চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
॥ এক ॥
রাসূলের আরবে আগমনের প্রেক্ষাপট : সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল প্রেরণের জন্য করুণাময় আল্লাহ তা’য়ালার দৃষ্টি আরবের মক্কা ভূমির ওপর পতিত হলো কেন, এর কারণ অনুসন্ধান করলে একাধিক উত্তর পাওয়া যাবে। যেমন- ভৌগোলিক কারণ:- মক্কা নগরী মোটামুটিভাবে ভু-ম-লের মধ্যভাগে অবস্থিত, আরব দেশ থেকে যত সহজে অন্যান্য দেশে যাতায়াত করা যায়, অন্য কোনো দেশ থেকে আদৌ তা সম্ভব হয় না। সারা জগতের মুক্তির কা-ারির ভূ-ম-লের মধ্যস্থলে অবস্থিত মরুময় আরব দেশে আবির্ভূত হওয়াই সঙ্গত ছিল।
আরবের অনন্য বৈশিষ্ট্য: আরব জাতি ব্যতীত অন্যপ্রত্যেক জাতিই মানুষের রচিত এক একটা ধর্ম পদ্ধতির অনুসারী ছিল। তাছাড়া পৃথিবীর সকল অনাচারের প্রতিকার ও সকল অবিচারের প্রতিবিধান করার জন্য যিনি আসবেন তাঁকে এমন দেশে আবির্ভূত হওয়াই সঙ্গত, যেখানে তিনি অল্প চেষ্টাতেই নিজের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য কতিপয় উপযুক্ত সহচর পাবেন। আরব ছাড়া আর কোথাও মনে হয় এটা সম্ভব ছিল না। অন্য সকল দেশ ও অঞ্চলে তখন পুরোহিতদের প্রচ- প্রতাপে মানুষের জ্ঞান বিবেক সষ্পূর্ণরূপে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তাই মানবজাতির ত্রাণকর্তা, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূলকে প্রেরণের জন্য সর্বজ্ঞ আল্লাহ তা’য়ালার রহমতের দৃষ্টি আরব মরু ভূমির মক্কা নগরীকেই মনোনীত করে।
জন্ম:-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র জন্ম কোন সময়ে : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন সময় ভূমিষ্ট হয়েছেন এতে মতভেদ রয়েছে। একদল ওলাময়ে কিরামের অভিমত এই যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম রাত্রে হয়েছে। তাদের যুক্তির সপক্ষে দলিল হলো- হযরত ওসমান বিন আবিল আস (রা.) তাঁর মাতা হযরত ফাতিমা বিনতে আবদুল্লাহ ছক্বীকাহ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন যে, আমি রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় উপস্থিত ছিলাম। তখন তাঁর ভূমিষ্ঠকালীন সময়ে আমি নিজেই দেখেছি যে, সমগ্র ঘর নূরের আলোকরশ্মি দ্বারা প্রজ্বলিত হয়ে গিয়েছিল। আকাশের তারকারাজিগুলোকে দেখেছি আকাশ থেকে এতো নিচে নেমে এসেছিল যে, আমার মনে হলো আমার মাথার ওপর এসে পড়েছে। আর তারাকারাজি কেবল রাত্রেই দৃষ্টিতে আসে, অন্য সময়ে নয়। ওলামায়ে কিরাম দিনে হওয়াকে বিশুদ্ধ বলেছেন, তাঁরা ইমাম মুসলিম ইত্যাদির বর্ণিত হাদীসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সেখানে বর্ণিত আছে যে, সূবেহ সাদিক উদ্ভাসিত ও প্রকাশিত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর জন্ম হয়। তারকারাজি তো উষালগ্ন ফোটার পরও দেখা যায়। শায়খ দাববাগ (রহ.) বলেছেন, তাঁর পবিত্র জন্ম সূবেহ সাদিক উদিত হওয়ার অনেক পূর্বে শেষ রাত্রে হয়ে ছিল। কিন্তু মাতা থেকে পৃথক হওয়ার সময় ছিল সূবেহ সাদিক। আর তাঁর মায়ের গর্ভ থেকে বের হওয়ার সময়কাল অর্থাৎ নাভির সাথে সংযুক্ত নল বের হওয়া এবং মা থেকে পৃথক হওয়ার মাঝখানে রাত্রের এক ষষ্ঠমাংশের কাছাকাছি ২ ঘণ্টা সময় ছিল। ঐ সময়টি দু’আ কবুলের অন্যতম মোক্ষম সময়। যার ফযীলত ও মাহাতœ্য সম্বন্ধে অসংখ্য হাদীস বিধৃত রয়েছে। ইহার বুযুর্গী ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়েছে। এমনকি কিয়ামত অবধি যে কেহ এ মুবারক সময়ে দু’আ করবে, তা অবশ্যই কবুল করা হবে। শায়খ দাববাগ (রহ.) বলেছেন, তাঁর মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময় ছিল ১০ মাস।
(২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র জন্ম কোন মাসে :-
হযরত শায়খ আবদুল আজিজ দাববাগ (রহ.) বলেছেন; রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জন্ম মাস সম্বন্ধে ওলামায়ে কিরামের মাঝে রয়েছে অনেক মতভেদ। কেউ বলেন, সফর মাস, কেউ বলেন, রবিউসসানী, কেউ রজব মাস বলেছেন, কেউ বলেছেন রমযান মাস। কেউ বলেছেন, আশুরার দিবস। আবার কারো মতে, নির্দিষ্ট মাস কোনটি কারো জানা নেই। শায়খ (রহ.) বলেছেন, তাঁর পবিত্র জন্ম মাস রবিউল আউয়াল মাস ছিল। পবিত্র জন্মের মাস রবিউস সানি, রজব ও রমজান মাস বলা এগুলো সবই খুব দুর্বল উক্তি যুরক্বানীর বরাত দিয়ে মাওলানা ইদ্রিস কানদেহলভী এ কথা বলেছেন। আর জমহুর ওলামায়ে কিরামের মতে পবিত্র জন্মের মাস হলো রবিউল আউয়াল। আল্লামা ইবনে জওযী একথার ওপর ওলামায়ে কিরামের ঐকমত্য ও ইত্তেফাক রয়েছে বলে বর্ণনা করেন। হযরত মুফতী শফী দেওবন্দী সাহেব “আওজযুল সীয়র” কিতাবে লিখেছেন যে, একথার উপর জমহুর ওলামা ঐক্যমত যে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জন্ম রবিউল আউয়াল মাসে। যে বছর ইয়েমেনী বাদশা আবরাহ কর্তৃক হস্তী বাহিনী দ্বারা বায়তুল্লাহ আক্রমণ করা হয়েছিল।
(৩) রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের কোন তারিখে:- হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের কোন তারিখে হয়েছেন এতে মতভেদ রয়েছে। ইতিহাসের আলোকে আটটি উক্তি পাওয়া যায়। যথা (১) ২ তারিখ-ইহা হাফিজ মোগলতায়ী গ্রহণ করেছেন (২) ৭ তারিখ রাত্রে-ইহা শায়খ (রহ.) গ্রহণ করেছেন (৩) ১০ তারিখ-ইহা ঐতিহাসিক আবুল ফেদা গ্রহণ করেছেন। (৫) আবার কেউ বলেন, ১৮ তারিখ (৫) আবার কেউ বলেন, ২২ তারিখ। (৬) ৯ তারিখ-মিসরের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ প-িত মাহমুদ পাশা ফালাকী গাণিতিক যুক্তিতর্কের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্ম তারিখ ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল মোতাবেক ৯ রবিউল আউয়াল সোমবার। ইহা জমহুরের বিপরীত অগ্রহণযোগ্য উক্তি (৭) ৮ তারিখ সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবরাহার হস্তিবাহিনীর বিনাশ প্রাপ্তির পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন দিন পর ৮ রবিউল আউয়াল সোমবার মোতাবেক ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে সুবেহ সাদিক উদয়ের মুহূর্তে আবু তালিবের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এবং জুবাইর ইবনে মুতঈম (রা.) হতে এ তারিখই বর্ণিত হয়েছে এবং প্রখ্যাত হাদীসবিদ আল্লামা কুতবুদ্দীন কাসতালানী (রহ.) ও এই মতটিই পছন্দ করেছেন। (যুরকানী, ১ম খ-, ১৩১ পৃষ্ঠা) (৮) ১২ তারিখ-যা প্রসিদ্ধ উক্তি, ইবনে জুযযার ইহার ওপর সকলের ঐকমত্যের বর্ণনা করেছেন। ইবনে আছীর “তারিখে কামিল” গ্রন্থে উক্ত তারিখকে গ্রহণ করেছেন।
(ক) হযরত মুফতি সৈয়দ আমীমুল ইহসান (রহ.) বলেন খাজা আবদুল্লাহর ইন্তিকালের সাতমাস পর বসন্তকালে ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস মোতাবেক প্রসিদ্ধ বর্ণনা মতে ১২ই রবিউল আউয়াল সৈয়দা আমিনা (রা.)-এর কোলে দু’জাহানের সরদার নবীকুল শিরোমনি হযরত আহমদ মুজতমা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র মক্কায় ভূমিষ্ঠ হন। শায়খ মোস্তফা আলাবীনি “লুবাবুল খিয়ার ফি সীরাতিন নবীয়্যিল মুখতার” নামক গ্রন্থে লিখেছেন যে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১২ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন হস্তী বাহিনী দ্বারা বাইতুল্লাহ আক্রমণের ৪০ দিন পর (খ) বিখ্যাত মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে জারীর ত্ববরী (রহ.) “তারিখে ত্ববরী” গ্রন্থে বলেছেন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র জন্ম সোমবার রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ হস্তীর বছর হয়।
(গ) বিশ্ববরেণ্য ঐতিহাসিক এবং ইতিহাসের দর্শনগত তত্ত্ব ও তথ্যের উদ্ভাবক ইমাম আল্লামা ইবনে খলদুন বিরচিত “তারিখে ইবনে খলদুন” কিতাবে বলেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র জন্ম হস্তী বছর রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ হয়েছিল এবং নওয়াশিরওয়াহ বাদশাহর শাসনের চল্লিশতম বছর ছিল।
(ঘ) প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও জীবনীকার আল্লামা ইবনে হিশাম (রহ.) (ইন্তিকাল ২১৩ হিজরী) মুসলিম বিশ্বে সর্বপ্রথম জীবনীগ্রন্থ রচিয়তা বিশ্বনন্দিত ঐতিহাসিক ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসহাক রাহবীয়াহ (রহ.) থেকে বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর “আস সীরাতুন নববীয়্যাহ” গ্রন্থে বলেছেন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হস্তীর বছর পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ জন্ম গ্রহণ করেন। (আস সীরাতুন নববীয়্যাহ ইবনে হিশাম)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।