পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নদ-নদী আমাদের দেশের জন্য প্রকৃতির অপার দান। অথচ যথাযথ যতেœর অভাব ও অবহেলায় ও প্রয়োজনীয় নদী শাসনের অভাবে শত শত নদ-নদী ক্রমেই শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। বর্তমানে যথাযথ নদী শাসনের অভাবে নদীপথের পানির প্রবাহ যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি নদী ভরাট হয়ে বর্ষাকালে ভয়াবহ নদীভাঙন পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে নদীর দুই পাড়ের আবাদি জমি ও বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নদীপাড়ের মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে ভূমিহীন হয়ে নিঃস্ব ও হতদরিদ্র হচ্ছে। আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দেশে বন্যা, জলোচ্ছ¡াস, সাইক্লোনের প্রকোপ বাড়ছে। এতে বসতভিটাসহ জীবজন্তু মারা যাচ্ছে, আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে। কৃষির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। কৃষিখাত হচ্ছে বিপর্যস্ত। প্রতিবছর অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত বন্যা, খরা, জলোচ্ছ¡াস ও নদী ভাঙনের কারণে সরকারের যে পরিমাণ অর্থ ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যয় করছে, সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে যদি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে নদ-নদীর নাব্য বজায় রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়, তবে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাওয়া যাবে। সরকারের অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি অবাদি জমির ভাঙন রোধ, হতদরিদ্রের সংখ্যা কমিয়ে আনাসহ নদীর স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে দেশের কৃষিখাতের সার্বিক উন্নয়ন, আমদানিকৃত সেচের জন্য ডিজেলের চাহিদারোধসহ দেশের পরিবেশ ও সার্বিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।
পার্শ্ববর্তী ভারত কৃষিকাজে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বন্যার পানি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ, নদী শাসন ও অধিক খাল-বিল খননের প্রকল্প হাতে নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে পানি সংকট মোকাবিলা করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আমাদের দেশে মৃত নদীগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে এখন পর্যন্ত কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এর ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য এ খাতে কার্যকর পদক্ষেপ ও বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া জরুরি। দীর্ঘদিন ধরে নদ-নদীর সঠিক পরিচর্যা, নীতি নির্ধারকদের উদাসীনতা, প্রয়োজনীয় উপকরণের স্বল্পতা, প্রতিবেশী দেশের সাথে ন্যায্য পানি বন্টন চুক্তির সফল বাস্তবায়ন ও নদ-নদীর আগ্রাসন বন্ধ না হওয়ায় নদ-নদী শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে।
গবেষকদের মতে, নদীভাঙন রোধের জন্য কখনোই ড্রেজিংই একমাত্র সমাধান নয়। ড্রেজিং পদ্ধতি অনেক ব্যয়বহুল, যা সরকারের পক্ষে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে, নদীগুলো বছরের যে পরিমাণ পলি ধারণ করে সেখানে ড্রেজিং পদ্ধতি কার্যকর নয়। আমাদের নদীর চরিত্র বুঝতে হবে। সব নদীর চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য এক রকম নয়। কোনো নদী বেশি পলি ধারণ করে, আবার কোনোটা কম। কোনটা বেশি খর¯্রােতা, কোনটা একই গতিতে চলে। দেশের বড় নদীগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পলি ধারণ করা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলি ধারণ করে পদ্মা, যমুনা ও তিস্তা। নদীর এই বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিয়ে নাব্য ধরে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য নদীশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিপুল পরিমাণ পলি ধারণ করার কারণে তার পাড় ভাঙে। তাই আমাদের নদীশাসনের প্রধান কাজ হওয়া উচিত নদীর পাড় সংরক্ষণ করা। পাড় বাঁধা। সেই পাড় বাঁধাও নদীর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী করতে হবে। যে দিকটা বেশি ভাঙছে সে দিকটাকে বেশি শক্ত ও মজবুত করতে হবে। লোকালয় থেকে স্বাভাবিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং সর্বোপরি সেই কাজের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ড্রেজিং পদ্ধতি তখনই ব্যবহার করা উচিৎ, যখন নদীর গতিপথ পরিবর্তন করতে হবে। হয়তো এখানে নদী লোকালয়ে ঢুকে যাচ্ছে বা এখানে চরটাকে অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা প্রয়োজন। সে সময় নদীর তলদেশ খনন করে নদীর মোড় বদলানো যেতে পারে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তাই করা হয়। আমাদের নদীগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, শাসন করার জন্য নদীর পাড় বাঁধতে হবে এ কারণে যে, যাতে সে তার নিজস্ব আচরণ অব্যাহত রাখতে পারে। পলি ধারণ করে যেন পানিপ্রবাহ সচল রাখতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিবছর অনেক পরিকল্পনা করলেও তার বাস্তবায়ন খুব কম দেখা যায়। বন্যা হলে তোড়জোর শুরু হয় যা বাস্তবে কোন সুফল বয়ে আনে না। নদী সংরক্ষণে এটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা, তাদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে কাজ করলে তারাও বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা পায়। তখন জরুরি মুহূর্তে সেবা দিতে পারে। সংশ্লিষ্টদের এই বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন কৃষি ও জাতীয় অর্থনীতিতে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যথাযথ পরিচর্যা, নদীখনন, পানিদূষণ ও উপযুক্ত নদী শাসনের অভাবে অধিকাংশ নদ-নদী মৃতপ্রায়, যা কৃষিসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নদীর পানি অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের উপরের পানি না থাকার কারণে কৃষিকাজে সেচ প্রদানের জন্য গভীর নলক‚পে ব্যাপক ডিজেল ব্যবহার করা হচ্ছে। ডিজেলের আমদানি নির্ভরশীলতা কমিয়ে নদ-নদীর পানি কৃষিকাজে অধিক ব্যবহার করতে পারলে কৃষিখাতে জ্বালানি ভর্তুকি কিছুটা হলেও কমত। কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় অনেকটা কম হতো। আমদানিকৃত ডিজেলে অধিক ভর্তুকিও কমত।
অপরিকল্পিত নগরায়ন, পরিবেশ দূষণ, পানি দূষণ, ঘনবসতি, নদ-নদী খননে ব্যর্থতা, নদী শাসনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের স্বল্পতা, দক্ষ জনশক্তি, এ খাতে দুর্নীতি এবং কৃষিতে সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহারের ফলে নদ-নদী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষিখাতের ওপর।
লেখক: কলামিস্ট ও সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।