Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জিকির মোমিনের কলবের প্রশান্তির খোরাক

মুফতি মুহাম্মদ আনিসুর রহমান রিজভি | প্রকাশের সময় : ২৩ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

প্রারম্ভিক আলোচনা : জিকির হলো সর্বোত্তম ইবাদত। যেমন: হযরত আবু দারদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামদেরকে সম্মোধন করে এরশাদ করেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন বস্তুর সংবাদ দেবো না যা তোমাদের যাবতীয় আমলের চাইতে উত্তম, তোমাদের প্রভুর নিকট সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য, তোমাদের মর্যাদা বিশেষভাবে বর্ধনকারী। আল্লাহর রাস্তায় সোনা-রূপা দান করা এবং আল্লাহর পথে জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করতে গিয়ে তাদেরকে হত্যা করা বা নিজে শাহাদাত বরণ করার চাইতে উত্তম? সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সেটি কি বস্তু? রাসূল (সা.) এরশাদ করলেন, সেটি হলো আল্লাহর জিকির। আজকের প্রবন্ধে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে যৎসামান্য আলোচনা করার চেষ্টা করছি।

জিকিরের পরিচয় : জিকির শব্দের অর্থ হচ্ছে স্মরণ করা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। অর্থাৎ নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্য সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করা, তাঁর আনুগত্য করা এবং তাঁর ইসমে জাত ও ইসমে সিফাত মুখে কিংবা মনে উচ্চারণ করা। আল্লাহ তা’আলা জ্বিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি জ্বিন এবং ইনসানকে আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। (সূরা যারিয়াত : ৫৬)। জিকির সমস্ত ইবাদতের রুহ : সমস্ত ইবাদতের রুহ হচ্ছে আল্লাহর জিকির। আল্লাহ তা’আলা বান্দাদের সর্বাবস্থায় অধিকহারে তাঁর জিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন: আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর এবং সকাল সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা কর। এখানে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা বলতে জিকিরকে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। (সূরা আহযাব : ৪১-৪২)।

সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকির করতে হবে : সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকির করতে হবে দাঁড়িয়ে, বসে এমনকি শুয়ে যেভাবে পারা যায়, আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। যেমন: আল্লাহ তা’আলা বলেন, যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে আসমান ও যমীন সৃষ্টি বিষয়ে (তারা বলে) হে পরওয়ারদিগার! এসব নিয়ে অনর্থক সৃষ্টি করেননি। (সূরা আলে ইমরান : ১৯১)।

জিকিরের অনন্য বৈশিষ্ট্য : জিকির এমন একটি ইবাদত যার কোন সময়, সীমা, পরিমাণ ও শর্ত নেই। দিনে-রাতে, সকাল-সন্ধ্যায়, হাঁটতে-বসতে এমনকি শয়ন অবস্থায় এবং অযু অবস্থায় হোক কিংবা উযুবিহীন হোক সর্বাবস্থায় জিকির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া এ ইবাদতের জন্য কোন বিশেষ পরিশ্রমও করতে হয়না। এবং কোন অবসরের দরকার পড়ে না। জিকিরের উপকারিতা এতবেশি ও ব্যাপক যে, এর মাধ্যমে পার্থিব কার্যক্রমও ইবাদতে পরিণত হয়ে যায়। যেমন: আহার করার সময় আহারের দোয়া পড়লে, ঘুমানোর সময় ঘুমের দোয়া পড়লে এগুলো ইবাদতে রুপান্তরিত হয়ে যায়। অর্থাৎ সর্বদা আল্লাহর স্বর্ণ রাখা কোন অবস্থাতেই আল্লাহ সম্পর্কে অমনোযোগী ও গাফেল না হওয়া। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন, অতঃপর তোমরা যখন নামায সম্পন্ন কর, তখন দন্ডায়মান, উপবিষ্ট ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহ জিকির কর। (সূরা নিসা : ১০৩)

জিকিরকারী ব্যক্তির দৃষ্টান্ত জীবিতদের মতো : আল্লাহর জিকিরকারী ব্যক্তির দৃষ্টান্ত জীবিত ব্যক্তিদের ন্যায়। যারা আল্লাহর জিকির করে না, তাদের কলব মরে যায় যদিও তারা জীবিত থাকে। জিকিরের মাধ্যমে মানুষের মরা কলব জিন্দা হয়। অন্তরে আল্লাহ তা’আলার ভয় জাগ্রত হয়। বান্দা আল্লাহ তা’আলার আনুগত্যের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। লোভ-লালসার প্রতি চরম ঘৃণা সৃষ্টি হয়। যেমন: আল্লাহ তা’আলা বলেন, যারা ঈমানদার তারা এমন লোক যে, যখন আল্লাহর জিকির করা হয় তখন তাদের অন্তর ভীত হয়ে পড়ে। আর যখন তাদের সামনে আল্লাহর আয়াত পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় প্রভুর উপর ভরসা করে। (সূরা আনফাল : ২)।

জিকির থেকে গাফেল ব্যক্তির দৃষ্টান্ত মৃত্যুতূল্য : কখনো জিকির থেকে গাফেল হওয়া যাবে না। জিকির থেকে গাফেল হলে সৃষ্টির উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে নানা বিপদাপদ নাজিল হয়ে থাকে। যারা জিকির থেকে গাফেল হয় তাদের দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে হাদিসে কুদসীতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে এবং যে আল্লাহর জিকির করে না তাদের দৃষ্টান্ত হলো জীবিত ও মৃতদের মতো। (বুখারী : ৬৪০৭, মুসলিম : ৭৭৯)।

জিকিরকারি ব্যক্তি আল্লাহর অধিক পছন্দনীয় : আল্লাহ তা’আলা তাঁর জিকিরকারীকে পছন্দ করেন। জিকিরকারীর দোয়া কবুল করেন। হাদীসে কুদসীতে এরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমি আমার বান্দার ধারণা মোতাবেক হই এবং আমি তার সাথে থাকি যখন সে আমার জিকির করে। যদি সে তার মনে মনে আমার জিকির করে আমি তাকে আমার কুদরতি মনে জিকির করি। আর যদি সে আমাকে মজলিসে গণজামায়েতে জিকির করে তাহলে আমি তাকে তাদের চেয়ে উত্তম মজলিসে স্মরণ করি। (বুখারী : ৭৪০৫, মুসলিম : ২৬৭৫)।

জিকির দ্বারা শয়তান বিতাড়িত হয় : শয়তান মানুষের চিরশত্রু। সে সর্বদা মানবজাতিকে গোনাহে লিপ্ত করে জাহান্নামী বানাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। আর শয়তান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে এবং মানুষের রক্তে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা আছে বিধায় তাকে দমন করা বড়ই কঠিন। আল্লাহর জিকির হলো শয়তানকে বিতাড়িত করার বড় সফল অস্ত্র। রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, শয়তান আদম সন্তানের অন্তরে হাঁটু গেড়ে বসে থাকে। যখন সে আল্লাহর জিকির করে, তখন শয়তান পালিয়ে যায় আর যখন সে আল্লাহর জিকির থেকে গাফেল হয় তখন শয়তান প্ররোচনা দেয়। (তাখরীজু মিশকাতিল মাসাবিহ : ২/৪৬২, আজ-জুহদ : ৩৩৭)।

জিকির নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম : জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার যোগসুত্র তৈরি হয়। বান্দা আল্লাহর দয়া ও মাগফিরাত লাভের যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। যেমন : আল্লাহ তা’আলা বলেন, তোমরা আমাকে স্মরণ কর আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা বলেন, তোমরা যদি আমার হুকুমের আনুগত্যের মাধ্যমে আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে সওয়াব ও মাগফিরাত দানের মাধ্যমে স্মরণ করব। (সূরা বাকারা : ১৫২)।

জিকির অন্তরের কালিমা দূর করার মাধ্যম : শয়তান মানুষকে পাপ কাজে লিপ্ত করে। আর পাপের কারণে মানুষের অন্তরে কালিমা সৃষ্টি হয়। এই কালিমা দূরীভূত হয় আল্লাহর জিকির দ্বারা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, প্রত্যেক বস্তু পরিষ্কার করার উপকরণ আছে। আর অন্তরের ময়লা পরিষ্কার করার উপকরণ হলো আল্লাহর জিকির। (আত-তারগীব ওয়াত তারহীব : ২/৩২৭)।

জিকিরের মর্যাদা জিহাদের চেয়েও বেশি : জিকিরকারীর ফজিলত জিহাদকারী চেয়েও বেশি। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসূল (সা.) এর নিকট প্রশ্ন করা হলো যে, কিয়ামত দিবসে আল্লাহর নিকট কোন বান্দার মর্যাদা সবচেয়ে বেশি হবে। তিনি বলেন, অধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকিরকারীদের। আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীদের চেয়েও কি বেশি? তিনি বললেন, যদি কেউ কোন কাফির ও মুশরিকদের উপর তরবারি দিয়ে আঘাত করে এবং তার তরবারী ভেঙ্গে যায় আর সে কাফির মুশরিক রক্তাক্ত হয়ে পড়ে তবুও আল্লাহর জিকিরকারীর মর্যাদা তার চেয়েও বেশি এবং উত্তম। (সুনানুত তিরমিযি : ৩৩৭৬)।

জিকিরকারীদের ক্ষমা করে দেয়া হয় : হযরত সাহল ইবনে হানযালা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, যেসব লোক কোন মজলিসে বসে আল্লাহর জিকির করে যখন মজলিস থেকে উঠে তখন তাদের উদ্দেশ্যে বলা হয় যে, তোমরা উঠ। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তোমাদের গুনাহ সমূহকে নেকীতে পরিবর্তন করে দিয়েছেন। (আত-তারগীব ওয়াত তারহীব : ২/৩৩৪)।

জিকিরের মজলিস জান্নাতের বাগান : জিকিরকারীকে ফেরেশতারা খুঁজতে থাকেন। যেখানে আল্লাহর জিকির করা হয় সেখানে ফেরেশতাদের আগমন ঘটে। জিকিরকারী বান্দার সাথে বসে তারাও আল্লাহর যিকির করেন। হযরত জাবির (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) আমাদের থেকে বের হলেন এবং বললেন, হে লোক সকল! আল্লাহর একদল ফেরেশতা আছেন। তারা কোন জিকিরের মজলিস পেলে সেখানে অবস্থান করেন। অতঃপর তোমরা জান্নাতের বাগানের ফল খাও। আমরা বললাম, জান্নাতের বাগান কোথায়? হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, জিকিরের মজলিস সমূহ জান্নাতের বাগান। (আল-মাজরুহাইন : ২/৫২, আবি ইয়ালা : ২১৩৮)।

সর্বোত্তম জিকিরের বর্ণনা : সর্বোত্তম জিকির কোনটি তা নিয়ে বিভিন্ন রেওয়ায়েত পরিলক্ষিত হয়। কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে সর্বোত্তম জিকির হলো, কালিমায়ে তাইয়্যেবাহ। কারণ এর দ্বারা অন্তর পরিষ্কার হয়। কোন রেওয়ায়েতে আছে, তেলাওয়াত কোরআন হলো সর্বোত্তম জিকির। কেননা, এতে একটি হরফে দশটি নেকী পাওয়া যায়। কোন রেওয়ায়েতে আছ, তাওবা ও ইস্তেগফার হলো উত্তম জিকির। এতে মুসিবত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়, গুনাহ মাফ হয় এবং রিজিকে বরকত হয়। কোন রেওয়ায়েতে আছে- সর্বোত্তম যিকির হলো দরুদ শরীফ পাঠ। কোন রেওয়ায়েতে আছে, সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আলিয়্যলি আযীম এ দোয়াটি সর্বোত্তম যিকির। কেননা, এর দ্বারা কেয়ামত দিবসে মিজান ভারী হবে।। কোন রেওয়ায়েতে আছে- উত্তম জিকির হলো তাসবীহে ফাতেমী। অর্থাৎ সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার, আলহামদুলিল্লাহ ৩৩ বার, আল্লাহু আকবার ৩৩ বার প্রত্যহ বাদ ফজর ও মাগরিব।
(মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী, তাফসীরে নঈমী,খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৬৯)।

সমাপনী : আল্লাহ তা’আলা মানুষ এবং জ্বিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাঁরই ইবাদত করার জন্য। অন্যান্য সৃষ্টিজগৎও আল্লাহর জিকির করে তাদের নিজস্ব ভাষায়। আর জিকির আল্লাহ তা’আলার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম এবং এটা সকল সৃষ্টির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও বটে। এর মাধ্যমে সৃষ্টিজগৎ আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। পরিশেষে আমরাও বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করার চেষ্টা করব। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে তৌফিক দান করুন, আমিন



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জিকির মোমিনের কলবের প্রশান্তির খোরাক
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ