Inqilab Logo

সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

পদ্মাসেতু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে

ইয়াকুব আলী | প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০২২, ১২:০৩ এএম

পদ্মাসেতু উদ্বোধনের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এপি, এএফপি, আল জাজিরা, বিবিসি বাংলাসহ প্রতিবেশী দেশসমূহের মূলধারার গণমাধ্যম তাদের প্রতিবেদনে পদ্মাসেতু নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। আল জাজিরার খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তাল পদ্মা নদীর উপর একটি যুগান্তকারী সেতু উদ্বোধন করেছেন যা দেশের অনুন্নত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে সংযুক্ত করবে। এ যাবৎ বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু যা ‘জাতীয় গৌরবের প্রতীক’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সেতুটি বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলোর একটি এবং নিজ তহবিল থেকে বাংলাদেশ সরকার সেতু নির্মাণ ব্যয় বাবদ সমস্ত অর্থ যোগান দিয়েছে। আল জাজিরার প্রতিবেদনে পদ্মাসেতুকে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং বিস্ময়’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলামকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, পদ্মা নদীর মাওয়া পয়েন্টে প্রতি ২০ সেকেন্ডে যে পানি প্রবাহিত হয় তা ঢাকা শহরে প্রতিদিন ব্যবহৃত মোট পানির সমান।

নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গের শিরোনাম করা হয়েছে: ‘এক দশক আগে বিশ্বব্যাংকের ছেড়ে যাওয়া সেতু উন্মোচন করেছে বাংলাদেশ’। প্রকল্পটিকে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বিজয় হিসেবে দেখা হয়েছে। বলা হয়েছে, কাজ শুরু হওয়ার আট বছর পর, হাসিনা পদ্মা নদীর উপর ছয় কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ সেতুটির উদ্বোধন করেন। এটি ৮ কোটি মানুষকে যুক্ত করবে, যারা দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক। দেশটির জিডিপিতে সেতুটি ১ শতাংশের বেশি পয়েন্ট বৃদ্ধি করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

বিবিসি বাংলা নিয়মিতভাবে পদ্মাসেতুর ওপর সংবাদ পরিবেশন করেছে। সেতুর বিভিন্ন দিক নিয়েই এসব রিপোর্টে আলোকপাত করা হয়েছে। ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) খবরে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য ঋণ প্রদানকারী সংস্থা প্রকল্পটি থেকে সরে দাঁড়ানোর পরে নিজস্ব অর্থায়নের সরকার সেতুটি নির্মাণ করে। কানাডার প্রসিকিউটররা শেষ পর্যন্ত কোম্পানির নির্বাহীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে যখন একটি আদালত তাদের বিরুদ্ধে কিছু ওয়্যারটেপ প্রমাণ অগ্রহণযোগ্য বলে রায় দেয়। ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের মন্তব্যকে উদ্ধৃত করেছে ভয়েস অব আমেরিকা বলেছে, ‘পদ্মাসেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে জনসমক্ষে বিশ্বব্যাংকের মতো বহুপক্ষীয় সংস্থাসহ সব দাতাগোষ্ঠীকে আমাদের দৃঢ় মনোবল দেখিয়ে দেওয়া গেল।’ আনাম, যিনি হাসিনার কট্টর সমালোচক, লিখেছেন, বহু দেশ তাদের নিজের টাকায় সেতু বানায়। কিন্তু এই সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। কারণ, এর মধ্য দিয়ে দান-খয়রাতের ওপর নির্ভরশীলতার যে ভাবমূর্তি আমাদের ছিল তা চিরতরে মুছে গেছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, সেতুটি দেশের দারিদ্র্য-পীড়িত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করবে। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে দলের রাজনৈতিক সমর্থন বেশি। পদ্মাসেতু এ এলাকার মানুষের ভ্রমন সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেবে। সেতুটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড তৈরি করেছে এবং বেইজিং এটিকে চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতার একটি মাইলফলক হিসেবে দেখে।

এপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড অবকাঠামো উদ্যোগের সরাসরি অংশ না হলেও, চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের বিবৃতির ভাষ্যমতে বেইজিং পদ্মাসেতুকে বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে দেখছে। এপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মাসেতু বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন প্রতিবছর অতিরিক্ত ১.৩% বৃদ্ধি করবে, যা ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার জিডিপির বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে যোগ হবে।

আরব নিউজের শিরোনাম করা হয়েছে: ‘বাংলাদেশ ৩.৬ বিলিয়ন ডলারে নির্মিত পদ্মাসেতু উদ্বোধন করেছে’। সৌদি আরবের ইংরেজি দৈনিক আরব নিউজের খবরে বলা হয়েছে, ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মাসেতু, যা নদীর দুই তীরকে সংযুক্ত করেছে এবং যে নদীর নামে সেতুর নামকরণ করা হয়েছে, ঢাকাকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাথে সংযুক্ত করেছে। রাজধানী এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মংলার মধ্যে দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার কমিয়ে দিয়েছে এই সেতু। ঢাকা-ভিত্তিক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে যে যাত্রায় দুই থেকে তিন দিন লাগত তা এখন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শেষ করা যেতে পারে। সেতুটি নির্মাণে আনুমানিক ৩.৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে, যা সবই অভ্যন্তরীণ তহবিল থেকে যোগান দেওয়া হয়েছে। ‘সেতুটি বাংলাদেশের জনগণের। এটি আমাদের আবেগ, আমাদের সৃজনশীলতা, আমাদের সাহস, আমাদের ধৈর্য এবং আমাদের অধ্যবসায়কে প্রমাণ করে,’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে মাওয়ায় উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন।

ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পরিণত বয়সে উপনীত হয়েছে। ২৫ জুন শনিবার পদ্মা নদীর উপর ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক-রেল সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন পরিপক্কতার গল্প হিসেবেই এসেছে। হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত পদ্মাসেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছে। পদ্মাসেতুকে একটি যুগান্তকারী প্রকল্প বলে অভিহিত করেছে। প্রতিবেদনে পদ্মাসেতুর বিস্তারিত বিবরণ উপশিরোনামে উল্লেখ রয়েছে: সেতুটি ঢাকা ও ভারতের কলকাতার মধ্যে যাতায়াতের সময় প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনবে। দি হিন্দু পত্রিকায় বলা হয়েছে, পদ্মাসেতু শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগকেই সাহায্য করবে না বরং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও সরবরাহের উন্নতি ঘটাবে।

এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, পদ্মাসেতুর উদ্বোধন অনেক তাৎপর্য বহন করে কারণ প্রকল্পটি সম্পূর্ণরূপে অভ্যন্তরীণ অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পদ্মাসেতু প্রকল্পটি বিভিন্ন প্রকৌশল বিস্ময়ের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ প্রত্যক্ষ করেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য বিস্ময়কর কাঠামো হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও জ্ঞানের ব্যবহার করা হয়েছে সেতুতে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘এই সেতুটি শুধু ইট, সিমেন্ট, লোহা এবং কংক্রিটের নয়... এই সেতুটি আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা, আমাদের শক্তি এবং আমাদের মর্যাদার প্রতীক। এই সেতুটি বাংলাদেশের জনগণের।’ কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা পদ্মাসেতু উদ্বোধনের দারুণ কভারেজ দিয়েছে।

পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় এএফপি পরিবেশিত সংবাদে বাংলাদেশে সেতু উদ্বোধনের খবর দিয়ে নির্মাণকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কি কি গুজব ছড়িয়েছিল তারও উল্লেখ করা হয়েছে। এত কিছু সত্ত্বেও, ৬.২ কিলোমিটার সড়ক ও রেল সংযোগ সেতুটিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়াদের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্রুনাই দারুসসালামের জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক বোর্নিও বুলেটিন পরিবেশিত খবরে দেখা যায় সে দেশে বাংলাদেশ হাইকমিশনে পদ্মাসেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠান টেলিভিশনে দেখার জন্য বাংলাদেশ কমিউনিটির সদস্যরা একত্রিত হয়েছে। কেক কেটে উদ্বোধন অনুষ্ঠানটি উদ্যাপন করা হয়। শিলং ভিত্তিক ইংরেজি দৈনিক দি মেঘালয়ান এ সেতু উদ্বোধনের খবরটি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে।

লেখক: সিনিয়র উপপ্রধান তথ্য অফিসার (প্রেস অ্যান্ড মিনিস্টিরিয়াল পাবলিসিটি), তথ্য অধিদফতর



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন