Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সশস্ত্র বাহিনীর সামর্থ্য ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভারতের প্রস্তাব

সম্পাদকীয়-১

| প্রকাশের সময় : ৩ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সামর্থ্য ও সক্ষমতা বাড়াতে নতুন পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর গোপালকৃষ্ণ পারিকর। দুই দিনের ঢাকা সফরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি এ প্রস্তাব দেন। এটি ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। প্রথম সফর হওয়ায় এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্লেষকদের মধ্যে বেশ আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। কেন ও কী কারণে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশকে প্রথম সফর হিসেবে বেছে নিলেন, এ নিয়ে আলোচনা হওয়া স্বাভাবিক। এ বিষয়ে সাবেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘ভারত এই অঞ্চল ছাড়িয়ে তার কৌশলগত অবস্থান জোরদারের পদক্ষেপ নিয়েছে। ভৌগোলিক কারণে ভারতের কৌশলগত অবস্থানের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।’ ভারতের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের গবেষক অধ্যাপক ভরত কনরাড বলেছেন, এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে চায় ভারত। চীন থেকে বাংলাদেশ যে দুটি সাবমেরিন পেয়েছে, তা থেকে বেইজিং হয়তো সুবিধা আদায় করতে চাইবে। মোদির সরকার তা হতে দেবে না। ভারতের আইবিটাইমস-এর এক খবরে বলা হয়েছে, ভারত তার বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষাজনিত প্রয়োজনে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত, তা পারিকরের বাংলাদেশ সফর থেকে স্পষ্ট। খবরে আরো বলা হয়, এ মাসে দিল্লিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার শীর্ষ বৈঠকে একটি নিরাপত্তা সহযোগিতার রূপরেখা সই চূড়ান্ত করাই পারিকরের সফরের মূল লক্ষ্য।
পারিকর সফরে এসে যেসব প্রস্তাব দিয়েছেন, তা মূলত ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, তার নিরাপত্তার জন্য সহযোগিতার নামে বাংলাদেশকে কৌশলে ব্যবহার করা। বাংলাদেশের জন্য এটাই ‘ডেঞ্জারাস’ বা বিপজ্জনক। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এর নিরাপত্তা পলিসি কী হবে এবং তা কীভাবে সাজানো হবে, এটা একান্ত তার নিজস্ব ব্যাপার। আরেক দেশের সহযোগিতার নামে সক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়া বা সাজিয়ে দেয়ার প্রস্তাব কোনোভাবেই শোভন নয়। বরং এটি ঐ দেশের স্বাধীন চিন্তার প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হয়। অনেকটা পরনির্ভরশীল করে তোলার মতো। একটি দেশের সশস্ত্র বাহিনীর লক্ষ্যই হচ্ছে, নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রতিপক্ষের যে কোনো আক্রমণ প্রতিহত করা। বিশেষ করে প্রতিবেশী বা আঞ্চলিক আগ্রাসী শক্তিকে মোকাবেলা করে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করাই তার মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে হুমকি কে হতে পারে, তা অননুমেয় নয়। ভারতই এক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য হয়ে আছে। ভৌগোলিকভাবে দেশটি বাংলাদেশকে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে। এর মধ্যে সীমান্তে বাংলাদেশীদের ধরে নিয়ে নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা, অস্ত্র ও চোরাচালানে মদদ দেয়া, বাংলাদেশের কিছু পণ্য নামমাত্র ঢুকতে দিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্য করা, অভিন্ন নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করাসহ অন্যান্য অন্যায্য আচরণ ধারাবাহিকভাবেই দেশটি করে চলেছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ পররাষ্ট্রনীতিতেও তার প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে ভারতের যা চাওয়ার সবই আদায় করে নিয়েছে। নামমাত্র মাশুলে ট্রানজিটের নামে করিডোর নেয়াসহ মানবিক কারণ দেখিয়ে বিনা মাশুলে মালামালও নিয়েছে। বাংলাদেশের কাছে ভারতের আর কিছু চাওয়ার না থাকলেও, সে এখন তার নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক প্রভাব সুসংহত করার জন্য বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সামর্থ্য ও সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছে। এতে বুঝতে বাকী থাকে না, দেশটি সকল ক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে তার উপর নির্ভরশীল করতে চায়। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কথা বিবেচনা করলে বাংলাদেশের জন্য এটি একটি ভয়ংকর বিপদের কারণ হতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দুই সপ্তাহ আগে চীন থেকে বাংলাদেশ টর্নেডো ও মাইন দ্বারা সুসজ্জিত বানৌজা নবযাত্রা এবং বানৌজা জয়যাত্রা নামে যে দুটি সাবমেরিন পায়, তাতেই ভারতের ‘মাথা খারাপ’ হয়ে গেছে। এতে ভারতের সমরবিদরা কঠোর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন। এর আগে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালালে ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করে। ভারতের এ প্রতিক্রিয়া থেকে প্রতীয়মান হয়, সে চায় না, বাংলাদেশ সমরশক্তিতে বলিষ্ঠ হয়ে উঠুক। তার ভাবগতিতে এটাই প্রকাশিত হয়, বাংলাদেশ তার উপর নির্ভর করুক এবং তার কথামতো চলুক। অথচ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কেন, যে কোনো দেশেরই সমরশক্তিতে বলীয়ান হয়ে আত্মরক্ষা ও আগ্রাসী শক্তিকে মোকাবেলা করার অধিকার রয়েছে। ভারত যে পরমাণু অস্ত্রসহ বিপুল সমরাস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলেছে, রাশিয়া ও ফ্রান্স থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কেনার ঘোষণা দিয়েছে এবং এ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কেনার উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে তো বাংলাদেশ কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। বাংলাদেশ চীন থেকে দুটি সাবমেরিন কেনাতেই ভারতের আঁতে ঘা লেগে গেল কেন? এর নিগূঢ় তাৎপর্য এই যে, চীনের পক্ষে বাংলাদেশকে যে বিপুল বাণিজ্যিক ও সমরাস্ত্র সহায়তা দেয়া সম্ভব, তা ভারতের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়, সেটাই তার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাংলাদেশের উপর থেকে চীনের ইতিবাচক প্রভাব কমানোর জন্যই এখন সে উঠেপড়ে লেগেছে। বাংলাদেশকে তার প্রভাব বলয়ের মধ্যে রাখতে সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বাড়িয়ে ‘শক্তিশালী’ করার নামে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। এটা কে না জানে, প্রত্যেক দেশের সশস্ত্র বাহিনীর নিজস্ব নীতি ও কৌশল থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, সম্ভাব্য ‘হুমকি’ হিসেবে যে দেশ সবচেয়ে বেশি বিবেচিত, সে যদি অন্য দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সামর্থ্য ও সক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়, তবে সেই দেশের সশস্ত্র বাহিনী থাকা ও না থাকার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে কি? ভারতের গবেষকরাই যেখানে এ কথা বলেছেন, চীন বাংলাদেশকে সাবমেরিন দিয়ে যে সুবিধা আদায় করতে চাইবে, তা মোদি সরকার হতে দেবে না, সেখানে ভারতের ‘সামর্থ্য ও সক্ষমতা’ বৃদ্ধির প্রস্তাবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি, তা বোধ করি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই।
আমরা কারো ‘পাকা ধানে মই’ দেয়ার নীতিতে বিশ্বাসী নই। প্রতিবেশীসহ কারো সাথে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাই আমাদের নীতি। অন্যদিকে কেউ তার স্বার্থ হাসিলে বন্ধু সেজে সহযোগিতার প্রস্তাব দেবে, বিশেষ করে যাকে ঐতিহাসিক ও মানসিকভাবে আমাদের জনগণের পছন্দনীয় নয়, এমন কারো প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যেমন আমাদের নিজস্ব নীতি ও কৌশল রয়েছে, তেমনি আত্মরক্ষার্থে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি নিজেদের মতো করে করার অধিকারও রয়েছে। এ নীতি ও কৌশল যদি প্রতিপক্ষের কাছে ‘খোলা বই’-এর মতো হয়ে যায়, তবে তার কোনো অর্থ হয় না। এক দেশের সাথে আরেক দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে বন্ধুত্ব ও হার্দিক সম্পর্ক থাকতে পারে। পারস্পরিক প্রশিক্ষণ ও মতবিনিময় এবং যৌথ মহড়া হতে পারে। তার মানে এই নয়, এক দেশ তার শত্রু ভাবাপন্ন দেশকে মোকাবেলা করার জন্য আরেক দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সামর্থ্য ও শক্তি বৃদ্ধির নামে পরোক্ষভাবে ব্যবহার করবে। আমাদের উচিত হবে, এ ধরনের প্রস্তাব গভীরভাবে ভেবে দেখা। এর সাথে আমাদের আত্মমর্যাদা এবং স্বাধীন ও সার্বভৌমত্বের বিষয়টি জড়িয়ে আছে। এক দেশের স্বার্থের জন্য আরেক দেশের বিরাগভাজন এবং বন্ধুত্ব ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া মোটেও উচিত হবে না।










 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন