পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
জন্মাষ্টমীর এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের বক্তব্য নিয়ে চারিদিকে ভীষণ তোলপাড় চলছে। তোলপাড় হতেই পারে, খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলে কথা! সরকার সমর্থকরা ভীষণ উত্তেজিত এমন বেফাঁস মন্তব্যের জন্য। প্রধান বিরোধী দলের মহাসচিব চেয়েছেন ‘ব্যাখ্যা’। নাগরিক সমাজ বিব্রতবোধ করছে। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রীর বক্তব্যকে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত অভিমত বলে দায় সেরেছেন। এক সাবেক কূটনীতিক বলেছেন, এমন কথা প্রকাশ্যে না বললেই পারতেন। এক ইংরেজি দৈনিকের ডাক সাইটে সম্পাদক মন্তব্য করেছেন ‘অপরিপক্ক’। আর গভীর রাতের টকশোর সরকার সমর্থক টকিস্টরা পড়েছেন মহা বেকায়দায়, পরিস্থিতি সামলাতে বেচারারা গরুকে নদীতে ফেলে ক্রমাগত নদীর রচনা পাঠ করে চলেছেন। এসব মন্তব্য নিয়ে কোনো কথা নেই আমাদের। যে যার মতো বলবেন, এটাই নিয়ম। কিন্তু আমার মতো আমজনতার সমস্যা অন্য জায়গায়।
আমরা জানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তির রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সফরে অন্য কোনো দেশে যাবার আগে ব্যাপক প্রস্তুতি থাকে। কবে যাবেন, কার সাথে বৈঠক করবেন, কী কী বিষয়ে আলোচনা হবে, চুক্তি-সমঝোতা স্মারক বা যৌথ বিবৃতি কিংবা সংবাদ সম্মেলন হবে কিনা ইত্যাদি। ফলে দল বা গোষ্ঠীর অগ্রাধিকার যাই হোক, এসব সফরে সাধারণ মানুষের একটাই প্রত্যাশা থাকে, দেশের স্বার্থ আর মর্যাদার সুরক্ষা। পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভারতের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ সফরের আগে নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পর কিছুদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের কথা। ফলে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের প্রেক্ষাপট তৈরিও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের একটা গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হবার কথা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথাযথভাবে সফর শেষ করে দেশে ফিরে এসেছেন এবং জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সমাবেশে তার সাম্প্রতিক ভারত সফরের সময় ভারত সরকারের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টা শ্রী অজিত দোভালের সাথে সাক্ষাতে কী কী কথা হয়েছে সেগুলো বিশদভাবে তাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পান্ডিত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। তিনি যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো বুঝে শুনে দায়িত্ব নিয়ে এবং কথাগুলো যাদের সামনে বলা যৌক্তিক বলে তার মনে হয়েছে তিনি তাদের সামনেই সেই কথাগুলো বলেছেন। তার এই বক্তব্য নিয়ে সুধিজনের মন্তব্য নিয়েই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের যত উৎকণ্ঠা। একজন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব বলেছেন, এসব কথা হয়ে থাকলেও তা প্রকাশ্যে বলা ঠিক হয়নি। তার মানে আমাদের দেশের সরকার পরিবর্তন, যা একান্ত জনগণের এখতিয়ার এবং সার্বভৌমত্বের প্রকাশ, সেটা নিয়ে অন্য দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টার সাথে খোলামেলা আলোচনা করা যেতেই পারে, শুধু প্রকাশ্যে বলাটাই বেঠিক। আপনারা অবশ্য এটা বলতেই পারেন। কারণ, আপনাদের তো আমরা বরাবর সফর পরবর্তী যৌথ বিবৃতি বা সংবাদ সম্মেলনে গৎবাঁধা কথা বলতে শুনে এসেছি। অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়েছে, আমরা পরস্পরকে বুঝতে পেরেছি এবং আগামীতে আরো আলোচনা হবে ইত্যাদি। ফলাফল। যেমন, বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের মিটিংয়ের সংখ্যা বাড়ে কিন্তু পদ্মা-তিস্তার পানি সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে আসেনি।
ইংরেজি পত্রিকার এক সম্পাদক বলেছেন, ‘অপরিপক্ক বক্তব্য’। তিনি সম্ভবত ‘ভারত সফর অত্যন্ত সফল হয়েছে’Ñ এই ধরনের উচ্চারণে পক্কতা খুঁজবার অপেক্ষায় ছিলেন। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে তার নিজস্ব মতামত বলে খুব পাশ কাটাতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তিনি তো ভালোভাবেই জানেন, শপথ গ্রহণের পর মন্ত্রীর কার্যক্রম আর ব্যক্তিগত থাকে না। সরকারি সফর থেকে ফিরে এসে তিনি নিজস্ব মতামত দিয়েছেন, যুক্তি হিসেবে কথাটার ওজন কতটা, একজন অভিজ্ঞ মন্ত্রী আর দলের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে সেটা তার চাইতে কেইবা ভালো জানে। আর সুধিজনদের কথা শুনে তো আমরা লজ্জায় প্রায় মরি মরি, অবশ্য সাহিত্যে লজ্জাকে তো অলংকারেরই মর্যাদা দেয়া হয়েছে। প্রধান বিরোধী দলের মহাসচিব চেয়েছেন ‘ব্যাখ্যা’Ñ আরে মুশকিল! আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি সারাংশ বলেছেন যে ব্যাখ্যা দিতে হবে? উনি তো পুরো ভাব-সম্প্রসারণ করেছেন এবং সেটাও প্রসঙ্গ উল্লেখ পূর্বক, কোনো কিছুই বাদ দেননি। বর্তমান সরকারকে আবারও ক্ষমতায় রাখার প্রয়োজনীয়তা, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি দমনে তার উপকারিতা, এই সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে ভারতের করণীয়, এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সেটার অবদান, চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন না হওয়ায় সামরিক কৌশল নির্ধারণে আর অর্থনীতিতে তার প্রভাব, লক্ষ লক্ষ ভারতীয় বাংলাদেশ কর্মসূত্রে কত মিলিয়ন ডলার পাঠিয়ে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছেন, এই প্রসঙ্গও বাদ দেননি। আর বছরে চল্লিশ লাখ বাংলাদেশি ভারতে গিয়ে তাদের বেসরকারি হাসপাতাল, হোটেল রেস্টুরেন্ট, রেল, উড়োজাহাজ, বিপণিবিতানে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার উড়িয়ে রিজার্ভ বৃদ্ধিতে ক্রমাগত কেমন সহায়তা করে চলছে সেকথাও বলতে বাদ রাখেননি। এমনকি উপসংহারে এটাও বলেছেন, আমাদের ক্ষমতায় রাখলে আখেরে আপনাদেরই লাভ।
এরপরেও যদি ব্যাখ্যা নিয়ে নয়াপল্টন বা গুলশান অফিসে জেদাজেদি করেন তবে ব্যাখ্যার বদলে পাবেন একটা সারমর্ম। এক লাইনের বিবৃতি দেবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ‘আমার কথা প্রচার মাধ্যমে ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।’ চলবে তো এই ব্যাখ্যায়! আমরা সাধারণ মানুষ তো চেয়েছিলাম আপনারা বলবেন, যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় কখনো যাই তবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের ক্ষমতায় রাখার জন্য কোনো সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদেশে গিয়ে দেন-দরবার করবেন না। দেশের সার্বভৌমত্ব আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তাতে বরং আমরা আশ্বস্ত হতাম। একই দিনে রানা দাশগুপ্তরা কালো পতাকা হাতে প্রতিবাদ করলেন। অভিযোগ, ভারতে গিয়ে সংখ্যালঘু নির্যাতন আর মন্দির ভাঙ্গা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিথ্যাচার করেছেন। সরকারি দলকেও প্রচ্ছন্নভাবে দুষলেন, নির্বাচনের আগে দিদি, বৌদি, মাসী ডাকের ফল্গুধারা বইলেও বিপদকালে তাঁদের দেখা মেলে না। মন্ত্রীর অন্য বক্তব্য নিয়ে মনে হয় তাদের কোনো সমস্যা নেই।
একটা মজার ব্যাপার কী দেখুন, এখানে কেউই কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি। আমাদের তো মনে হয়, সত্য কথনের জন্য অন্তত তাকে সাধুবাদ দেয়াই যায়। দেশের রাজনীতিতে সত্য কথন এখন তো প্রায় নির্বাসনে। আপনাদের বেশিরভাগেরই সমস্যা সম্ভবত এক জায়গায়, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী গোপন কথা বলতে গেলেন কেন?’ আর আমাদের সমস্যা ঠিক এই জায়গাতেই। এসব শুনলে আমরা সাধারণ মানুষরা আতঙ্কিত হই, লক্ষ শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অন্যের অনুকম্পার উপর নির্ভরশীল, এমন সত্যের সাথে বসবাস আমরা কেউই করতে চাই না। শুধু মাত্র ক্ষমতায় থাকবার বা যাবার সর্বগ্রাসী অভিপ্রায়ে এমন ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন থেকে আমরা মুক্তি চাই।
ক্ষমতার পালাবদল পাশের দেশের অঙ্গুলি ইশারায় হয়, এমন ধারণাকে আপনারা রাজনীতিবিদরা প্রমাণিত সত্যে দয়া করে পরিণত করবেন না। আর তেমন যদি হতেই থাকে তাহলে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সাধারণ মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে একাত্তরের মতো। তাই আমরা সতর্ক হই এখনই, প্রতিদিন সকালে একবার অন্তত জিজ্ঞেস করি, ‘প্রিয় বাংলাদেশ, তুমি নিরাপদ আছো তো?
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়া।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।