিনদিন পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার এবং অব্যবস্থাপনার হার ক্রমেই বাড়ছে। দামে সস্তা ও ব্যবহারে সহজলভ্যতার কারণে পলিথিন ব্যবহার কমছে না। এ অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি। পলিথিনের বিকল্প পাট বা পচনশীল ব্যাগ ব্যবহার বাড়াতে হবে। প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণ ঠেকাতে পলিথিনের বিকল্প ব্যবহার এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করা অপরিহার্য। একইসাথে বিপন্ন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মানুষের মধ্যে সচেতনতাও জরুরি।
লেখক: ব্যাংকার ও কলাম লেখক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।