Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পরিবেশের অবক্ষয় মানুষের কারণেই

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০২২, ১২:০৩ এএম

মানুষের প্রকৃতির মধ্যে এবং মানুষে মানুষে মিথষ্ক্রিয়ার ভিতর দিয়ে সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার শক্তিতে বলীয়ান উন্নত সমাজগুলো সমাজ বা বাজার ব্যবস্থাকেই প্রকৃতির উপর স্থান দিতে অভ্যস্ত। এ অভ্যাস ও আচরণ থেকে উদ্ধুদ্ধ পরিণতিসমূহ বাজারভিত্তিক, সমাজকেন্দ্রিক আত্মম্ভরিতা সম্পর্কে নতুন উপলব্ধির সঞ্চার করছে। এ উপলব্ধিতে এটাই মূর্ত হয়ে উঠেছে যে, সমাজ আদৌ স্বয়ম্ভর কোনো সত্তা নয়, উপরন্তু এটি প্রকৃতির একটি অংশ বা সম্প্রসারিত রূপমাত্র। অন্য কথায় সমাজ কেবল প্রকৃতির সমাজীকৃত অংশ, সামাজিকভাবে বিকাশশীলতায় মানুষের ভূমিকার প্রাধান্য অনস্বীকার্য। কিন্তু এ ভূমিকার সুবাদে মানুষ তার সংলগ্ন পরিবেশ ব্যবস্থায় যে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, সেজন্য প্রকৃতির সাথে তার সম্পর্কের ধরণটি পুনরীক্ষণ প্রয়োজন।

জীববিজ্ঞানী ও পরিবেশতাত্ত্বিক বটকিনের মতে, বর্তমানে বিশ্ব প্রকৃতির যান্ত্রিক শৃঙ্খলাবাদী ধারণা থেকে ক্রমে সরে গিয়ে ভিন্নতর উপলব্ধি ও ধারণার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রকৃতিকে যেভাবে আমরা বুঝতে যাচ্ছি সেটি হলো এ প্রকৃতি যুগপৎ ঘটমান নানা জিনিস এবং সময় ও স্থানের বহুবিদ মানদণ্ডে নিয়ত পরিবর্তনশীল ব্যবস্থা বিশেষের সমন্বয়ে জটিল ব্যবস্থাদির এক জোড়াতালি। প্রকৃতির অসীম ছন্দের ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী কোনো ভিনদেশি অনুপ্রবেশকারী হওয়ার পরিবর্তে মানুষ প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার এক অন্তর্নিহিত উৎপাদন মাত্র। যন্ত্রবৎ পরিচালিত হওয়ার পরিবর্তে জটিলতা, দৈবতা নানা ঘটনার যুগপততা, ইতিহাস এবং পরিবর্তন প্রকৃতির নিজস্ব গুণ। আমরা এটি শিখছি যে পরিবর্তনকে গ্রহণ এবং মন্দ থেকে ভালকে পৃথক করা ব্যতীত আমাদের উপায় নেই। প্রকৃতি নিজেই হবে আবশ্যিকভাবে আমাদের পথ প্রদর্শক। ভূমির উপর আমরা যেসব পরিবর্তন আরোপ করি সেগুলো যদি গুণ এবং গতির দিক থেকে প্রাকৃতিক হয়, তবে এসব পরিবর্তন ক্ষতিকারক নয়। দ্রুত পরিবর্তনসমূহ অথবা জৈব বিবর্তনের ইতিহাসে যেগুলো অভিনব যেমন, পরিবেশের মধ্যে নতুন কেমিক্যালসের প্রবর্তন, যেগুলো সমস্যার উদ্রেক করতে পারে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, পৃথিবীর তাপবর্ধন আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয় ঘটমান পরিবর্তনের পরিমাণ বা আয়তনের জন্য নয়, বরং অভূতপূর্ব গতিতে পরিবর্তন সংঘটনের জন্য। কতক পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিদ, জীবাশ্ম জীববিজ্ঞানী, আবহাওয়াবিদ এবং অন্যরাও এখন স্বীকার করেন যে, তারা যেসব প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াদি অধ্যয়ন করেন সেগুলো সরল, নিয়মিত বা নিশ্চিত নয়, বরং সেখানে বিশৃঙ্খলা সর্বদাই উপস্থিত (D.B Botkin, `Rethinking the environment in diologue, No.96,vol-2, 1992,pp-64-65, Author of Discordant harmony : A new ecology for the twenty first century)
মানুষ তার প্রয়োজনে প্রকৃতির সম্পদকে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে চায়। এর জন্য যেমন দরকার প্রযুক্তি, যা প্রকৃতি পরিবর্তনে তাকে সহায়তা দেবে এবং সামাজিক সম্পর্ক, যার অস্তিত্ব প্রযুক্তির প্রয়োগে ও উন্নয়নের জন্য কাজ করে। একে আমরা যদি উৎপাদন অস্তিত্ব বলি তাহলে সামাজিক সম্পর্কের বৈধতা পায় যে আইনে, রীতিনীতিতে, সামাজিক অনুশাসনে তাকে আমরা সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব বলতে পারি।

উৎপাদন অস্তিত্ব বদলানোর জন্য প্রযুক্তির প্রয়োজন। আমরা যাকে দূষণ বলি, তা প্রযুক্তির উন্নয়নের মাত্রায় নিরিখে নির্ধারিত হবে আবার সমাজিক পরিবেশ বা কাঠামোর প্রেক্ষাপটেই এটা বিচার্য। দূষণ কী? পরিবেশ কী? পরিবেশের দূষণই বা কী? দূষণের কারণগুলো কী? দূষণ বিষয়টি প্রচলিত ধারায় যা বলা হয় তার অতিরিক্ত দ্যোতনা ব্যক্ত করে। প্রতিটি সিস্টেম বা কাঠামো যা তার উপাদানগুলোর সম্পর্ক নির্ণয় করে তার ভারসাম্যহীনতাই দূষণ। প্রকৃতিতে প্রকৃতির সম্পর্ক নির্ণয় করে এমন উপাদানগুলোর সম্পর্কের ভারসাম্যহীনতাই হলো দূষণ। সামাজিক কাঠামো বা সামাজিক পরিবেশের ক্ষেত্রে সামাজিক কাঠামোর উপাদানগুলোর (প্রতিষ্ঠান, দল, সংস্কৃতি) ভারসাম্যহীনতা, যা প্রকৃতির উপর কার্যকলাপের পরিবর্তিত রূপ। প্রাণী জগতে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য হলো মানুষ সাংস্কৃতিক জীব, অন্য সকল প্রাণীদের সংস্কৃতি নেই। প্রকৃতিতে পাওয়া মাটি সংস্কৃতি নয়, কিন্তু মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরি করলে তা সংস্কৃতি বলে বিবেচিত হবে। প্রকৃতিতে পাওয়া গাছ সংস্কৃতি নয় তবে তা কেটে আসবাবপত্র তৈরি করলে হবে সংস্কৃতি।

সমাজবিজ্ঞানী উইলিয়াম অগবার্নের মতে, এ ধরা যায়, ছোঁয়া যায় না, সে জন্য এ হলো বস্তুগত সংস্কৃতি, আবার মানুষ সামাজিক পরিবেশের বা কাঠামোর ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য আইন-কানুন, রীতিনীতি, মূল্যবোধ, দর্শন ইত্যাদি সৃষ্টি করে। এগুলো পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করা যায় না এবং এ কারণে এগুলো অবস্তুগত সংস্কৃতি।
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন পরিবেশের জন্য দায়ী, এ বিষয়ে কোনো প্রকার সন্দেহ থাকতে পারে না। নৃবিজ্ঞানী লেসলি হোয়াইট তাঁর Energy and the Evolution of culture গ্রন্থে বলেন, সমাজ আর সাংস্কৃতিক পরিবর্তন মূলত মানুষের ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য শক্তির উৎস সমূহের উদ্ভাবনও এর সংযুক্তির ফল। প্রকৃতি কেন দূষিত হয়? দূষণের প্রধান কারণ, প্রযুক্তি বা উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের জন্য শক্তির ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। শক্তির উৎস হিসাবে আগুনের আবিষ্কার মানুষের সামাজিক পরিবর্তনে এক যুগান্তকারী সূচনা ছিল। আগুন উৎপাদিত হয় কোনো জ্বালানির রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে। কাঠ, কয়লা, তেল, গ্যাস ইত্যাদি সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। আবার এ সবের ব্যবহার পরিবেশকে দূষিত করছে এন্তারভাবে।

নগর বসতিতে বহু মানুষের যুথবদ্ধতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল হলো বাস্তবতন্ত্রের (ইকোলজি) ক্ষতিসাধন, যা পরিবেশকে দূষিত করে। দু’টো প্রধান বিষয়কে বাস্তবতন্ত্র ও নগর বসতির সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। এর প্রথমটিকে বলা যেতে পারে বহির্মুখী চাপ অর্থাৎ কী পরিমাণ সম্পদকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে। এ সম্পদগুলো হচ্ছে জমি, জীবশ্মজাত, জ্বালানি, পানীয় পানি। এর পরিবর্তে এরা যা ফিরিয়ে দেয় তা হচ্ছে আবর্জনা, বিষাক্ত তরল পদার্থ এবং মনুষ্যদেহ নির্গত ক্ষতিকর বস্তু। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, কী ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করে তার অধিবাসীদের জন্য। এটিকে দেখতে হবে অতিমাত্রায় ভিড়, শব্দ দূষণ এবং পাশাপাশি অবস্থানের ফলে সামাজিক ও মানসিক চাপের পরিমাণ কতটা। দু’দিক থেকে নগরায়নের চাপ পরিবেশের উপর প্রতিকূল প্রভাব বিস্তার করে। বায়ু, পানি, পাহাড় নিধন, বন উজাড় ও ভূমি দূষণের জন্মদাতা হচ্ছে নগর। সবচেয়ে বেশি দূষণ ঘটে মানুষের মলমূত্র ও গৃহস্থালির আবর্জনা দ্বারা।

আমাদের দেশে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের নগরায়নের বৈশিষ্ট্য প্রায় একই। এখানে আগত জনগোষ্ঠির আবাসিক অবস্থা, সামাজিক সম্পর্ক, মূল্যবোধ ও ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ ইত্যাদি ব্যাপকভাবে জটিল এবং বৈচিত্র্যময়। এখানে হঠাৎ করে গড়ে উঠা নতুন নতুন বাড়ি ও সুরম্য অট্টালিকা অপরিকল্পিত নগরায়নের আরেক পরিচয় বহন করে। সিলেটে খুব দ্রুত বেড়ে চলেছে মধ্যযুগের আমীর ওমরাহদের মতো বাসস্থান, অভিজাত এলাকা। এসব বাসস্থান ভূমিকম্প প্রতিরোধক কিনা, তা মনিটরিং করার কেউ নেই। সিটি কর্পোরেশন, বিদ্যুৎ বিভাগ, জালালাবাদ গ্যাস সিস্টেম কারো সাথে কারো কাজের সমন্বয় নেই। সিটি কর্পোরেশন তার মূল দায়িত্ব যেটি ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে দূষণমুক্ত নগর গড়ে তোলা, সেটা তারা পারছে না। নগরের উপশহর, শিবগঞ্জ, মিরাপাড়া, কুমারপাড়া, দাড়িয়াপাড়া, জিন্দাবাজার, রিকাবীবাজার, বন্দরবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় স্কুল কলেজের সামনে ডাস্টবিন। পুলিশ লাইনের ভিতরের ময়লা দেয়ালের নিচ দিয়ে পাইপের মাধ্যমে রাস্তায় এসে পড়ে পরিবেশকে করছে বিপন্ন। এসব লাইন কয়দিনে পরিষ্কার করে কে জানে। এ রাস্তা দিয়ে সব সময় উৎকট গন্ধে, চলাফেরা দায় হয়ে যায়। পুলিশ লাইন হাইস্কুলের ৯ম শ্রেণীর জনৈক ছাত্রী জানায়, স্কুলের সামনে যেভাবে ডাস্টবিন দেয়া হয়েছে, তাতে গন্ধের জন্য আসা-যাওয়া করতে কষ্ট হয়। একই স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর অন্য এক ছাত্রী জানায়, ময়লা অর্ধেকের বেশি ডাস্টবিনের বাইরে পড়ে থাকে। কর্পোরেশন ঠিকমত পরিষ্কার করে না কোনো দিন। উপশহর হাই স্কুলের নবম শ্রেণীর এক ছাত্রী জানায়, রাস্তার পাশে যেভাবে ওয়েল্ডিং কারখানা প্রতিষ্ঠিত, তাতে তাদের চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম। সরকারি হাই স্কুলের এক ছাত্র জানায়, বাসা বাড়ির পাশে ব্যাটারির দোকান, যেখানে নানা ধরনের ক্যামিকেল ড্রামভর্তি দেখা যায়। এ নগরেও ঢাকার নিমতলার মতো ঘটনার জন্ম হাতে পারে। বলা যেতে পারে, অপরিকল্পিত নগর সিলেট। একে দূষণমুক্ত করা উচিত। কিন্তু করবেটা কে?
এদিকে গেল বন্যায় সিলেট নগরীর বিভিন্ন আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় পানি প্রবেশ করে। বলতে গেলে বেশ ক’দিন বসতবাড়ি , দোকানপাঠ, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি জমে থাকায় নগরবাসীকে দারুণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। সিলেট নগরের অভিজাত আবাসিক এলাকা শাহজালাল উপশহর, ছালিবন্দর, ছোবহানিঘাট, যতরপুর, তেলিহাওর, কাজিরবাজার, তোপখানা, মেহেন্দিবাগসহ নদীর দু’পারের পরিবেশ নষ্ট হয়ে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। এতে দেখা দিয়েছে নানা রোগ ব্যাধি। এদিকে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে শাহজালাল উপশহর এলাকায়। রাস্তাঘাট দিয়ে যানবাহন চলাচল দূরের কথা খালি পায়ে হাঁটা বা চলাফেরাও সম্ভব হচ্ছে না। উপশহর এলাকার প্রতিটি রাস্তাঘাটে গর্ত এবং ভাঙচুরের হাল অবস্থা সরজমিনে না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন। সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি ভিত্তিতে শাহজালাল উপশহরসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাটের সংস্কার এবং এলাকা থেকে ময়লা আবর্জনা সরানো না হলে অবস্থার মারাত্মক অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং রোগ ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

Show all comments
  • হামজা ১৬ জুলাই, ২০২২, ৩:৩৭ এএম says : 0
    আমরা সবাই সচেতন হলে এদেশে কোনো আর্বজনা রাস্তাঘাটে পরে থাকতো না।
    Total Reply(0) Reply
  • হামজা ১৬ জুলাই, ২০২২, ৩:৩৮ এএম says : 0
    আমরা সবাই ভালো ও সচেতন হলে এ দেশ উন্নত হতে বেশি সময় লাগবে না
    Total Reply(0) Reply
  • হামজা ১৬ জুলাই, ২০২২, ৩:৩৫ এএম says : 0
    সব মানুষ সচেতন হলে এদেশে পরিবেশ বিপর্যয় হতো না।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন