পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
এই মুহূর্তে একমাত্র বড়লোক ছাড়া দেশের আর কেউ শান্তিতে নাই। যে মানুষটির বেতন মাসে ৫০ হাজার টাকা, তিনিও দ্রব্যমূল্য সহ অন্যান্য নাগরিক দুর্ভোগে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন। জিনসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভালো। কারণ, এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কোনো ভ্যালিড কারণ নাই। দোকানদার বলুন, বাজারের বিক্রেতা বলুন, মজুতদার বলুন আর আড়ৎদার বলুন- ইচ্ছা হলো আর দাম বাড়িয়ে দিল। কত বাড়াবে সেটার পেছনেও কোনো অর্থনৈতিক থিওরি কাজ করে না। ইচ্ছে মতো বাড়িয়ে দিলেই হলো। জিনসপত্রের দাম একবার বাড়িয়ে দিলে সেটা আর কমে না। এখন ধরুন, কোনো এক পণ্যের মূল্য লিটার প্রতি ১০০ টাকা। হঠাৎ করে সেটির দাম বেড়ে হলো ১৩০ টাকা। তারপর সরকারের তরফ থেকে অভিযান চালানো হলো। অভিযানের কারণে হোক বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, ঐ পণ্যের লিটার প্রতি মূল্য ১০ টাকা কমে গেল। সাথে সাথে মিডিয়াসহ সরকার এবং অন্যেরা গর্ব করে বললো, ঐ পণ্যের দাম কমে গেছে। কমে গেছে মানে কী? ১০ টাকা কমে তো দাম হলো ১২০ টাকা। এখনও তো দাম ২০ টাকা বেশি। কিন্তু ঐ কথা আর কেউ বলে না। অথচ, পণ্যটির দাম তখনই কমেছে বলা যাবে, যখন তার দাম ১০০ টাকা থেকে ১০ টাকা কমে ৯০ টাকা হবে। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, কোনো একটি পণ্যের দাম একবার বেড়ে গেলে সেটি কমার কোনো নজির এই ৫১ বছরেও নাই। আরো একটি দুঃখজনক ব্যাপার হলো এই যে, ঐ যে পণ্যের দাম ১২০ টাকা হলো, কয়েক মাস ১২০ টাকায় স্থির থেকে হঠাৎ করে লাফ দিয়ে সেটি ১৪০ টাকা হলো। সরকার তখন ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠকে বসে। ঐ বৈঠকে ১০ টাকা কমিয়ে পণ্যটির দাম করা হয় ১৩০ টাকা এবং সেটাই পণ্যের আসল দাম হয়ে গেলো।
আপনি বাজারে যে জিনিসটিতেই হাত দেন না কেন, সেই জিনিসটিরই দামে আগুন। বেগুনের কেজি ১০০ টাকা। ১০ পিসের এক প্যাকেট বিস্কিট। এই তো ১৫/১৬ দিন আগেও কিনেছি ৬০ টাকায়। ৭ দিন পরে কিনতে গেলাম। দোকানী হাঁকলো ৮০ টাকা। ঐ দামেই কিনতে হলো। আবার ৭ দিন পরে আরেক প্যাকেট কিনতে গেলাম। এবার দাম হাঁকলো ১০০ টাকা এবং বর্তমানে ঐ বিস্কিটটির প্যাকেট ১০০ টাকা। পাঠক, আমি কোনো কিছু কল্পনা করে বলছি না। আমার সাথে কেউ যদি যোগাযোগ করেন তাহলে আমি তাকে টেলিফোনে ঐ বিস্কিটটির নামও বলতে পারি। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো এই যে, ইচ্ছা মতো মূল্যবৃদ্ধি, এর কোনো প্রতিকার নাই। কোথাও নাই। আমি সংশ্লিষ্ট কয়েক জায়গায় ফোন করেছি। তারা বলেছেন, আচ্ছা দেখবো। ঐ পর্যন্তই। তারা দেখছেনই। এমন কোনো জিনিস নাই যার দাম বিগত দেড় মাসে দ্বিগুণ না হলেও দেড় গুণ বাড়েনি।
আমি অনেক দিন হলো দিনে ৫/৬টা ওষুধ খাই। সাধারণত মাসের প্রথম সপ্তাহে সারা মাসের ওষুধ কিনি। এতে আমার ওষুধ বাবদ মাসে গড়ে ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৭০০ টাকার মতো খরচ হতো। দুইদিন আগে মাসকাবারি ওষুধ কিনেছি। খরচ হয়েছে ৬ হাজার ২০০ টাকা। অর্থাৎ এই ওষুধ বাবদ আমার অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে ২৭০০ টাকা। এটি শুধু ওষুধের কথা নয়, প্রত্যেকটি জিনিসের দামে আগুন। আর সেই আগুনে শুধু আমিই জ্বলছি না, বাংলাদেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে অন্তত ১৪ কোটি মানুষ জ্বলছে। কেন এমন অরাজকতা? দেশটি কি মগের মুল্লুক হয়ে গেল?
॥দুই॥
এখন দেশজুড়ে লোডশেডিং চলছে। এ সম্পর্কে আপনারা বিগত ১৫ দিন হলো প্রত্যেকেই সাফার করছেন। তাই দিনে কে কত ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকেন, সেটি আর আলাদা করে বলছি না। কারণ, প্রতিদিনই আপনারা এ সম্পর্কে পত্র পত্রিকায় পড়ছেন। কিন্তু আমি বিষয়টির ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এর কোনো কূলকিনারা করতে পারিনি। প্রথম কথা হলো, কেন হঠাৎ করে ২ থেকে ৬/৭ ঘণ্টা পর্যন্ত সারাদেশে লোডশেডিং করতে হলো? এসম্পর্কে ডেইলি স্টার, ডেইলি নিউ এজ, ডেইলি সান, দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক সমকালসহ ৮/৯টি দৈনিক পত্রিকা আমি পড়ি। এসব পত্রিকার সংবাদ ভাষ্য এবং সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়ও পড়ি। এসব নিবন্ধে কিছু কিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। যারা লেখেন তারা অধিকাংশই সম্মানীয় ব্যক্তি এবং এসব বিষয়ে তারা বিশেষজ্ঞ। ফলে তাদের লেখা সাধারণ মানুষ অর্থাৎ আমজনতা বুঝতে পারে না। তাছাড়া বিষয়টি টেকনিক্যালও বটে।
গত কয়েক দিন ধরে একাধিক মন্ত্রী খুব জোর গলায় বলছেন যে, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই নাকি আর লোডশেডিং থাকবে না। একবার তো লোড শেডিংকে যাদুঘরে পাঠানো হয়েছিল। হাতিরঝিলে আতশবাজি ফুটিয়ে বিদুৎ উৎসবও করা হয়েছিল। লোডশেডিংয়ের সেই দানব তো আবার যাদুঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন যে মন্ত্রী প্রবররা বলছেন যে, সেপ্টেম্বরের মধ্যেই লোড শেডিং চলে যাবে, তার ভিত্তি কী? তারা যদি মনে করেন যে সামনে শীত আসছে, তাহলে তারা ভুল করছেন। কারণ অক্টোবরেও গরম থাকে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শীত না পড়লেও গরম কমে যায়। তাহলে সেপ্টেম্বরে লোড শেডিং বিদায় হবে কিভাবে?
এখানে একটু ভারি আলোচনা করতে হয়। একটু আগে আমি বলেছি যে, এ সম্পর্কে আমি প্রচুর পড়াশোনা করে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেছি। একজন আমজনতা যাতে বুঝতে পারে সেভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি। আসলে আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা কত? বলা হয় যে সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গেলে আমাদের প্রয়োজন সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এখন দৈনিক কত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে? এই যে ২ ঘন্টা থেকে ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত লোড শেডিং হয়, এর ফলে দৈনিক কত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়? এই ফিগারটি কিন্তু আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এটি কি ১১ হাজার মেগাওয়াট? সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট? না কত? কর্তৃপক্ষকে পরিষ্কার করে এটি বলতে হবে।
এখানো আরো একটি বিষয় পরিষ্কার করতে হবে। সেটি হলো, কোন উৎস থেকে বা কোন ইনপুট দিয়ে কত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে? শুধু গ্যাসের কথা বললে হবে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে গ্যাস থেকে, তেল থেকে, ক্যাপটিভ গ্যাস থেকে, কয়লা থেকে এবং নবায়নযোগ্য গ্যাস থেকে। এসব উৎস ছাড়াও ইন্ডিয়া থেকে ৫০০ থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়ে থাকে। এখন সরকার পরিষ্কার করে বলছে না যে, কোন উৎস বা ইনপুট থেকে কত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আমরা তো পত্রপত্রিকা পড়ে জানতে পেরেছি যে, ক্যাপটিভ গ্যাস থেকে উৎপন্ন হয় মোট বিদ্যুতের ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ, অর্থাৎ ১১ শতাংশ বিদ্যুৎ। এটা তো শিল্পপতি বা করখানার মালিকরা নিজেদের উদ্যোগে নিজেরা গ্যাস জোগাড় করে উৎপাদন করেন। তাহলে বাকি থাকলো ৮৯ শতাংশ। এরমধ্যে গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয় ৪৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। কয়লা থেকে উৎপাদিত হয় ৬ দশমিক ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ ৭ শতাংশ। জ্বালানি তেল থেকে উৎপন্ন হয় ২৯ দশমিক ৭০ শতাংশ। আমদানি বাবদ পাওয়া যায় ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাওয়া যায় ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ।
॥তিন॥
প্রথমেই গ্যাস। এটি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সবচেয়ে বড় উৎস বা ইনপুট। এখন আমরা সকলেই জানি যে, বাংলাদেশের মাটির তলে গ্যাস রয়েছে। সেই গ্যাস উত্তোলন করা হয় এবং ব্যবহার করা হয়। তাহলে বিদেশ থেকে এলএনজি গ্যাস কেন আমদানি করা হয়? এলএনজি গ্যাসকে বলা হয় লিকুফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস বা তরলীকৃত গ্যাস। আবার ইন্ডিয়া থেকে আমদানিও করা হয়। তাহলে এখন অর্থাৎ এই লোডশেডিংয়ের সময় নিজেদের অর্থাৎ মাটির তল থেকে কতখানি গ্যাস দিয়ে কত মেগাওয়াট উৎপাদন করছি। অনুরূপভাবে এলএনজি গ্যাস কি পরিমাণ আমদানি করছি। এলএনজি তো সিলিন্ডারে থাকে। সেটিকে টেকনিক্যাল পরিভাষায় গ্যাসিফিকেশন অর্থাৎ আবার গ্যাসে রূপান্তর করা হয়। এজন্য টারমিনাল লাগে। তারপর সেই গ্যাস গ্রীডে সংযুক্ত করে ভোক্তার কাছে পাঠানো হয়।
এখন আমরা দেখছি যে, সরকারি খাতেও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে, আবার বেসরকারি খাতেও রয়েছে। বেসরকারি খাতের ওগুলো প্রধানত রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল প্ল্যান্ট। এখন আমরা রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল প্ল্যান্ট থেকে কত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি? কি দামে পাচ্ছি? আবার সরকারি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট থেকে কি দামে বিদ্যুৎ পাচ্ছি? এই দামটি সাধারণত ইউনিট প্রাইস হিসাবে হিসাব করা হয়। এর ওপরে আছে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি। তাহলে আমরা এই লোডশেডিংয়ের সময়ে এলএনজি, সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ইন্ডিয়া থেকে কত গ্যাস আমদানি করছি, ক্রয় করছি এবং উত্তোলন করছি? কোনটার কি রকম দাম পড়ছে? আরো কথা আছে। কয়লা দিয়ে কত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে? তার ইউনিট প্রাইস কত? এসব তথ্য জনগণকে জানাতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, সবচেয়ে কম খরচ পড়ে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় সোলার সিস্টেম বা সূর্যের আলো, বায়ু প্রভৃতি থেকে। সরকারের মহাপরিকল্পনায় রয়েছে যে, মোট চাহিদার অন্তত ১০ শতাংশ সংগ্রহ করা হবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। অথচ এখন সেখান থেকে উৎপাদিত হচ্ছে সবচেয়ে কম, অর্থাৎ ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। এগুলোর ইউনিট প্রাইসই বা কত হচ্ছে? এগুলো সব জনগণকে জানাতে হবে।
প্রথমে শুনেছিলাম যে, বাংলাদেশ নাকি তেলে ওপর ভাসছে। তারপর সেই তেল উধাও হয়ে গেল। শুনলাম যে, তেল নয়, গ্যাসের ওপর ভাসছে। তাহলে সেই গ্যাসের জন্য এলএনজি আমদানি করতে হয় কেন? আর কেনই বা ইন্ডিয়া থেকে আমদানি করতে হয়? এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিরাট রহস্য। এব্যাপারে সর্বাগ্রে প্রয়োজন স্বচ্ছতা। মানুষ হঠাৎ করে শুনবে যে, তাকে গ্যাসের জন্য বেশি দাম দিতে হবে, বিদ্যুতের জন্য বেশি দাম দিতে হবে। কেন? তারপরেও তাদের গ্যাস বিল বা বিদ্যুৎ বিল স্ফিত হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের পাহাড় গড়ে উঠছে। ট্রান্সপারেন্সী বা স্বচ্ছতা না হলে মানুষ সেগুলোই বিশ্বাস করবে। তাই যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত হলো, সেগুলোর সঠিক জবাব দিতে হবে। আর এই সঠিক জবাবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সেই প্রশ্নের উত্তর : সেপ্টেম্বরের মধ্যেই লোডশেডিং বন্ধ হবে কিনা। আমরা মনে করি সেটি সম্ভব নয়।
আরো অনেক কথা রয়েছে। সেগুলো এক দিনে শেষ হবে না। বারান্তরে এই বিষয়ে আবার লিখবো, ইনশাআল্লাহ।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।