বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
রাসূলে আকরাম সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট প্রত্যাশা রাখি তিনি পূর্বের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন। নবী সা. বলেন, রমজানের পর সবচেয়ে বেশি ফযিলতের রোজা হলো আল্লাহর মাস মুহররমের রোজা। (সহীহ মুসলিম) আশুরা সমগ্র উম্মতের জন্য বড় হৃদয়বিদারক ঘটনা। আজ জুমার খুৎবা পূর্ব বয়ানে পেশ ইমাম এসব কথা বলেন।
মিরপুরের ঐতিহ্যবাহী বাইতুল মামুর জামে মসজিদের খতিব মুফতি আব্দুর রহীম কাসেমী জুমার খুৎবা পূর্ব বয়ানে বলেন, খোদাদ্রোহীতা, পথভ্রষ্টতা ও শরীয়ত বহির্ভূত গুনাহের কাজ পরিহার করা হোক পবিত্র আশুরার প্রত্যয়। নবী রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ অনুসরণে তওবা, ইস্তিগফার, জিকির আজকার, কোরআন তিলাওয়াত, রোজাসহ অন্যান্য ইবাদাতের মাধ্যমে অতিবাহিত হওয়া চাই মুসলিম মিল্লাতের অতিব গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ এই দিন। কারণ হাদীসের ভাষ্য, ইসলামী ইতিহাসের উদ্ধৃতি ও বিভিন্ন মনীষীদের পর্যালোচনা মতে আশুরার এ দিনে সাইয়্যেদিনা হযরত আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টি, ফেরাউনের কবল থেকে হযরত মুসা আঃ ও তার অনুসারীদের মুক্তি, হযরত আইয়ুব আ: এর সুস্থতা এবং এই দিনে কিয়ামত সংঘঠিত হওয়াসহ অসংখ্য ঘটনাবলীর তথ্য পাওয়া যায়। এ দিনের রোজার ফযিলত ও গুরুত্ব অপরিসীম । রাসূলে আকরাম সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট প্রত্যাশা রাখি তিনি পূর্বের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন। (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬২)। হযরত ইবনে আব্বাস রাজি, বলেন, আমি রাসূল সাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লামকে রমজান মাস অপেক্ষা আশুরার রোজার চেয়ে অন্য কোন মাসে এত গুরুত্ব দিয়ে রোজা রাখতে দেখিনি । (সহিহ বুখারী, হাদীস নং ২০০৬)। উপরন্তু দ্বীনের কল্যাণে, হক প্রতিষ্ঠায় ক্ষমতালোভী ইয়াজিদের নির্মমতার শিকার হয়ে জীবন দিলেন নবী দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন রাজিয়াল্লাহু আনহু। যার নজির দৃষ্টান্ত বিরল।
খতিব বলেন, তাই আসুন! পবিত্র এই আশুরার দিনে হুসাইন রাজিয়াল্লাহু আনহুর কাল্পনিক তাযিয়া বানিয়ে, শরীর ক্ষত বিক্ষত করে, হায় হাসান, হায় হুসেন স্লোগান তুলে মিছিল করার মত সর্ব প্রকার অপসংস্কৃতি ও গুনাহের কাজ পরিহার করে এ দিনে রোজা রেখে তওবা ইস্তিগফারসহ অন্যান্য ইবাদাতের মধ্যে মশগুল থাকি। সাথে সাথে ইমাম হুসাইন রাজিয়াল্লাহু আনহুর ইসলামের জন্য আত্মত্যাগের চিন্তা করে নিজেদের ঈমান আমলকে উজ্জ্বীবিত করি। আল্লাহ সবাইকে তৌফিক দান করেন । আমিন।
ঢাকা উত্তরা ৩নং সেক্টর মসজিদ আল-মাগফিরাহ এর খতিব মুফতি ওয়াহিদুল আলম বলেন, মুহররম মাস ৪ টি হারাম (সম্মানিত) মাসের অন্যতম। নবী সা. বলেন, রমজানের পর সবচেয়ে বেশি ফযিলতের রোজা হলো আল্লাহর মাস মুহররমের রোজা। (সহীহ মুসলিম) নবী সা. মদিনা শরীফে আগমন করে দেখলেন ইয়াহুদীরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। নবী সা.বললেন, এটা কি? তারা বলল, এটি একটি ভালো দিন। এই দিনে আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরায়েলকে তাদের দুশমনের কবল হতে বাচিয়েছেন। তাই মুসা আ. রোজা রেখেছেন। নবী সা. বলেন, মুসা আ. কে অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি রোজা রেখেছেন ও রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। আশুরার রোজা সম্পর্কে বহুসংখ্যক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। কোনো কোনো ফুকাহায়ে কেরাম শুধু আশুরার দিন রোজা রাখা মাকরূহ বলেছেন। হাদিসের আলোকে নির্জাস কথা হল, আশুরার রোজা তিন ভাবে রাখা যায়। (১) ৯, ১০ ও ১১ তারিখ মোট তিন দিন রোজা পালন সর্বোত্তম। (২) ৯ ও ১০ তারিখ মোট দুই দিন রোজা পালন উত্তম। (৩) শুধু ১০ তারিখ রোজা পালন অনুত্তম।
বিপুল সংখ্যক নবীগণের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক দিন মুহররমের ১০ তারিখ আশুরার দিন। অত্যান্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৬১ হিজরি সালে আশুরার দিন শুক্রবার ইরাকের কারবালায় কিছু মানুষের হতে নবী সা. প্রিয়তম দৌহিত্র হযরত হুসাইন রা. নির্মমভাবে শহীদ হন। আশুরা সমগ্র উম্মতের জন্য বড় হৃদয়বিদারক ঘটনা। আশুরার দিনকে কেন্দ্র করে সকল প্রকার বানোয়াট রীতি নীতি ও অপসংস্কৃতি পরিহার করা খুবই জরুরি।
ঢাকার ডেমরার ঐতিহ্যবাহী দারুননাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদরাসা জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মো.মনিরুল ইসলাম বলেন, আশুরার ফযিলত সর্ম্পকে অহবিত হয়ে বেশি বেশি তওবাহ ইস্তিগফার করতে হবে। রাসূল সা. ইরশাদ করেন, আশুরার দিনে রোজা রাখলে আল্লাহপাক এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন। রাসূল সা. নিজেই আশুরার দিন আর আগের দিন রোজা রাখতেন। খতিব বলেন, আশুরার দিন তাযিয়া বানিয়ে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করে বিলাপ করা হারাম কাজ। উল্লেখিত দিনের ফযিলতের গুরুত্ব অনুধাবন করে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগিতে কাটাতে হবে। আল্লাহ সবাইকে দ্বীনের ছবি বুঝ দান করুন। আমিন।
মিরপুরের বাইতুল আমান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতীব মুফতি আবদুল্লাহ ফিরোজী বলেন, হিজরি বছরের প্রথম মাস মুহাররামুল হারাম শুরু হয়েছে। এ মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। এ মাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এদিনে আল্লাহ তায়ালা তাঁর কুদরত প্রকাশ করেছেন। বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বানিয়ে তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তায় ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন। (সহীহ বুখারী ১/৪৮১)। এ মাসে রোজা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমজানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা হল সর্বশ্রেষ্ঠ।’ (সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮)। এর মধ্যে আশুরার রোজার ফযিলত আরও বেশি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।' (সহীহ বুখারী ১/২১৮)। অন্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহ তায়ালা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।' (সুনান তিরমিযী ১/১৫৮)। আশুরার রোজা সম্পর্কে আরেকটি হাদীসে আছে, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখো এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোজা রাখো।' (মুসনাদে আহমদ ১/২৪১)। অনেকেই ধারণা করেন, আশুরার ফযিলত কারবালার প্রান্তরে নবীজী সা. এর দৌহিত্র হযরত হোসাইন রা. এর শাহাদাতের সাথে সম্পৃক্ত। অথচ বিষয়টি তেমন নয়। বরং আশুরার ফযিলত বহু আগে থেকেই।
খতিব আরও বলেন, আশুরার দিন রোজা রাখার পাশাপাশি আমাদের বেশি বেশি তওবা ইস্তিগফার ও অন্যান্য নেক আমল উচিত। দ্বীনের খাতিরে হযরত হোসাইন রা. যে ত্যাগ-তিতিক্ষা পেশ করেছেন তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে দ্বীনের জন্য যে কোন ত্যাগ ও কোরবানির জন্য প্রস্তুত থাকা। এই দিনে বর্জনীয় বিষয় হচ্ছে, তাযিয়া অর্থাৎ, হযরত হোসাইন রা. এর নকল কবর বানানো। এটা বস্তুুত এক ধরণের ফাসেকী ও শিরকী কাজ। কারণ মূর্খ লোকেরা ‘হযরত হোসাইন রা. এতে সমাসীন হন’ এই বিশ্বাসে এর পাদদেশে নযর-নিয়ায পেশ করে, এর সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ায়, এর দিকে পিঠ প্রদর্শন করাকে বেয়াদবি মনে করে, তাযিয়ার দর্শনকে ‘যিয়ারত’ বলে আখ্যা দেয় এবং এতে নানা রকমের পতাকা ও ব্যানার টানিয়ে মিছিল করে, যা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম। এছাড়া মর্সিয়া বা শোকগাঁথা পাঠ করা, এর জন্য মজলিস করা এবং তাতে অংশগ্রহণ করা সবই না জায়েয (ইমদাদুল ফাতাওয়া, ৫/২৯৪,৩৩৫)। ‘হায় হোসেন’, ‘হায় আলী’ ইত্যাদি বলে বলে বিলাপ ও মাতম করা এবং ছুরি মেরে নিজের বুক ও পিঠ থেকে রক্ত বের করা। এগুলো করনেওয়ালা, দর্শক ও শ্রোতা সবার প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন। (আবূ দাউদ, হা. নং ৩১২)। এছাড়াও শরীয়ত বিবর্জিত অন্যান্য কাজ থেকে এদিন বিরত থাকা। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আমল করার তৌফিক দান করেন, আমীন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।