পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ঢাকার চারপাশে বহমান ছয় নদী-বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, তুরাগ, বালু, ধলেশ্বরী ও বংশী’র পানি পুরোপুরি অপরিশোধনযোগ্য। নদীগুলোর পানি রাজধানীবাসীর পানি পানের অন্যতম প্রধান উৎস হলেও, এই দূষিত পানিই ব্যবহার করা হচ্ছে। পানি এতটাই বিষাক্ত যে তা যথাযথভাবে পরিশোধন করা যায় না। দূষণ থেকেই যায়। এমন আতঙ্কজনক তথ্য উঠে এসেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্লাজমা প্লাস ল্যাবরেটরির এক প্রতিবেদনে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা ওয়াসার হয়ে প্রতিষ্ঠানটি এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় নদীর পানি বিশ্লেষণ করে গত রোববার এক সেমিনারে এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বিজ্ঞানী অধ্যাপক আমির এইচ খান। প্রতিবেদনে পানির গুণগত মানের পাঁচটি ক্যাটাগরি তুলে ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে, নীল, সবুজ, হলুদ, বাদামী ও লাল। শ্রেণীভিত্তিক এ পানির মধ্যে নীল পানের জন্য, হলুদ-মাছ, গবাদীপশু ও সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সবুজ-কৃষিকাজ, জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য উপযোগী, বাদামী-শিল্পকারখানায় ব্যবহার উপযোগী এবং লাল-রিক্রিয়েশনাল কাজে ব্যবহারযোগ্য। এই ক্যাটাগরির কোনোটিই ছয় নদীর পানিতে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নদীর পানি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, অপরিশোধনযোগ্য ভারি পদার্থ এবং শিল্পকারখানার বর্জ্য দ্বারা দূষিত। এতে অক্সিজেন লেভেল অনেক নিচে। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গার পানি বেশি আতঙ্কের। অথচ এই ছয় নদীর পানিই রাজধানীর পানি সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ভূ-উপরিস্থ পানির মধ্যে এই নদীগুলোর পানি পরিশোধন করে ওয়াসা রাজধানীতে সরবরাহ করছে। এর পরিমাণ প্রায় ২৫ মিলিয়ন লিটার।
চারপাশে নদী বেষ্টিত রাজধানী বিশ্বের খুব কম দেশেই রয়েছে। এ দিক থেকে বলতে গেলে এটি প্রকৃতির অপার উপহার। দুঃখের বিষয়, আমরা প্রকৃতির এই দান সুরক্ষিত করতে পারিনি। কোনো ধরনের বাছ-বিচার না করে নদীগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে। দখল-দূষণসহ হেন কোনো অকাজ নেই, যা দ্বারা নদীগুলোর ধ্বংসলীলা সাধন করা হয়নি। বছরের পর বছর ধরে রাজধানীর প্রাণের উৎস এসব নদী অনেকটা বিলীন ও পরিত্যক্ত ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। নদীগুলো রক্ষায় সরকারের তরফ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান যথার্থই বলেছেন, এটা সরকারের ব্যর্থতা। নদী রক্ষা কখনোই সরকারের কাছে প্রাধান্য পায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পানির উৎস নদী রক্ষা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন কখনোই অর্জন করা সম্ভব নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঢাকার চারপাশ দিয়ে বহমান নদী রক্ষায় আমরা বহুদিন ধরেই তাকিদ দিয়ে আসছি। যথেষ্ট লেখালেখিও হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ানো যায়নি। অবৈধ দখল ও দূষণের মাধ্যমে নদীগুলো মেরে ফেলার অপকর্ম চললেও এ ব্যাপারে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মাঝে মাঝে নদী রক্ষা করা হবে, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে বলে বড় বড় কথা বলেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। এমনকি আদালত কর্তৃক নদীর সীমানা ডিমার্কেশন বা নির্ধারণ করার নির্দেশ দেয়া হলেও তা প্রতিপালন করা হয়নি। বুড়িগঙ্গা রক্ষা এবং এর পানি প্রবাহ স্বচ্ছ রাখার উদ্যোগের কথা প্রায়ই শোনা গেলেও আজ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ এই বুড়িগঙ্গার পানিই নগরীর পানির অন্যতম উৎস। এর পানি এতটাই বিষাক্ত যে তা পরিশোধনেরও অযোগ্য। পরিশোধন করে যা সরবরাহ করা হয়, তাতে পানির স্বাভাবিক রং থাকে না। ঘোলাটে, পোকা-মাকড় ও দুর্গন্ধ থেকেই যায়। প্রায় প্রতিদিনই ওয়াসার সরবরাকৃত পানি পান এবং ব্যবহারের অযোগ্য বলে অভিযোগ উঠছে। অর্থাৎ ওয়াসা নগরবাসীর কাছ থেকে পানির উচ্চমূল্য গ্রহণ করলেও পানযোগ্য পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। শীতলক্ষার পানি পরিশোধনের জন্য সায়দাবাদস্থ যে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট রয়েছে, তা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ত্রুটিপূর্ণ এবং তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। বলা বাহুল্য, ঢাকার চারপাশের নদীর পানি দূষিত হওয়ার প্রধান কারণ কলকারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল, টেনারি বর্জ্য, গৃহস্থালী বর্জ্য, পয়নিষ্কাশন ও ড্রেনের বিপুল নোংরা পানি। এছাড়া কৃষি জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক, অতিরিক্ত নাইট্রোজেন ও ফসফেট সমৃদ্ধ সার ব্যবহার অন্যতম কারণ হয়ে রয়েছে। এসব অনাচার বন্ধ এবং নিয়ন্ত্রণে সরকারের তরফ থেকে কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। অথচ একটি সুস্থ নদীই বদলে দিতে পারে একটি বিরাট এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ। যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদায় মাত্র একটি নদী সেখানের জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছে। নদীর পানি এতটাই স্বচ্ছ যে, কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই তা আজলা ভরে পান করা যায়। অন্যদিকে আমাদের রাজধানী ঘিরে ছয়টি নদী থাকা সত্ত্বেও একটি নদীও আমরা বাঁচাতে এবং তার পানি পানের উপযোগী করে তুলতে পারছি না। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। একটি নদীকেও যদি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা যেত, তবে পুরো রাজধানীর চেহারা বদলে যেত।
সেমিনারে পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ গবেষণা প্রতিবেদন দেখে বলেছেন, নদীর পানি অপরিশোধনযোগ্য, এ গবেষণা তার কাছে নতুন এবং বিপজ্জনক মনে হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, নদী দূষণ রোধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। নদীর সীমানা নির্ধারণ করে তার স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে হবে। নদী দখল করে গড়ে উঠা যে কোনো স্থাপনা ধ্বংস করা হবে। এক্ষেত্রে কে প্রভাবশালী তা বাছ-বিচার করা হবে না। এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে দখলদাররা নদী দখল করতে আর সাহস না পায়। আমরাও এ কথাই বহুদিন ধরে বলে আসছি। তাতে সংশ্লিষ্ট কেউই কর্ণপাত করেনি। মন্ত্রী যেহেতু ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি এবং এগুলোর করুণ দশা সম্পর্কে সম্মকভাবে জানতে পেরেছেন, আমরা আশা করব তিনি এ ব্যাপারে শিঘ্রই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আমরা আবারও বলছি, নদী দখলে যারাই দায়ী, আইনগতভাবে তাদেরকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করার উদ্যোগ নিতে হবে। নদী দূষণের কারণগুলো প্রতিকারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাজধানীতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য। বছরের পর বছর কেবল সমস্যার কথা বলা হবে, সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেয়া হবে না, তা হতে পারে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।