Inqilab Logo

শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ভেজাল ওষধ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

অসুস্থ হলে মানুষ চিকিৎসকের কাছে যায়, চিকিৎসক দেখে শুনে প্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে দেন। রোগী দোকান থেকে ওষুধ কিনে খায়, এটিই সাধারণ প্রক্রিয়া। কিন্তু দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওষুধ খেয়েও রোগ সারে না। ভেজাল ও নি¤œমানের ওষুধ রোগ মুক্তি প্রলম্বিত করে, রোগের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়, এমনকি মৃত্যুও ঘটায়। ভেজালের মধ্যে নতুন সংযোজন হচ্ছে আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ। এসব ওষুধ বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ফার্মেসিতে। সম্প্রতি দেশব্যাপী এ ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে ওষুধ প্রশাসন। আটক করা হয়েছে, অবৈধভাবে আমদানি করা বিদেশি ওষুধ। শুধু ফার্মেসিতেই নয়, নগরীর বিভিন্ন হোমিওপ্যাথির দোকানে কিংবা হেকিমি দাওয়াখানাও দেদারছে বিক্রি হচ্ছে বলবর্ধক, যৌনবর্ধক বিভিন্ন ওষুধ। ফুড সাপ্লিমেন্ট নামে এগুলো অবাধে দেশে ঢুকছে। ওষুধ প্রশাসনের একটি ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটি রয়েছে। কোনো ওষুধ বাজারজাত করার আগে অবশ্যই এ কমিটির অনুমতি নিতে হয়।

বিভিন্ন সূত্রের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ভেজাল বা নি¤œমানের ওষুধের বার্ষিক বিক্রি প্রায় ১০০০ কোটি টাকা, যা মোট বিক্রির শতকরা প্রায় ১০ ভাগ। দুর্নীতি, আইন প্রয়োগে শৈথিল্য, নজরদারির অভাব, দুর্বল বিচারব্যবস্থা, ক্ষমতাসীনদের অর্থলিপ্সা, শক্ত আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক প্রভৃতির পাশাপাশি প্রযুক্তিগত অসামর্থ্যতা, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব এবং অজ্ঞতা ভেজাল বা নি¤œমানের ওষুধের বাজার বিস্তারের প্রধান কারণ। এর উপর ভর করছে ফার্মেসিতে ভয়ংকর ডাক্তারি। ৬৪ শতাংশ ওষুধ বিক্রেতা রোগের উপসর্গ শুনে নিজেরাই ওষুধ দেয়। ৮৭ শতাংশ ওষুধ বিক্রি করে প্রেসক্রিপশন ছাড়া। যোগ্যতা ছাড়াই অবৈধভাবে ওষুধ বিক্রেতার কাজ করছে ৫২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ওষুধ দেওয়া হয় অ্যান্টিবায়োটিক গ্রæপের। অথচ বাংলাদেশের সর্বশেষ প্রণীত জাতীয় ওষুধনীতি অনুযায়ী, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রেতা কোনো রোগীর কাছে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করতে পারবে না।

দেশে ওষুধ বিক্রির নামে অনাচার চললেও দেখার কেউ নেই। কর্মকর্তারা ফার্মেসি খোলার অনুমতি দিয়ে দায় সারেন। বিক্রেতারা ডাক্তারি করে। স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ নানা ওষুধ তারা বিনা ব্যবস্থাপত্রে তুলে দেয় গণমানুষের হাতে। নি¤œমানের, এমনকি ভেজাল ওষুধও গছিয়ে দেয়। ফলে রোগমুক্তির বদলে রোগোর জটিলতা বৃদ্ধি পায়। ভেজাল ওষুধে, অপচিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা অহরহ ঘটছে। বছরের পর বছর ধরে এমন নৈরাজ্য চললেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। সংকটের সমাধান হয় না, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় না।

ওষুধ হলো রাসায়নিক পদার্থ, যা সঠিক পরিমাণ ও নির্দিষ্ট রোগের জন্য নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত সেবন করলে তা কার্যকর হয়। অপব্যবহারে জীবাণু ধ্বংস হয় না, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ যদি মানসম্পন্ন না হয়, নি¤œমানের, ভেজাল, যথেচ্ছ ব্যবহার কিংবা নির্বিচারে প্রয়োগ ও প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হয়, তবে তা জীবনের জন্য হুমকি হয়ে উঠে। নকল ও নিষিদ্ধ ওষুধ উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন ও মজুদ করার কাজে সমাজবিরোধী চক্রের সাথে ওষুধের দোকানদারও সহযোগিতা করে থাকে। এর ফলে ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে সাধারণ মানুষ।

মাদকাসক্তি আমাদের জাতীয় সমস্যা। এটি অনেকটা মহামারি আকার ধারন করেছে। রাজধানী ছাড়িয়ে গ্রামের পাড়া-মহল্লায় প্রবেশ করেছে। দেশের তরুণ সমাজ মাদকাসক্ত হয়ে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে, তার নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তরুণরা অনেক ক্ষেত্রে মাদক সংগ্রহ করে অসাধু ওষুধের দোকানদারদের কাছ থেকে। ওষুধ বিজ্ঞানে তাদের প্রশিক্ষণ না থাকায় এ সম্পর্কে তাদের ধারণাও কম। রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপশহরের প্রতিটি গলিতে এক বা একাধিক এবং দেশের প্রতিটি গ্রামে বা পাড়ায় এক বা একাধিক ওষুধের দোকানসহ প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার ফার্মেসি রয়েছে। একজন ওষুধ বিক্রেতার অবশ্যই ওষুধ সংরক্ষণ, মাত্রা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। কিন্তু দেশের অধিকাংশ ওষুধ বিক্রেতারই এ সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান নেই। যোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই বিক্রেতারা ওষুধ বিক্রি করছেন। ফার্মেসি চালানোর জন্য যে আইন রয়েছে তা খুব কম মানা হচ্ছে।

রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া ওষুধ ক্রয়-বিক্রয় বিশ্বের কোন দেশেই হয় না। ব্যতিক্রম কেবল আমাদের দেশে। ওষুধের সঠিক ব্যবহার এবং চিকিৎসকের নির্দেশমত সেবন করলে একজন রোগী পূর্ণ সুস্থতা ফিরে পেতে পারে। এই নিয়মটুকু বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব যিনি ওষুধ বিক্রি করেন তার। আমাদের দেশে সবমিলিয়ে প্রায় ৮০০ ওষুধ কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানির তৈরি করা ওষুধ গুণ ও মানসম্পন্ন কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগার বা লোকবল ওষুধ প্রশাসনের নেই। যা আছে তা দিয়ে যদি তারা তৎপর থাকত, তাহলে পরিস্থিতির এত অবনতি হতো না। বলাবাহুল্য, অন্যান্য দ্রব্যের ত্রæটি ক্ষমা করা গেলেও ওষুধের ক্ষেত্রে তা কোনোভাবেই করা যায় না। বিশ্বের সকল সভ্য দেশেই ওষুধ একটি বিশেষায়িত ও উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য। ঐসব দেশ কোনো কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ওষুধ তৈরি করার অনুমোদন দেয়া হয় না।

ওষুধ প্রশাসন ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নতুন ড্রাগ লাইসেন্স ইস্যু বন্ধ রেখেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত পরবর্তীতে নতুন ড্রাগ লাইসেন্স ইস্যু করা হবে না বলে জানানো হয়েছে। তবে নতুন ড্রাগ লাইসেন্স কারা পাবেন, কার মাধ্যমে ওষুধ বিক্রি হবে, দেশব্যাপী তার নীতিমালা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। অথচ অবৈধ ঔষধের দোকান প্রায় সব জায়গায় রয়েছে। যেখানে ওষুধ বিক্রি করতে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট প্রয়োজন, সেখানে কোনো সনদ বা অভিজ্ঞতা ছাড়াই ঔষধ কেনা-বেচা হচ্ছে দেদারছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালাবিরোধী। আমাদের দেশে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট প্রশিক্ষণের দায়িত্বে আছে ফার্মেসি কাউন্সিল। প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত দেশে ওষুধের দোকান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, গবেষণাগার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ওষুধশিল্পে কত লাখ ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট প্রয়োজন তা নিরূপণ করতে পারেনি। বিশাল সংখ্যক ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে যে জনস্বাস্থ্য কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে, এই পরিকল্পনা সরকারের কাছে পেশ করতে পারে ফার্মেসি কাউন্সিল।

ওষুধের মতো সংবেদশীল পণ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ওষুধের দোকান পরিচালনা ও ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিগুলোতে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের প্রয়োজন। এতে ৭ লাখ ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট প্রয়োজন। তথ্য অনুযায়ী, ফার্মেসি কাউন্সিল এ পর্যন্ত শর্ট ও লং মিলিয়ে ৯২ হাজার ব্যক্তিকে ওষুধ সম্পর্কিত জ্ঞানের আওতায় এনেছে। পর্যাপ্ত ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে ফার্মেসি কাউন্সিল। তার ব্যর্থতার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। বলার অপেক্ষা রাখে না, ওষুধ উৎপাদন, প্রকিয়াকরণ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও বিতরণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও দায়িত্বশীল লোকবলের ওপর নির্ভর করছে, জনসুস্থতা।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন