চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
বৃক্ষ বা গাছ মহান আল্লাহ তায়ালার অনিন্দ্য সৃষ্টি। গাছপালা না থাকলে এই পৃথিবীতে বসবাস করা অসম্ভব ছিলো। গাছ মানুষের সবচেয়ে কাছের বন্ধু যে বন্ধু কখনো প্রতারণা করতে জানেনা। বলা হয়ে থাকে যে, যে দেশে বনভূমি যত বেশি সে দেশ সবদিক থেকে সমৃদ্ধ তওত বেশি।
গাছ মহান আল্লাহ তায়া’লার পক্ষ থেকে আমাদের ও আমাদের পরিবেশের জন্য অমূল্য নেয়ামত। মানুষের মৌলিক অধিকার গুলোর মধ্যে খাদ্য,বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার ঔষধপত্র কেনার অর্থের যোগানদাতা হিসেবে গাছের ভূমিকা অপরিসীম। শুধু এখানেই শেষ নয় বরং পরিবেশ তথা পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা এবং মানব উন্নয়নে গাছের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কোনো দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য অবশ্যই সেদেশে ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা খুবই জরুরি। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো সবুজ শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশে বনভূমি আছে মাত্র ১৭ শতাংশ যার ১০ শতাংশ হলো সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন আর বাকি ৭ শতাংশ হলো গ্রাম এলাকার মানুষের হাতে গড়া বনভূমি।
উপরোক্ত তথ্য থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে,আমাদের বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় বনভূমি অনেক কম যা আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। সুতরাং আমরা এ থেকে বুঝতে পারি যে অন্তত আমাদের পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য হলেও আমাদের সকলের বেশি বেশি করে বৃক্ষরোপণ করা সময়ের দাবি। বেশি বেশি বৃক্ষরোপণ না করা হলে আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন অকল্পনীয় হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে।
গাছ তো পরম বন্ধু হিসেবে প্রথমত আমাদের অক্সিজেন নামক বিশাল এক জিনিস ফ্রী তে প্রদান করেন। এখানে অবশ্য গাছের কোনো করণীয় নেই পুরোটাই মহান আল্লাহর দান।আল্লাহ তায়া’লা গাছের মাধ্যমে আমাদেরকে এই অমূল্য সম্পদটি ফ্রী তে দান করেছেন।বাতাসের মধ্য থেকে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড নিজেরা শোষণের মাধ্যমে বাতাসকে নির্মল রেখে পৃথিবীর পরিবেশকে সুন্দর রাখে। একটি গাছ বছরে প্রায় ১৩ কেজি কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে। শুধু তাই নয় গাছ থেকে আমরা বিভিন্ন রকমের ফল, ফুল ও খাদ্য সামগ্রী পেয়ে থাকি। গাছ আমাদের ছায়া প্রদান করে মরুময়তা দূর করে আমাদেরকে প্রশান্তি দান করে থাকে, গ্রীন হাউজের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমাদেরকে হেফাজত করে রাখে,মাটি ক্ষয়রোধে গাছের ভূমিকা অপরিসীম যা শুধু মাত্র নদীবাহিত এলাকার লোকজন ই খুব ভালো করে অনুমান করতে পারবে।জ্বালানি সরবরাহের কাজে গাছের ভূমিকা অকল্পনীয়।
বৃক্ষরোপণ রোপন বা গাছ লাগানো শুধুমাত্র পার্থিব কোনো কাজ নয় বরং এটি একটি মহৎ ইবাদাতও বটে।বৃক্ষরোপণের বিষয়ে সরাসরি আল্লাহর রাসুল সা. তাগিদ দিয়েছেন। রাসুল (সা.) নিজ হাতে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করেছেন।হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করতে নির্দেশ দিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে। ’ (বুখারি, আদাবুল মুফরাদ: ৪৭৯; মুসনাদ আহমদ, হাদিস: ৩/১৮৩)।
অন্য একটি হাদিসে আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি কোনো মুসলিম কোনো গাছ রোপণ করে অথবা ক্ষেতে ফসল বোনে। আর তা থেকে কোনো পোকামাকড় কিংবা মানুষ বা চতুষ্পদ প্রাণী খায়, তাহলে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩২০; মুসলিম, হাদিস : ৪০৫৫)।
বৃক্ষরোপণ ছিলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব মহানবী (সা.)-এর বিশেষ আমল।তিনি নিজেও বৃক্ষরোপণ করেছেন এবং হাদিসেও আমাদেরকে বৃক্ষরোপণ করার বিষয় উৎসাহিত করেছেন।যেমন রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষরোপণ করে আর ফলদার হওয়া নাগাদ তার দেখাশোনা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্রতিটি ফলের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে সদকার সওয়াব দেবেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৬৭০২; শুআবুল ইমান, হাদিস : ৩২২৩)। আল্লাহর রাসুল (সা.) বৃক্ষরোপণ ও তা সংরক্ষণকে কত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এটা নিচের হাদিস টি পড়লেই অনুমান করা যাবে।রাসুল (সা.) মক্কা মুকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারার বিশেষ এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করেছেন। ওই এলাকায় গাছপালা কাটা এবং সেখানে পশুপাখি শিকার করা নিষিদ্ধ করেছেন যা আজও বিদ্যমান আছে। আধুনিকতার এই যুগে মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় জিনিস হলো আগুন। আগুনের মূল উৎস হলো বৃক্ষ। এই বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যিনি তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ থেকে অগ্নি উৎপাদন করে দিয়েছেন, সে মতে তোমরা তা থেকে আগুন জ্বালিয়ে নিতে পারো।’ (সুরা-৩৬ ইয়াসিন, আয়াত: ৮০)। গাছ মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানেও যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকে। ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টি এম দাস ১৯৭৯ সালে পূর্ণবয়স্ক একটি বৃক্ষের অবদান আর্থিক মূল্যে বিবেচনা করে দেখান যে ৫০ বছর বয়সী একটি বৃক্ষের অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় এক লাখ ৮৮ হাজার মার্কিন ডলার।
গাছ শুধুমাত্র আমাদের অক্সিজেন ও অর্থনৈতিক চাহিদা ই পূরণ করে না বরং গাছ আমাদের প্রাকৃতিক মহামারীর হাত থেকেও বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। সম্প্রতি পৃথিবীর মরু এলাকা ও এন্টার্কটিকা মহাদেশের বরফ ধীরে ধীরে গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা দিন দিন। অনিয়ন্ত্রিত হারে বেড়েই যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী দুই দশকের মধ্যে পুরো পৃথিবীতে ৬০০ মিলিয়নের মতো মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১২৫ মার্কিন ডলার, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে দাড়াবে।যেটা পুরো পৃথিবীর জন্য বিশাল হুমকিস্বরূপ। এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ১০ টি দেশ আর এই ১০ টি দেশের মধ্যে একেবারে প্রথম স্থান অধিকার করে আছেন বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক এই সমস্যাকে মোকাবিলা করার সাহস ও শক্তি কোনো মানুষেরই নেই তবে তা থেকে বাঁচার জন্য চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক এই দূর্যোগ থেকে বাঁচার জন্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের সবাইকে এখনই ইসলামের নির্তেশনা মেনে বেশি বেশি বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করা উচিৎ ও সময়ের দাবিও বটে!
শুধুমাত্র গাছ লাগানো ই শেষ নয় এটাকে সবসময়ই পরিচর্যা করতে হবে।প্রয়োজন অনুযায়ী পানি দিতে হবে। আর বাংলাদেশের বৃক্ষরোপণ বা গাছ লাগানোর সবচেয়ে উত্তম সময় হলো বর্ষাকাল বা বৃষ্টির দিন। যে সময় টা এখন চলছে। সাধারণত বাংলাদেশে জন থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মোটামুটি বৃষ্টি থাকে তখন বৃক্ষরোপণ করার সবচেয়ে উত্তম সময়। এইসময়ে গাছ লাগালে পানি দিকে হয় না।মাটি উর্বর থাকে তখন গাছ দ্রতই বেড়ে উঠে। খুব বেশি পরিচর্যা করতে হয় না।
বৃক্ষরোপণ যেমন সওয়াবের কাজ তেমনি বৃক্ষ নিধনও একটি জঘন্যতম অপরাধ। আল্লাহ তায়া’লা পাহাড় পর্বত ও বনজঙ্গল বিনা প্রয়োজনে সৃষ্টি করেন নি বরং এগুলো তিনি মানুষের বিশেষ প্রয়োজনের জন্য মই সৃষ্টি করেছেন।আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার ২২ শতাংশ কৃষিজমি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। গাছ নিধন বা কাটা হলে গাছ শুধু একাই মরে না। মানুষসহ সব প্রাণীর জন্যই তা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরিপূর্ণ বয়স্ক একটি গাছ বছরে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে, তা কমপক্ষে ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা মেটায়। বৃক্ষরোপণের বিষয়ে আল্লাহর রাসুল সা. যেভাবে তাগিদ দিয়েছেন ঠিক অপ্রয়োজনে বৃক্ষ নিধনের বিষয়েও তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। কারণ গাছ পরিবেশকে মনোমুগ্ধকর ও সতেজ রাখে। আবদুল্লাহ ইবনে হুবশি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে হুঁশিয়ারি দিয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫২৪১)।
সুতরাং আমাদের সকলের উচিৎ বৃক্ষ নিধন বা গাছ কাটা থেকে বিরত থাকা। যদি প্রয়োজনে আমাদের গাছ কাটতে হয় তাইলে একটি গাছ কাটার আগে কমপক্ষে তিনটি চারা গাছ লাগাতে হবে। যদি এই ভিশন নিয়ে আমরা আগাতে পারি তাইলে আমাদের পরিবেশ রক্ষা পাবে,আমরা অক্সিজেনের অভাব থেকে বাঁচতে পারবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।