পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দক্ষিণ এশিয়ায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা, সামাজিক-অর্থনৈতিক মানদণ্ডে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ছিল বাংলাদেশ তো বটেই, ভারত-পাকিস্তানেরও অনেক উপরে। প্রায় দুই দশকের গৃহযুদ্ধের ধকল কাটিয়ে দেশটি যখন অর্থনৈতিকভাবে আবারো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, তখনি সে দেশের কর্তৃত্ববাদী শাসক রাজাপাকসের পরিবার নিজেদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ধরে রাখতে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের ফানুস উড়াতে শুরু করেছিল। কিন্তু জনগণ কখনোই অবকাঠামো উন্নয়নে মজে যায় না। জনগণ সব সময় নিজেদের সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রশ্নকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। দেশে দেশে যুগে যুগে এটা বার বার প্রমানিত হয়েছে। জনগণের সম্পদের বেহিসাব খরচ করে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পকে উন্নয়নের সাফল্যের প্রচারণার উপাদানে পরিনত করে কর্তৃত্ববাদী শাসকরা জনগণকে বোকা বানাতে চায়। রাজাপাকসের পরিবার শ্রীলঙ্কায় সে কাজ করতে গিয়ে জনগণের কাছে ধরা খেয়ে বিতাড়িত হতে বাধ্য হয়েছে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ গুরুত্বপূর্ণ পদের প্রায় সবাই ছিল রাজাপাকসে পরিবারের সদস্য অথবা তাদের অনুগত-আশীর্বাদপুষ্ট। বছরের পর বছর ধরে তারা জনগণের সম্পদ লুন্ঠন করে বিদেশে শত শত কোটি ডলার সম্পদের পাহ্ড়া গড়ে তুলেছে। বৈদেশিক ঋণ নিয়ে মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে এই সম্পদ পাচার করা হয়েছে। কোটি কোটি মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকলেও দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক ক্ষমতাধর পরিবারগুলোর সম্পদ লুন্ঠনের কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না। গত কয়েক বছর ধরেই শ্রীলঙ্কা থেকে সম্পদ পাচারের প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল। সম্পদের পুঞ্জিভবন এবং জনগণের আয়বৈষম্য, বিনিয়োগে মন্দা ও কর্মসংস্থানের সংকট দেশে মূল্যস্ফীতিকে ঊর্ধ্বমুখী করে তুলেছিল। আমদানিনির্ভর জ্বালানি ও খাদ্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে একদিকে সাধারণ মানুষ নীরব দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছে, অন্যদিকে এই ডিজিটাল যুগে বিদ্যুৎ বঞ্চিত মানুষ তথাকথিত উন্নয়নের আসল চেহারাটা দেখতে পাচ্ছে।
বছরের শুরুতেই শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছিল। দুর্মুখ অনেকেই বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতির আশঙ্কা প্রকাশ করতেই সরকারের পক্ষ থেকে তা বিদ্রুপাত্মকভাবে উড়িয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কা নয়, বাংলাদেশের তুলনা হবে ইউরোপ-আমেরিকার সাথে। তাদের এ কথায় জনগণ আশ্বস্ত হওয়ার জন্য যেটুকু সময় প্রয়োজন, তার আগেই বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কা সিম্পটম দেখা দিতে শুরু করেছে। গত তিন-চার মাসে যে হারে টাকার মান কমেছে এবং ডলারের দাম বেড়েছে, গত ৫০ বছরে আর কখনো এমনটি দেখা যায়নি। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি দেশে মূল্যস্ফীতির লাগামহীনতা নির্দেশ করে। করোনাকালীন বাস্তবতায় মানুষের গড় আয় কমেছে। কর্মহীন কোটি কোটি মানুষ এখনো আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। এরই মধ্যে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বোঝার উপর শাকের আঁটি নয়, বালির বস্তা হয়ে চেপে বসেছে। তারা এখন নিত্যপণ্যের বল্গাহীন মূল্যস্ফীতির নিচে চাপা পড়তে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতি আর কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন বা গণআন্দোলনের অস্থিতিশীলতা বা বিশৃঙ্খলার ধকল সামলাতে পারবে না। গণতন্ত্রহীনতা ও একতরফা দখলবাজির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক-সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে না পারা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাশিত পরিবর্তন না আসা এবং দেশের সম্পদ পাচারের ঘটনায় জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ এক সময় গণবিস্ফোরণে পরিনত হয়। শ্রীলঙ্কার ঘটনা বাংলাদেশের সরকার, জনগণ ও সব রাজনৈতিক দলের জন্য অনেক বড় শিক্ষা। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরণ ও উন্নয়নে একটি সামাজিক-রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে তোলার এখনই সময়। দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনে দেশের বিরোধীদলগুলো আপাত দুর্বল বা নেতৃত্বশূন্য হতেই পারে, কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপটে জাতি নতুন নেতৃত্বের প্রতীক্ষায় থাকে এবং সময়মত সে প্রত্যাশিত জাতীয় নেতৃত্বের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ব্যাপক গণআন্দোলনে জনগণের রাজনৈতিক উত্থানের মধ্য দিয়ে প্রত্যাশিত নেতৃত্বের আত্মপ্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলিত, নিয়ন্ত্রিত করার মধ্য দিয়ে বিকল্প শক্তির উত্থানের আশঙ্কা দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তিগুলোই সৃষ্টি করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।
উগ্র জাতীয়তাবাদী ও পরিবারতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী শাসকরা জাতির উন্নয়নের প্রয়োজনে নিজেদেরকে দেশের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করে। এই ধারণা জনগণের মনোজগতে প্রোথিত করতে তারা সুর্নিদ্দিষ্ট কিছু শ্লোগান সর্বস্ব প্রোপাগান্ডা এবং পরিকল্পিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট যুগের ফরাসি দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, রাষ্ট্রচিন্তক ও বিচারক মন্টেস্কু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত শাসকের ডেসপটিজম বা স্বৈরাচারি শাসন রুখতে এবং জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ক্ষমতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সমন্নুত রাখতে সেপারেশন অফ পাওয়ার ধারণার উপর জোর দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং দায়দায়িত্ব প্রতিপালনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, নির্বাহী বিভাগের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের উপর ভারসাম্য আরোপ করা এবং জনগণের ক্ষমতা তথা রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের সব ধরণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। ‘স্পিরিট অব ল’ (১৭৪৮) বইতে মন্টেস্কু তার এই ধারণার বিশদ বিবরণ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। ইউরোপের দেশগুলো তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মন্টেস্কুর এই মডেলকে সাদরে গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের অভিভাবকের ভূমিকায় মন্টেস্কু নিয়মতান্ত্রিক বৃটিশ মনার্কি বা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রকে একটি আদর্শ মডেল বলে গণ্য করেছিলেন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদাররা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা এবং জনগণের নির্বাচনী ক্ষমতার উপর বেশি জোর দিয়েছেন। জনগণের শিক্ষা, সংস্কৃতি, নৈতিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ, ন্যায়পরায়ণতা ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষা করা অসম্ভব। মিথ্যাবাদী, অসৎ, লোভী, ঔদ্ধ্যত্বপূর্ণ ও কর্তৃত্ববাদী মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত হলেই ডেমোক্রেসি ডেসপটিজমে পরিনত হয়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের আসল রূপ জনগণের মধ্যে উন্মোচিত হয়ে পড়লে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তারা জনগণের ভোটাধিকার হরণের পথ বেছে নেয়। বিশ্বের দেশে দেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে এর অসংখ্য নজির রয়েছে। উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দর্শনকে সামনে রেখে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জার্মানিতে হিটলারের মত শাসকের অভ্যুদয় হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে পাওয়ার অব সেপারেশনের উপর জোর দিয়ে ইউরোপে স্বৈরাচারি শাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব হয়েছে। জনগণের সদিচ্ছা এবং সুযোগ্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও নেতৃত্ব ছাড়া এটা সম্ভব নয়। পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সংহত করতে সক্ষম হলেও সাবেক ঔপনিবেশিক অঞ্চলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার বদলে নিজেদের স্বার্থে সামরিক-বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্রের প্রভাব অক্ষুন্ন রাখতেই বেশি আগ্রহী দেখা যায়। একমাত্র ইসরাইল ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের আর কোনো দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করতে না পারার জন্য পশ্চিমাদের স্বার্থপরতা ও ষড়যন্ত্র দায়ী। পঞ্চাশের দশকে ইরানে মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোসাদ্দেক সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে ইঙ্গ-মার্কিন গোয়েন্দা তৎপরতার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আবারো পাহলভি রাজপরিবারের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল। হাজার বছরে মিশরে প্রথম নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে আবারো সামরিক স্বৈরাচারের হাতে ক্ষমতার নেপথ্যে পশ্চিমা শাসক এবং তাদের বশংবদ আরব রাজপরিবারগুলোর ভূমিকা গোপণ থাকেনি।
শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে পরিবারের পতনের পর বিভিন্ন দেশে তাদের হাজার কোটি ডলারের সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ফিরিস্তি প্রকাশিত হচ্ছে। এই সম্পদের সিকিভাগও যদি শ্রীলঙ্কার ট্রেজারিতে ফিরিয়ে আনা যেত, তাহলে সে দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট হয়তো অনেকটাই দূর হয়ে যেত। গত একযুগে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। বিগত দশকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সময় আমরা যখন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের দুর্দশায় নিপতিত, তখন দেশের নব্য ধনীরা সুইসব্যাংক, কানাডা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ নানাদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। দেশ থেকে সম্পদ পাচারের প্রভাব এখন ক্রমেই প্রকট আকারে দেখা দিচ্ছে। প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী দেশে রেমিটেন্স পাঠিয়ে এবং প্রায় অর্ধ কোটি গার্মেন্টস কর্মীর পরিশ্রমে হাজার হাজার বিনিয়োগকারির বিনিয়োগে দেশে হাজার কোটি ডলারের রফতানি আয়ের মাধ্যমে মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকা বাংলাদেশ এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি কিনে উৎপাদন অব্যাহত রাখার সামর্থ্য হারাতে বসেছে। বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়টি সামনে রেখে অর্ধশতাধিক রেন্টাল-কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাথে অসম চুক্তি করে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ না নিয়েই গত এক দশকে ৭০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। এসব টাকা দেশের বিনিয়োগ বা শিল্পায়নে কোনো কাজে আসেনি, বেশিরভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এখন রফতানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয়ের ব্যবধান অনেক বেশি হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভের যে স্থিতি রয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ চার মাসের ব্যয়নির্বাহ করা সম্ভব হতে পারে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং টাকার মানের ক্রমাবনতি থেকে বুঝা যায়, আমদানির নামে বা ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় অর্থপাচার অব্যাহত রয়েছে। দুই বছর আগেও শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া দশা কেউ আন্দাজ করতে পারেনি। ইতিমধ্যে রাজাপাকসেরা পালিয়ে গেছেন। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সঙ্কট এখন রাজনৈতিক সঙ্কটে পরিনত হয়েছে। এই সেদিনও আমাদের মন্ত্রী-এমপিরা বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতির আশঙ্কাকে বিদ্রুপের স্বরে উড়িয়ে দিয়েছেন। এখন কিন্তু তাদের গলার স্বর অনেকটা অনুচ্চ হয়ে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার কর্তৃত্ববাদী শাসকরা জনগণকে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প দেখিয়ে ভেতরের অন্তঃসারশূন্যতা ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছিলেন, তাদের শেষরক্ষা হয়নি। বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মত না হলেও দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ক্ষমতার পালাবদলে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা না হলে, দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ দেখা দিলে, উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হলে, দেশের সামগ্রিক অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা আন্দাজ করা খুব কঠিন নয়।
‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’ স্বৈরাচারি শাসনের ক্ষেত্র যখন উগ্রজাতীয়তাবাদ ও গোষ্ঠীতন্ত্রে পরিনত হয়, তখন দেশ ও দলের মুখ্য নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। নব্বইয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জনগণের বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা প্রেসিডেন্ট শাসিত গণতন্ত্র থেকে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে পদার্পণ করেছিলাম। সে সময় প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক সংকটের মুখে নির্বাচনকালীন অন্তবর্তিকালীন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। পাকিস্তানে দুর্নীতির দায়ে প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর পতন ঘটলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান ইন্টেরিম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইসলামি জমুহরি ইত্তেহাদ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও পার্লামেন্ট মেম্বার গোলাম মোস্তফা জাতুইকে নিয়োগ দেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে দেশের প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে। যদিও গত ত্রিশ বছরে পাকিস্তানে কোনো নির্বাচিত সরকারই পূর্ণমেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। গত তিন দশকে পাকিস্তানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে আটবার শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। সামরিক হস্তক্ষেপ বা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পরিহারে এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রমানিত হয়েছে। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোনো দলের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার নজির নেই। জাপানে ইন্টেরিম সরকার ব্যবস্থা না থাকলেও সেখানে যখন তখন যেকোনো ইস্যুতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে থাকে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে যখন নবম জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন, প্রায় একই সময়ে জাপানে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির বিজয়ের মধ্য দিয়ে ৯৩তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তারো অসো। এরপর গত একযুগে জাপানে ৭ জন প্রধানমন্ত্রীর পালাবদল ঘটলেও সে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিতে কোনো হেরফের ঘটেনি।
বহুদলীয় গণতন্ত্রে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ এবং সুযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা জাতীয় স্বার্থেই অপরিহার্য। দলের ভেতর নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকায় অর্থবিত্ত ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডই হয়ে উঠেছে নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের মূল যোগ্যতা। আমাদের জাতীয় সংসদে গণতান্ত্রিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের যৌক্তিক চর্চাকে আইন করে রুদ্ধ করা হয়েছে। হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ নিয়েও এমপি-মন্ত্রীরা বহালতবিয়তে বীরদর্পে বিচরণ করতে পারেন।গত এক মাসে ইংল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং ইতালিতে প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। জনগণের আন্দোলনের মুখে নয়, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, নৈতিক মূল্যবোধের প্রশ্নে ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও অসততার প্রশ্নে নিজদল ও কোয়ালিশনের নির্বাচিত সহকর্মীদের দাবি ও অনাস্থার মুখে তারা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পদত্যাগের পর নিজ দলে বরিস জনসনের প্রতি সমর্থন বেড়ে গেছে। তবে পরবর্তি নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বরিস জনসনই অন্তবর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। সেপারেশন অব পাওয়ার এবং রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ও জনগণের মধ্যে নৈতিক-গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তৃত্ববাদী হওয়া অনেক দূরের কথা, ন্যুনতম স্খলনের পর ক্ষমতায় চেয়ারে থাকার সুযোগ না থাকায় সেখানে ভোট ডাকাতি বা ফেইক ইলেকশনের মাধ্যমে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কোনো সুযোগ নেই। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিকদের এখন গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রকৃতি ও ফলাফল বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য অগ্নি পরীক্ষা। অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে সেই পরীক্ষার কাউন্ট-ডাউন ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এখন সরকার ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে নিজেদের অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।