হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আবদুল আউয়াল ঠাকুর : কথায় বলে, প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে নিজের ঘরও নিরাপদ থাকে না। ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক সূত্রের বন্ধনে আরাকানের মুসলমানরা আমাদের সহযাত্রী। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের মধ্যযুগের উৎকর্ষতায় রোসাং রাজ্যের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এক সময়ের স্বাধীন এই রাজ্যটিকে রক্ষা করতেও এ অঞ্চলের মুসলমান শাসকদের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা ছিল। ইতিহাসের পথপরিক্রমায় সেই অঞ্চলটি আজ মিয়ানমারের অংশ হিসেবে রয়েছে। ধর্মীয় নিয়মবিধি অনুযায়ী বৌদ্ধ ধর্মকে অহিংস ধর্ম বলা হলেও সকল ঐতিহ্য-সংস্কৃতি পায়ে দলে বার্মার মগ বৌদ্ধরা শুধু সহিংস এতটুকু বললে খুব কম বলা হবে। তারা যা করছে তার সাথে তুলনা হতে পারে বর্বরতার এমন অরেকটি উদাহরণ নেই। বর্বরতা-পাশবিকতা সবকিছুকেই হার মানিয়েছে সেখানকার নরপিশাচরূ। নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করতে সেখানে চলছে পরিকল্পিত ঠা-া মাথার বর্বরতা। গ্রামের পর গ্রামে তা-ব চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। হামলার শিকার প্রতিটি গ্রাম প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ধর্ষিত হয়েছে শত শত নারী। নিরপরাধ মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মারা হচ্ছে। শিশুদের জ্বলন্ত আগুনে ছুড়ে মারা হচ্ছে। ১০ বছরের বেশি বয়সী ছেলেরা নৃশংস খুনের শিকার হচ্ছে। স্বজনদের সামনেই অনেককে জবাই করা হচ্ছে। অনেককে হাত-পা কেটে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। এই নির্যাতনের বিবরণ দিয়েছেন এদেশে কোনোভাবে যারা ঢুকতে পেরেছে তারাও। সেখানে সেনাবাহিনীর তা-বের চিত্র এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় তুলেছে। দেখলে গা শিউরে ওঠে। তবু পাষাণের হৃদয় এটুকু কাঁপে না। কদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও দেখছিলাম। সেখানে দেখা গেল মাটিতে বসা একটি বানরকে টার্গেট করে চিতা। ভোজের পর চিতা যখন নিকটস্থ একটি গাছে উঠে বিশ্রাম নিতে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে একটি সদ্য প্রসূত বানরছানা ওই গাছ বেয়ে উঠছিল। বানরছানাটি সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করলেও তার পক্ষে এগোনো সম্ভব হচ্ছিল না সঙ্গত কারণেই। বিষয়টি নজরে আসে চিতার। জিহ্বা দিয়ে স্বাদ গ্রহণের পর চিতা বানরছানাটিকে মাতৃ¯েœহে আগলে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করছিল। বাস্তবে বানরছানা চিতাকে গ্রহণ করতে পারছিল না। পাঠককে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই যে, মূলত বানরছানাটির মাকেই চিতা শিকার করেছিল। বানর চিতার দ্বন্দ্বের পরিণতি যাইহোক মাতৃত্ব যে প্রতিহিংসার চেয়েও বড় সে ধারণা পশুর মধ্যে থাকলেও বার্মার আলোচ্য বর্বর সেনাবাহিনীর মধ্যে নেই। নেই বলেই মায়ের সামনে শিশুকে হত্যা করছে। মায়ের সামনে মেয়ের সাথে ব্যভিচার করছে।
বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতিমালায় জীব হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী একজন সিনিয়র বন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাহলে আপনারা মাছ-গোস্ত খান কীভাবে? বাজার থেকে কি কেনেন? বর্তমান সময়ে সবকিছুতেই মাছ-গোস্তর ব্যবহার হচ্ছে। একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, আমরা এখন সবই খাই। কারণ আমরা তো হত্যা করি না। অন্যরা হত্যা করে, আমরা তা কিনে খাই। এই নীতি বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত মতের সমার্থক না সাংঘর্ষিক সে প্রশ্ন করলে তিনি তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তার ভাষায় এখন এভাবেই চলছে। সে যাইহোক বৌদ্ধ ধর্ম হচ্ছে নির্বানপন্থি। পরকালের কোনো ধারণা এ ধর্মে নেই। সে কারণে তাদের জবাবদিহিতার বিষয়টিও আলাদা। এ অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের সাথে আমাদের বসবাস অনেক দিনের পুরনো। আমাদের সাহিত্যেও তাদের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ মূলত এ অঞ্চলের বৌদ্ধদের মনোবেদনার কাহিনী। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেই ষষ্ঠ শতক থেকেই এসব ঘটনার সূত্রপাত। বৌদ্ধদের স্বভাবসিদ্ধ সাধারণ জীবনযাপন নির্বিরোধ আচরণই তাদের বেঁচে থাকার অন্তরায় হয়ে উঠেছিল। আর এটা ঘটেছিল বর্ণবাদী হিন্দুদের আগ্রাসনের কারণে। বৌদ্ধদের হটিয়ে দিতে তৎকালীন ব্রাহ্মণরা যে ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়ন করেছিল সে কারণেই তাদের জীবন রক্ষার্থে বাংলামুলুক ছেড়ে তাদের নেপাল আশ্রয় নিতে হয়েছিল। কেন তারা নেপালে গিয়েছিল তার বিশদ বিবরণ না থাকলেও এটা সহজেই অনুমেয়, গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান বলা হয় নেপালের কপিলাবস্তু গ্রামে ; সে কারণেই হয়তো জীবনাশ্রয়ের জন্য নেপাল ছুটে গিয়েছিল তারা। যারা থেকে গিয়েছিল তাদের এটি বড় অংশ এদেশে সুফিবাদের প্রভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এই পরিবর্তনে কোনো যুদ্ধবিগ্রহ বা হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়নি বরং তা ছিল সহজাত। বর্তমান আরাকানের মুসলমানরাও এভাবেই ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নিয়েছিল। সে বিবেচনায় যদি দেখা যায় তাহলে বলতে হবে, এ অঞ্চলে বা বোধকরি পৃথিবীর কোনো অঞ্চলেই বৌদ্ধদের সাথে কোনো সম্প্রদায়ের সংঘাতের ইতিহাস নেই। একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে মিয়ানমারে যা ঘটছে। সঙ্গত এবং বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, কেন এমনটা ঘটছে বা ঘটতে পারছে? আর এই বীভৎসতা ঘটছে যখন সেখানে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর গণতন্ত্র ফিরে এলো ঠিক তখনই। সে জন্য দেখা দরকার, গণতন্ত্রের সাথে এর কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা। আমাদের দেশে শুনতে বিস্ময় লাগলেও পৃথিবীর অনেক দেশে এখনো নিজের নয় পিতামাতা বা স্বামী-স্ত্রীর কারণে নাগরিক দায়িত্ব পালনে অসুবিধা হয়। এ ধরনের নিয়ম আফ্রিকার অনেক দেশে বহাল রয়েছে। এমনকি এ জন্য সেসব দেশে গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত হচ্ছে। নিকট প্রতিবেশী বার্মার অং সান সুচিও তেমনি বাস্তবতার শিকার হয়ে প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয়েও পদের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নেই। ব্যাপারটি তিনি মেনে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাকে আপস করতে হয়েছে দেশটির সেনাবাহিনীর সাথে। নির্বাচনে জিতেও ক্ষমতাপ্রাপ্তি অনেকটা অনিশ্চিত ছিল। এই নির্বাচন রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাইরে রাখা হয়েছিল। এখানে দেখার বিষয়, কেন সেখানকার সেনাবাহিনীর মধ্যে এ ধরনের বিদ্বেষের জন্ম হয়েছে। সব বিবরণ হয়তো বলা যাবে না, তবে আলামত থেকে কিছু বিষয় উল্লেখ্য করা যেতে পারে। মধ্যযুগীয় বার্মাকে আধুনিক যুগের আলো পেতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে চীন। চীনই মূলত আধুনিক বার্মার রূপকার। এখন এটা অতীত। চীনের সাথে বার্মার সম্পর্ক তিক্ততার পর্যায়ে রয়েছে। এবারেও চীন রোহিঙ্গাদের জন্য তার দ্বার খুলে দিয়েছে এবং রাজনৈতিক ফয়সালার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গতভাবেই বলা যায়, পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দূর থেকে নাড়া কূটনীতি যা মূলত পরিচালিত হয়েছে জাতিসংঘের মাধ্যমে তার মাধ্যমেই চীনকে হটিয়ে দেয়া হয়েছে। চীনের সাথে এই কূটনৈতিক লড়াইয়ের পেছনে রয়েছে নানাবিধ সম্পর্ক। বিশেষ করে চীন-মার্কিন সম্পর্ক। এর সাথে যুক্ত রয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরের প্রসঙ্গ। এটাও এখানে বলে রাখা দরকার, গত কিছু দিনে এ অঞ্চলের অনেক দেশের সাথে সম্পর্কের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যেমন ফিলিপাইনের সাথে মার্কিন সম্পর্কের অবনতি তেমনিভাবে পাকিস্তান-ভারতসহ নানা প্রসঙ্গ রয়েছে। আমাদের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে রোহিঙ্গা অর্থাৎ আরাকানের এই মুসলমানরা। ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণাদি বলছে, দীর্ঘদিন আরাকান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। বৃটিশরা বার্মাকে ভারত থেকে আলাদা করতে গিয়ে আরাকানকে বার্মাভুক্ত করে। বার্মা এবং আরাকান অতীতে কখনো এক রাষ্ট্র ছিল না। বৃটিশদের একীভূতকরণের পরও আরাকানদের স্বায়ত্তশাসন দেয়ার কথা ছিল। সামরিক শাসক নেউনয়ের আমলে এটি প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর যে যুগ শুরু হয়েছিল তার কালো অধ্যায় এখন দেখছে বিশ্ব। এখানে ভাবার যে বিষয়টি তা হচ্ছে, যেভাবেই ব্যাখ্যা করা যাক না কেন বার্মায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও চীন বিদ্বেষ উসকে দেয়ার পেছনে সেখানে সেনাবাহিনীর কোনো অংশের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা থাকতে পারে । যে মহল যেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সাথে যুক্ত তাদের মধ্যে অবশ্যই কারো না কারো ইহুদি কানেকশন থাকতে পারে। সারা দুনিয়াতে ইহুদিদের প্রধান কাজ হচ্ছে মুসলিম নিধন। এমনকি তারা মনে করে, যে যত বেশি মুসলমান হত্যা করতে পারবে সে তত বড় ইহুদি। মানবতার জন্য হুমকিস্বরূপ এই ইহুদিরা প্রত্যক্ষভাবে যত বেশি কাজ করে তারচেয়ে বেশি করে পরোক্ষভাবে। দুনিয়াজোড়া এটা স্বীকৃত যে, সিআইয়ের কভারে মূলত ইহুদিরাই বিশ্বসভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। টুইন টাওয়ার ধ্বংসসহ অনেক বড় বড় অঘটনের নায়ক মূলত ইহুদিরা। প্রতিনিয়তই তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে কীভাবে বিশ্বকে অশান্ত করে তোলা যায় এবং মুসলিম নিধনে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। বোধকরি, গত নির্বাচনে রেহিঙ্গা মুসলমানদের ভোটাধিকারের বাইরে রাখার মধ্য দিয়েই চক্রান্তের একটি নীলনশা প্রণয়ন করা হয়েছিল, যার বাস্তবায়ন চলছে এখন। সে বিবেচনায় বলা যায়, বার্মার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সাথেই হয়তো যুক্ত রয়েছে ইহুদিদের গভীর ষড়যন্ত্র। এর বীজই হয়তো বপন করা হয়েছিল সেখানকার সেনাবাহিনীর কোনো অংশের মধ্যে। এ কারণে অবশ্যই ভাবার রয়েছে গণতন্ত্রকে যদি আব্রাহাম লিংকনের সংজ্ঞায় বিবেচনা করা হয় তাহলে সেখানে কালো মানুষের অধিকার নিশ্চিত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। অর্থাৎ সকলের অধিকার নিশ্চিত করাই মূলত মানবাধিকার। এখন বার্মায় দেখা যাচ্ছে তার বিপরীত। সেখানে গণতন্ত্র হয়েছে, বিশ্ববাসী গণতন্ত্রের স্বীকৃতি দিয়েছে অথচ সেখানকার গণতন্ত্রে জন্মগত অধিকার অস্বীকার করা হচ্ছে। সে বিবেচনায় এটা বলতেই হবে যারা এই গণতন্ত্রের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন তাদের কেউ না কেউ নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের বাইরে রাখার গোপন তত্ত্বটি জানেন। তখনই এ নিয়ে কথা বলা উচিত ছিল। এখন সেই মহলেরই এগিয়ে আসা জরুরি। এটা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, সভ্যতার সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বার্মায় অথচ বিশ্ব বিবেক নীরব। অং সান সুচি নিজেও একজন শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী। বারাক ওবামা শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী। এরকম বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই শান্তিতে নোবেল বিজয়ীরা রয়েছেন। বার্মায় যে নারকীয়তা হচ্ছে তা নিয়ে তারা সোচ্চার হচ্ছেন না কেন? এটা নোবেল দেয়ার সময়ে কোনো মন্ত্র ঢেলে দেয়ার বিষফল, নাকি নোবেল পাওয়ার শর্ত? যাইহোক শুধু তারাই নন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর জাতিসংঘ বলে পরিচিত ওআইসি বা মুসলিম দেশগুলোও এ ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। এটাও অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কেন এমনটা হচ্ছে বা হতে পারছে, এটিও ভেবে দেখার বিষয়। অথচ একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, পূর্বতিমুরে দক্ষিণ সুদানে খ্রীষ্টানদের পক্ষে এসব আন্তর্জাতিক মহল দাঁড়িয়েছে। এমনকি বাংলাদেশেও সংখ্যালঘুদের নিয়ে কোনো ঘটনা ঘটলে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বিশ্ব মুহূর্তের মধ্যে মুখ খুলে। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সর্বজনীন সনদে প্রতিটি ধর্মের অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কেবলমাত্র মুসলমান হওয়ার ‘অপরাধে’ কেন রোহিঙ্গা মুসলমানরা ঘৃণ্য বর্বরতার শিকার হবে? এ প্রশ্ন যেমনি বিশ্বের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের তেমনি বাংলাদেশের প্রতিটি সচেতন মানুষেরও। এই উদ্বেগ প্রকাশ করতেই গত কদিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধন, সভা-সমাবেশের মাধ্যমে তাদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করছে। দেশের ইসলামী শক্তিসমূহ তাদের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে। তাদের উদ্বেগের জায়গা আরো একটু এগিয়ে। তারা যথার্থই আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার পক্ষে। এ ব্যাপারে সরকারের প্রকাশ্য ঘোষিতনীতি এবং বাস্তবতা এক নয়। দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ প্রবেশ করতে পারলেও অনেককেই আবার ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে সেই নরপশুদের তোপের মুুখে।
যে ভাষার স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছি, জীবনপণ করেছি সেই ভাষার সমৃদ্ধির সাথে আরাকানের সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের যে বিকাশ হয়েছিল তা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুসলমান কবিরা মানবীয় প্রণয় কাহিনী অবলম্বনে কাব্যধারার প্রথম প্রবর্তন করে এ পর্যায়ে সাহিত্য সাধনাকে স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী করেছেন। ধর্মীয় ভাব-ভাবনায় সমাচ্ছন্ন কাব্যজগতের পাশাপাশি মুক্ত মানব জীবনের আলেখ্য অংকনের মাধ্যমে মুসলমান কবিগণ সূচনা করেছিলেন স্বতন্ত্র ধারার। রাজ অনুগ্রহ লাভ করে যেসব বাংলা ভাষাভাষী প্রভাবশালী কবির আবির্ভাব হয়েছিল তারা তাদের গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান অবদানে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। আরাকানকে বাংলা সাহিত্যে রোসাং বা রোসাঙ্গ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। আরাকানবাসী তাদের দেশকে রখইঙ্গ নামে অভিহিত করত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রোসাঙ্গ রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা নিজেদের নামের সঙ্গে একটি মুসলমানি নাম ব্যবহার করতেন। মূল বিষয় হচ্ছে, আজকে যাই মনে হোক না কেন এটাই সত্যি যে, আরাকানের সাথে আমাদের আত্মিক মানসিক সম্পর্ক রয়েছে। সে কারণে আরাকানের মুসলমানদের ওপর বার্মার বর্তমান শাসকদের নির্মমতা সঙ্গত বিবেচনাতেই ক্ষুব্ধ করেছে দেশবাসীকে। এ কথাও ঠিক যে, কেবল আশ্রয়ের মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদশ এমনিতেই নিজের নানা সমস্যায় ভারাক্রান্ত। তার ওপর কতটা বোঝা বহন করতে পারবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সেই সাথে এ কথাও সঙ্গত যে, বিদপগ্রস্ত প্রতিবেশীদের আশ্রয় দেয়া আন্তর্জাতিক নিয়মের অংশ। অন্যদিকে যেহেতু সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান হতে হবে সে জন্য বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় না দিলে এটা সম্ভব নয়।
বিগত নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার না দেয়ার মধ্য দিয়ে যদি প্রমাণ করার চেষ্টা হয়ে থাকে তারা দেশের নয়, তার অর্থ হচ্ছে, তাদের নিজেদের দেশ তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। জন্ম গত অধিকার প্রতিষ্ঠায় অবশ্যই জাতিসংঘকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। নির্যাতিত রোহিঙ্গারা দুর্বল হতে পারে জাতিসংঘ দুর্বল নয়। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় সেখানে অবিলম্বে জাতিসংঘ বাহিনী পাঠানো প্রয়োজন। ঠা-া মাধায় চলমান এ ধরনের নিধনযজ্ঞের পেছনে কে বা কারা কাজ করছে তা নিশ্চিতকরণে জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে তদন্ত কমিটি গঠন করে অপরাধীদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে হাজির করা জরুরি। বসনিয়ায় মুসলিম নিধনকারীদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিচারের ভয়ে অনেকে আত্মহত্যাও করেছে। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা অপরিহার্য। রেহিঙ্গারা আমাদের নিকট প্রতিবেশী। বার বার তারা এ ধরনের দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে এটা মেনে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।