Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাম্প্রদায়িকতা, নাকি কায়েমি স্বার্থ?

তারেকুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৪ জুলাই, ২০২২, ১২:০৪ এএম

সম্প্রতি নড়াইলের লোহাগড়ায় এক অমুসলিম যুবকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে রাসূল সা. সম্পর্কে কটূক্তিমূলক পোস্ট দেয়ার অভিযোগ ওঠে। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সেখানে উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে হঠাৎ করে বহিরাগত একদল লোক হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এলাকার লোকজন হামলাকারীদের চেনে না বলে জানান প্রশাসনের কর্মকর্তারা। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘গতকালের ঘটনার পর বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি শান্ত আছে। গতকাল যারা হামলার চেষ্টা করেছেন, তারা অধিকাংশই বাইরের লোক। তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন মনে হয়েছে। তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে’ (১৭ জুলাই ২০২২, প্রথম আলো)। এ ছাড়া অভিযুক্ত আকাশ সাহা নামের পলাতক সেই যুবককে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

প্রথম আলোর এক রিপোর্টে স্থানীয় মুসল্লিরা বলেছেন, ‘আকাশ মহানবী (সা.)-কে অশ্লীল ভাষায় কটূক্তি করেছে। আমরা তার বিচার চাই। কিন্তু অন্য বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ খুবই গর্হিত কাজ। কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলমান এগুলো করেনি। এগুলো স্বার্থান্বেষী দুর্বৃত্তদের কাজ। তাদের কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার।’ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এ ধরনের যেকোনো হামলা হলেই দেখা যায়, হামলাকারীদের চিহ্নিত করা ও তদন্তের আগেই তৌহিদি জনতা ও আলেম-ওলামার ওপর একশ্রেণির প্রগতিশীল মানুষ দোষ চাপানোর প্রয়াস চালান। তারা এ ধরনের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখারও গরজ বোধ করেন না। সংখ্যালঘুদের নিয়ে অপরাজনীতি করাই তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। অথচ তাদের প্রশ্ন তোলা উচিত, নির্বাচনে সংখ্যালঘুরা যাদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাদের শাসনামলে কেন সংখ্যালঘুরা বারবার নির্যাতন ও স্যাবোট্যাজের শিকার হচ্ছে এবং কেন আদৌ কোনো ঘটনার বিচার হচ্ছে না?

গত বছরের মার্চে সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে লুটপাট ও হামলার ঘটনায় প্রথমদিকে দেশের মূলধারার বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম হামলাকারীদের ‘হেফাজতের সমর্থক’ বলে প্রচার করলেও পরে হামলার মূল হোতার রাজনৈতিক দলীয় পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার পর সেসব গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ও পেশাগত নৈতিকতা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। পিবিআই-এর তদন্তে বেরিয়ে আসে ভিন্ন বাস্তবতা! শাল্লার ঘটনার মূল হোতা শহিদুল ইসলাম স্বাধীনকে গ্রেপ্তার করা হয়। জানা যায়, সে স্থানীয় ইউপি সদস্য এবং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। তাকে গ্রেপ্তার করার পর পুলিশ জানায়, শাল্লায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলার পেছনে ‘জলমহাল’ নামে একটি ইজারাকৃত দিঘীর দখল সংক্রান্ত বিরোধ ছিল মূল কারণ (২০ মার্চ ২০২১, ঢাকা ট্রিবিউন)। সুতরাং, কারা সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী এবং সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও সম্পত্তি দখল করে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

যাই হোক, কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, সুনামগঞ্জের শাল্লা ও খুলনার রূপসায় সংখ্যালঘুদের উপাসনালয় ও বাড়িঘরে ঘটে যাওয়া হামলাগুলোর বিচার আজও হয়নি। বিগত এক দশকে সংখ্যালঘুদের ওপর ঘটা কোনো হামলার বিচারই কার্যত সম্পন্ন হয়নি। ফলে এমন অভিযোগ ও ধারণা ইতোমধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছে যে, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি কায়েমি ভূমিদস্যু চক্র সংখ্যালঘুদের জমি দখলের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে তাদের ভিটেমাটিতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে। আবার এহেন ঘৃণ্য উদ্দেশ্য আড়াল করতে প্রধান বিরোধী দলসহ ইসলামপন্থীদের ওপর সংখ্যালঘু নির্যাতনের দায় চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে ক্ষমতাসীনরা। এই সুযোগে তথাকথিত প্রগতিশীল-সেকুলার গোষ্ঠীও ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘মৌলবাদ’-এর হুজুগ তুলে দেশের আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালানো শুরু করে। বস্তুতপক্ষে, আমাদের দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাগুলোর অভিমুখ এই ত্রি-চক্রের বৃত্তেই এখনো আটকে আছে। সুতরাং, এসব হামলার পূর্বাপর বিশ্লেষণ করলে এই সিদ্ধান্তে আসা যৌক্তিক হয়ে পড়ে যে, সংখ্যালঘুদের জানমালের ওপর হামলাগুলো নিছক সাম্প্রদায়িকতা নয়, বরং এর নেপথ্যে প্রধানত দুটি বিষয় জড়িত: ভূমিদস্যুতা ও রাজনৈতিক কায়েমি স্বার্থ।

সংখ্যালঘু নির্যাতনের নেপথ্যে ভূমিদস্যুতা বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন প্রথম আলোতে এক কলামে লিখেছেন: ‘প্রায় প্রতিবছরই ঘটে যাওয়া এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এগুলো ঝোঁকের মাথায় নিছক ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। এর পেছনে থাকে মূলত ভূমি দখলের রাজনীতি। হামলাকারীরাও ‘সাধারণ’ কোনো মানুষ না, ধর্মীয় অনুভূতির সুড়সুড়ি দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা চালায় যাদের মূল লক্ষ্য থাকে ভূমি দখল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পেয়েছি, রাষ্ট্র নিশ্চুপ থাকায় হামলাকারীরা প্রশ্রয় পায়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্রমাগত চাপ প্রয়োগে উৎসাহিত করে, যে পর্যন্ত না তারা ভূমি থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক সময় সেই হামলাকারীদের কাছেই নামমাত্র মূল্যে জমিটি বেচে দেয় তারা। ক্ষমতার ক্রমাগত চাপে এবং তাপে তত দিনে তারা জেনে যায়, বাপ-দাদার ভিটাবাড়িতে তারা আর থাকতে পারবে না’ (২২ মার্চ ২০২১, প্রথম আলো)।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নামে একটি সংগঠন ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট একটি সংবাদ সম্মেলন করে। ওই সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির নেতারা তুলে ধরেন, কীভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুদের ওপর নানারকম অত্যাচার চালিয়ে এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করে উচ্ছেদপূর্বক তাদের ভিটেমাটি ও সম্পত্তি জবরদখল করা হয়। এক্ষেত্রে সংগঠনটি বর্তমান সরকারি দলের মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মীদের দায়ী করে তাদের নাম ও পরিচয়সহ একটি তালিকা প্রকাশ করে। এর ফলে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রানা দাসগুপ্ত তখন প্রশাসনিকভাবে হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগও করেন। বাংলা ডয়েচে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে রানা দাসগুপ্ত বলেছিলেন, ‘সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে দুর্বৃত্তরা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, জায়গা-জমি, দেবোত্তর সম্পত্তি, গির্জা ও বিহারের সম্পত্তি জবরদখলের উন্মত্ততায় মেতে উঠেছে। এ জবরদখলের সঙ্গে সরকারি দলের সংসদ সদস্য, মন্ত্রী পরিষদের প্রভাবশালী সদস্যের নাম বেরিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না’ (২৪ আগস্ট ২০১৫, ডয়েচে ভেলে)।

রামু, নাসিরনগর, শাল্লা, রূপসা থেকে শুরু করে সর্বশেষ লোহাগড়ার ঘটনার একটি লক্ষণীয় মিল হলো, হামলার ঠিক আগে অমুসলিম কোনো যুবকের তথাকথিত ফেসবুক পোস্ট ঘিরে বিতর্ক ও উত্তেজনা তৈরি করে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার পথ সুগম করা হয়। অথচ, পরে সেসব বিতর্কিত ফেসবুক পোস্ট কিংবা পোস্টদাতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না! প্রতিটি হামলার ঘটনায় এ ধরনের ফেসবুক পোস্ট ও সংশ্লিষ্ট আইডির মালিক রহস্যই থেকে গেছে। ধর্মীয় ভাবাবেগের কারণেই হোক বা পূর্বোক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই হোক, এ দেশে কোনো সাধারণ অমুসলিম ব্যক্তির পক্ষে ইসলাম-অবমাননা করে পাবলিকলি ফেসবুক পোস্ট দেয়ার ঝুঁকি নেয়ার কথা নয়। তবুও এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি খুবই উদ্বেগের বিষয়। তাই এটা ধরে নেয়া সঙ্গত যে, কোনো সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর স্যাবোট্যাজ তথা অন্তর্ঘাতমূলক হামলার পরিকল্পনারই অংশ এ ধরনের বিতর্কিত ফেসবুক পোস্টÑ যার অস্তিত্ব পরে খোদ আদালতেও প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে ওঠে। ২০১৬ সালে নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা যার ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে হয়েছিল, সেই রসরাজ দাসের আইনজীবী মো. নাসির মিয়ার বক্তব্য হলো, ‘রিপোর্ট অনুযায়ী ফেসবুক স্ট্যাটাসের বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তবে পরবর্তীতে যেহেতু ক্ষমা চেয়ে একটি স্ট্যাটাস দেয়া হয়। তাই ধারণা করা যায়, অ্যাকাউন্ট থেকে একটি স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছিল। তবে সেই স্ট্যাটাস কে দিয়েছে তা নিশ্চিত নয়। আশা করছি, দ্রুততম সময়ে অপরাধী চিহ্নিত হয়ে রসরাজ দাস নির্দোষ প্রমাণিত হবেন’ (২১ অক্টো. ২০১৮, মানবজমিন)। এক্ষেত্রে কায়েমি স্বার্থ হাসিলের জন্য ‘জজমিয়া নাটক’ সাজানোর আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

অন্যদিকে, আমাদের দেশের মুসলমানদের মধ্যে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি যথেষ্ট উদার মানসিকতা বিদ্যমান। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনা ঘটলেও তারা সরকার ও প্রশাসনের কাছে বিচার দাবি করে আইনিভাবে সেটার সুরাহা হোক তা চায়। অন্ততপক্ষে ফেসবুক পোস্টের জের ধরে সদলবলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ও জানমালের ওপর হামলা-ভাঙচুর তারা করার কথা নয়। কেননা বেশিরভাগ সময়ই দেখা গেছে, হামলাগুলো সংগঠিত করে মূলত কায়েমি স্বার্থবাদী রাজনৈতিক চক্র, যাদের উদ্দেশ্য অসহায় সংখ্যালঘুদের জমি দখল করা। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহাবস্থান ধরে রাখার ক্ষেত্রে মুসলিম-অধ্যুষিত রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ঈর্ষণীয়। তবুও বিভিন্ন সময়ে অতর্কিতে সংখ্যালঘুদের উপাসনালয় ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটছে। অন্তরালের বাস্তবতা বিবেচনায় এসব হামলাকে ঢালাওভাবে ‘সাম্প্রদায়িক হামলা’ হিসেবে দেখার অবকাশ আর নেই। কারণ, এ ধরনের হামলাকে ভিন্নভাবে দেখার বাস্তবতা হাজির রয়েছে, যদিও একশ্রেণির সেকুলার মিডিয়া ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘মৌলবাদ’-এর হুজুগ তুলে এ ধরনের হামলার প্রকৃত উদ্দেশ্য, অনুঘটক ও সংঘটনকারীদের প্রকারান্তরে আড়াল করে দেয়। এতে মূলত কায়েমি স্বার্থান্বেষীদেরই পোয়াবারো হয়।


লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন