Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

টেকসই অর্থায়ন কেন প্রয়োজন

জাহিদুল ইসলাম আকাশ | প্রকাশের সময় : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০৩ এএম

আমরা যা-ই করি, তার প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ প্রভাব পরিবেশের উপর পড়ে। মানবসমাজ প্রকৃতির উপর যে অত্যাচার চালায় তা ঘুরে ফিরে তাঁদের ঘাড়েই এসেই চাপে। এখন প্রচন্ড দাবদাহে উত্তপ্ত গোটা বিশ্ব। বিশেষ করে, ইউরোপ ক্ষত-বিক্ষত। বনভূমি, পশু-পাখি, মানুষের আবাসস্থল পুড়ে ছাই করে দিচ্ছে দাবানল। সা¤প্রতিক সময়ে ভয়াবহ দাবানল এবং দাবদাহে এক হাজারেরও অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে স্পেন ও পর্তুগালে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২০৬০ এর দশক অবধি ইউরোপে দাবানলের এ প্রবণতা বজায় থাকবে। এদিকে বিভিন্ন দেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশেও তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে। অসহ্য গরমে মানুষ অতিষ্ঠ। এরই মধ্যে কিছুদিন আগে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরে শক্তিশালী জলজ টর্নেডো আঘাত হানে। ভাগ্যিস এটি ভূখÐে ছড়িয়ে পড়েনি। নইলে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যেত। এর কেন্দ্রে বায়ুর গতিবেগ ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এ ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় বেশি ঘটছে। এখন দেশে বন্যা লেগেই আছে। সিলেটের ভয়াবহ বন্যার কথা কারও ভুলে যাওয়ার কথা না। দেশের স্বাভাবিক ঋতু বৈচিত্র্যেও এখন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। শীতকালে শীত নেই, বর্ষাকালে বৃষ্টি নেই।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দেশে দেশে খাদ্য ও জ্বালানির তীব্র সংকট সৃষ্টি করেছে। সারাবিশ্বে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধার ঝুঁকিতে ৮০ কোটি মানুষ এবং না খেয়ে মরার ঝুঁকিতে রয়েছে ৩২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ (বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর তথ্য)। একদিকে প্রকৃতির তাÐব, অন্যদিকে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা। সব মিলিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে বিশ্বব্যবস্থা। মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে বিশ্বের সকল দেশেই। বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলোও ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির কবলে পড়েছে। স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রেই ৯ দশমিক ১ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশেও ৯ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি (৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ) ঘটেছে। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সকল দ্রব্যের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। বৈশ্বিক বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চাহিদার সাথে সমন্বয়ের জন্য এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং চলছে। শুধু বাংলাদেশেই যে এমনটা ঘটেছে, তা নয়। ইউরোপীয় কমিশন ইউরোপের দেশগুলোতে ১৫ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার হ্রাসের আহবান জানিয়েছে।

বিশ্বব্যাপী উদ্ভূত এ সংকটগুলো নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে টেকসই অর্থায়ন। আর্থিক ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগের সময় পরিবেশগত, সামাজিক ও সুশাসন বিবেচনায় নিয়ে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নের প্রক্রিয়াই টেকসই অর্থায়ন। অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব প্রকল্প করতে হবে, যা একইসাথে পরিবেশ সংরক্ষণ করবে আবার অর্থনীতিকেও সচল রাখবে। বিশ্বের ৮৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় জীবাশ্ব জ্বালানি থেকে, যা ব্যাপক কার্বন নিঃসরণ ঘটিয়ে জলবায়ুতে তীব্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অবশ্য কার্বনের মাত্রা শূন্যের কোটায় আনতে বিভিন্ন দেশে নানা পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়।

আমাদের নবায়নযোগ্য উৎসের সন্ধান করতে হবে। সৌরশক্তি, বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রের ঢেউ, পানিপ্রবাহ প্রভৃতি নবায়নযোগ্য উৎস ব্যবহার করে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি। এতে করে খনিজ জ্বালানির উপর চাপ কমবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবার আগে প্রয়োজন বৈশ্বিক জলবায়ুর সুরক্ষা নিশ্চিত করা। আর এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার অপরিহার্য। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলো ব্যবহারের জন্য অনুক‚ল পরিবেশ রয়েছে। যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমরা অনেক ধাপ এগিয়ে যেতে পারবো এবং এতে খনিজ জ্বালানি সাশ্রয় হবে। টেকসই জ্বালানি পরিকল্পনা বৈশ্বিক সংকট অনেকাংশেই লাঘব করবে। খাদ্য উৎপাদনে প্রচুর রাসায়নিক উপাদান ব্যবহৃত হচ্ছে। এর পরিবর্তে জৈবসারের ব্যবহার বাড়িয়ে দিতে হবে। প্রত্যেক দেশে টেকসই উপায়ে অভ্যন্তরীন খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে দিলে এবং মজুদ না করে খাদ্য সরবরাহ বৃদ্ধি করা হলে খাদ্য সংকটও কেটে যাবে। ফলে কমে যাবে মুদ্রাস্ফীতিও।

প্রত্যেকটা শিল্পের যথাযথ কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি মেনে চলতে হবে। কেবল উৎপাদন বাড়ানো কিংবা জিডিপি স¤প্রসারণ করলেই হবে না। উৎপাদন বাড়ানোর সাথে পৃথিবীর মাটি, পানি, বনভূমি, জলাধার বিপর্যস্ত হচ্ছে কিনা তা বিবেচনায় নিতে হবে। অর্থনীতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও জরুরি। বিশ্বব্যাপী যে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা বন্ধ করা অত্যাবশ্যাক। যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহারের ফল কিন্তু প্রকৃতিকেই বহন করতে হচ্ছে, যা গোটা বিশ্বের মানবসভ্যতার জন্যই ক্ষতিকর। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে টেকসই অর্থায়ন বেগবান হবে। বাংলাদেশেও টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়নে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ব্যাংক ঋণের ১০ শতাংশই এখন টেকসই অর্থায়নে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এই ধারণা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কেননা পরিবেশকে সুস্থ রাখা গেলে অর্থনীতি স্বাভাবিকভাবেই সচল হয়ে উঠবে।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন