Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নানা সমস্যায় সায়েদাবাদ টার্মিনাল

অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও নিরাপত্তাহীনতায় যাত্রীরা প্রবেশ করে না : রাস্তার উপর দূরপাল্লার বাস কাউন্টার : সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য

| প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল। দেশের পূর্বাঞ্চলের ১৮টি জেলার সড়ক পথের যাত্রীদের নির্ভরতার কেন্দ্র। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীন এ টার্মিনালটি নানা সমস্যায় জর্জরিত। অবহেলা, অপরচ্ছিন্ন পরিবেশ আর চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে এখানে পরিবেশ বলতে কিছু নেই। সে কারণে দূরপাল্লার বাসগুলো টার্মিনালকে গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করে। পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের একাধিক কমিটির চাঁদাবাজদের সাথে চিহ্নিত সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, মলমপার্টির আনাগোনাও আছে এখানে। তাদের ভয়ে মালিক, শ্রমিক এমনকি যাত্রীরাও থাকে আতঙ্কিত। অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা আর অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে ঐতিহ্যবাহী এই টার্মিনাল নিয়ে যাত্রীদের সাথে পরিবহন মালিকরাও বিরক্ত।  
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ সালে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হয় অতি পুরাতন সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল। নতুন টার্মিনালে মূল ভবন ছাড়াও রয়েছে সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও নোয়াখালী অঞ্চলের জন্য পৃথক পাঁচটি কাউন্টার ভবন। তবে হানিফ পরিবহন, সৌদিয়া পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন, একুশে পরিবহন, গ্রীনলাইন পরিবহনের মতো জনপ্রিয় বাস সার্ভিসের কোনো কাউন্টার নেই এই টার্মিনালে। ঢাকা থেকে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী ইশরাত পরিবহন, সৌখিন পরিবহন, পর্যটক পরিবহন, বনফুল পরিবহন, মেঘনা পরিবহন, পদ্মা পরিবহন, ঈগল পরিবহন, উজালা পরিবহন, মামুন পরিবহনসহ আরও কিছু লোকাল বাসের কাউন্টার থাকলেও টার্মিনাল থেকে এসব পরিবহনে যাত্রী উঠে না। যাত্রী পাওয়ার জন্য সবগুলো পরিবহনের টার্মিনালের বাইরে একাধিক কাউন্টার আছে। সেখান থেকেই যাত্রী তোলা হয়। আলাপকালে কাউন্টার মাস্টাররা জানান, টার্মিনালের ভিতরে আগের সেই পরিবেশ আর নেই। পুরো টার্মিনাল জুড়েই ভাঙ্গাচোরা রাস্তা, ম্যানহোল আর ময়লা আবর্জনাযুক্ত দুর্গন্ধময় পরিবেশ। সেখানে পরিবার পরিজন নিয়ে সুস্থ মানুষ ১০ মিনিট দাঁড়াতে পারে না। পুরো টার্মিনালজুড়েই হকারদের উৎপাত, পকেটমার, ছিনতাইকারী, মলমপার্টির সদস্যদের দৌরাত্ম্য। যাত্রীদের কোনো নিরাপত্তা নেই। এদের সাথে আছে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও তাদের ক্যাডারদের আড্ডা। এসব কারণে টার্মিনালের ভিতরে ভদ্র যাত্রীরা প্রবেশ করতে চান না। তারা রাস্তার উপর কাউন্টার থেকে বাসে ওঠেন। টার্মিনালের ভিতরে বাথরুমগুলো অপরিচ্ছন্ন ও দুর্গন্ধযুক্ত। সিটি কর্পোরেশনের অধীন হলেও এখানকার টয়লেট ব্যবহারের জন্য টাকা লাগে।
আলাপকালে আন্তঃজেলা বাসের একজন ম্যানেজার বলেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দুই ভাগে ভাগ হওয়ার পর উত্তরের দুই আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল গাবতলী ও মহাখালীর চেহারা অনেকটাই পাল্টে গেছে। সে হিসাবে সায়েদাবাদের অবনতি হয়েছে। গাবতলী টার্মিনালের বাইরের রাস্তায় ফুটপাতগুলো হকারমুক্ত। রাস্তার উপর কোনো বাস বা যানবাহন দাঁড়াতে পারে না। সব গাড়ি টার্মিনালের ভেতর থেকে ছাড়ে। গাবতলীতে একটা গাড়ি টার্মিনাল থেকে বেরুতে কোনো সময় ক্ষেপণ হয় না। কিন্তু সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে বেরুতে গেলে প্রতিটি গাড়িকে কমপক্ষে আধা ঘন্টা ব্যয় করতে হয়। টার্মিনালের প্রবেশ ও বেরুনোর পথ বন্ধ করে বসানো হয়েছে হকারদের দোকান পাট। টার্মিনাল ফাঁড়ি পুলিশ টাকার বিনিময়ে দোকানগুলো বসিয়েছে।
সরেজমিন সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে, টার্মিনালের দুই প্রান্তে মিশেছে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের দুটি শাখা। টার্মিনাল থেকে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য রয়েছে তিনটি পথ। টার্মিনালের সাথেই জনপথ মোড়, যেখানে গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত কাউন্টার। উপচে পড়া ভিড় আর থেমে থাকা বাসের কারণে সেখানে যানজট লেগে থাকে রাতদিন। টার্মিনালের ভিতরের রাস্তাগুলোতে স্থানে স্থানে জমে আছে আবর্জনা ও ময়লাপানি। কিছু কিছু স্থানে মাসের পর মাস পড়ে আছে অকেজো বাস। অনেকে আবার গাড়ি মেরামত, এমনকি রংয়ের প্রলেপ দেওয়ার কাজও সারছেন টার্মিনালের জায়গা দখল করে। টার্মিনালের ভেতরে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলও আছে বেশ কয়েকটি। মাঝে মধ্যে সেগুলোতে যাত্রীরা পড়ে দুর্ঘটনা ঘটে। আবার চলতে গিয়ে গাড়ির চাকা আটকে যায় বলে জানান পরিবহন শ্রমিকরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের এক নেতা জানান, টার্মিনালে যাত্রীরা যাতে না আসে সেজন্য একটি মহল তৎপর। তারা চান বাইরে থেকে যাত্রী উঠুক। এতে করে রুট কমিটির চাঁদার অঙ্ক বাড়ে। তাতে মালিক শ্রমিকদের লোকসান হলেও বিশেষ মহলের লাভ বেশি। আন্তঃজেলায় চলাচলকারী চেয়ারকোচ পরিবহনের এক মালিক জানান, টার্মিনালের ভেতরের পরিবেশ যাত্রীদের জন্য উপযুক্ত না হওয়ায় তারা বাধ্য হয়েই বাইরে কাউন্টার বসিয়েছেন। একুশে পরিবহনের এক কর্মকর্তা বলেন, টার্মিনালের ভেতরে যাত্রীদের নিরাপত্তা নেই, বিশ্রাম ও টয়লেটের ভালো ব্যবস্থা নেই। সেখানে চোর-বাটপার শ্রেণির লোকজনের আড্ডা। তিনি বলেন, আমাদের চেয়ারকোচ গাড়িগুলো সেখানে গেলে উল্টো আরও যাত্রী হারাবে, ব্যবসার ক্ষতি হবে।
টার্মিনালের অব্যবস্থাপনা ও সুষ্ঠু পরিবেশের কারণেই ১৮ জেলার দূরপাল্লার বাসগুলো সায়েদাবাদ জনপথ মোড়, পার্শ্ববর্তী ধলপুর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত রাস্তা দখল করে কাউন্টার বসিয়েছে। কমলাপুর স্টেডিয়াম থেকে সায়েদাবাদ টার্মিনাল পর্যন্ত রাস্তার উপর শত শত গাড়ির বহর। এসবের কারণে এই রাস্তায় দিন রাত যানজট লেগে থাকে। পুলিশ এগুলো গাড়ি থেকে বাড়তি টাকা পায় বলে তারা রাস্তার উপর থেকে গাড়িগুলো সরানোর কোনো ব্যবস্থা নেয় না বলে অভিযোগ করেন সিলেট রুটে চলাচলকারী এক পরিবহন কোম্পানীর মালিক। আমাদের নেতারা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাহেবকেই একাধিকবার এ বিষয়ে বলেছেন। ট্রাফিক পুলিশের ডিসি ও ওয়ারী জোনের ডিসির সাথে একাধিকবার মিটিং করেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। বরং দিন যতো যাচ্ছে পরিবেশ ততোই বিঘিœত হচ্ছে। টার্মিনালের বাইরে রাস্তায় ভিড় বাড়ছে।
এসব ছাড়াও টার্মিনালে চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপের দৌরাত্ম্য আছে। রুট কমিটিগুলোতে টাকার বিনিময়ে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বসানো হয়েছে। তারা তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য সন্ত্রাসীদের ভাড়াটে হিসাবে ব্যবহার করছে। ওই সব সন্ত্রাসীদের লালন করতে গিয়ে রুট কমিটির নেতারা চাঁদার অঙ্ক দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আলাপকালে একাধিক রুটের বাসের মালিক বলেন, একেকটা রুট কমিটিতে এমন কিছু ব্যক্তিকে বসানো হয়েছে যাদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ এক ডজনেরও বেশি মামলা রয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খায়রুল মোল্লা হত্যার প্রধান আসামীও এখন সায়েদাবাদ টার্মিনালে আসা যাওয়া করে। তাকে খোদ আওয়ামী লীগেরই কেউ কেউ প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দুর্ধর্ষ ওই সন্ত্রাসীর বিচরণে মালিক শ্রমিকদের অনেকেই আতঙ্কিত। সায়েদাবাদ টার্মিনালের সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, টার্মিনালের আগের পরিবেশ আর নেই। মালিক ও শ্রমিকদের চেষ্টায় অনেক অনিয়মই দূর হয়েছে। আগে টার্মিনালে প্রাইভেট কার ঢুকতে পারতো না। এখন ঢুকছে। রেলগেইট থেকে জনপথ মোড় পর্যন্ত এখন আর কোনো যানজট নেই। তিনি বলেন, টার্মিনালে আসলেই দেখতে পাবেন আগের অনেক কিছইু এখন পাল্টে গেছে।
 


















































































































































































































    



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ