Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি

ডা. এম এম মাজেদ | প্রকাশের সময় : ১৩ জুলাই, ২০২২, ১২:০২ এএম

গত সোমবার ছিল (১১ জুলাই) বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২২। ১৯৯০ সালের ১১ জুলাই প্রথমবারের মতো ৯০টি দেশে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উদযাপিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ বছর বাংলাদেশ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালিত হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ৮০০ কোটির পৃথিবী: সকলের সুযোগ, পছন্দ ও অধিকার নিশ্চিত করে প্রাণবন্ত ভবিষ্যৎ গড়ি। ১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই বিশ্বের জনসংখ্যা পাঁচশ’ কোটি হওয়ার পর ৯০ দেশের সরকারি উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি সভায় চূড়ান্ত হয় বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালনের বিষয়টি। ইউএনডিপির গভর্ন্যান্স কাউন্সিল কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে। এরপর থেকে জনসংখ্যা সমস্যার গুরুত্ব ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন চিন্তা করে প্রতিবছর সুনির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য নির্ধারণের মাধ্যমে ১৯৯০ সাল থেকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ২০১২ প্রণীত হলেও কাম্য জনসংখ্যা পরিকল্পনা সামনে আসেনি। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ২০১৯ সালের তথ্য মতে, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮১ লাখ। মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.১ শতাংশ। ৫০ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ১০ কোটি ৪৭ লাখ। ২০১৯ সালের ১৭ জুন প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বর্তমান জনসংখ্যা ৭৭০ কোটি। আগামী ৩০ বছরে আরো ২০০ কোটি যোগ হয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে মোট জনসংখ্যা হবে ৯৭০ কোটি। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের অন্য পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৮০৪ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি, ১৯২৭ সালে ২০০ কোটি, ১৯৫৯ সালে ৩০০ কোটি, ১৯৭৪ সালে ৪০০ কোটি, ১৯৮৭ সালে ৫০০ কোটি এবং ১৯৯৯ সালে ৬০০ কোটি। ২০১১ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ৭০০ কোটিতে পৌঁছেছে। এই হারে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে প্রায় এক হাজার কোটি এবং চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ ২১০০ সালে গিয়ে দাঁড়াবে এক হাজার ১০০ কোটিতে। কেউ কেউ মতামত দেন, পৃথিবীর যা স¤পদ রয়েছে তা সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ৩০০ কোটি লোকের জন্য যথাযথ। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভাব একসময় পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছিল। আবার জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে কৃষি বিপ্লব। বর্তমানে প্রযুক্তির বিকাশ ও উতপাদন বৃদ্ধির কারণে সব মানুষের খাদ্যের সংস্থান তেমন সমস্যা নয়। সমস্যা বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির একচেটিয়া আধিপত্য। এর ফলে অনেক সময়ই প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য মজুদের অভাবে নষ্ট হয়। হতাশার কথা হলো, খাদ্যাভাবে পতিত মানুষের কাছে যথাযথভাবে উদ্বৃত্ত খাদ্যও পৌঁছে না। অন্যদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা ক্রমেই বাড়ছে। সেই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে জাতিগত দ্বন্দ্ব, বিবাদ, জোরপূর্বক অভিবাসন ও প্রভাব বিস্তারের ফলে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

৫২ বছর আগে মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পরিবার পরিকল্পনাকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৯৬৯ সালের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের স্মারক ২৫৪২(১৯) ধারার ৪ উপধারায় বলা হয়, বাবা-মা মুক্ত ও স্বাধীনভাবে সন্তান নেয়া এবং বিরতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। ১৯৯৪ সালে কায়রোয় অনুষ্ঠিত জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ঘোষণাপত্রের ধারা ৮-এ বলা হয়, সন্তান সংখ্যা, দুই সন্তানের মাঝে বিরতি দেয়ার বিষয়টি ব্যক্তির অধিকার। একটি রাষ্ট্রের যে কয়েকটি মৌলিক উপাদান রয়েছে তার মধ্যে জনসংখ্যা অন্যতম। আর এই জনসংখ্যা কোনো দেশের জন্য স¤পদ আবার কোনো দেশের জন্য বোঝা। অনেক দেশে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে স¤পদ হিসেবে বিচেনায় না করে বোঝা হিসেবে বিবেচনায় নেয়। তবে সমসাময়িক প্রযুক্তি এবং উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে অতিরিক্ত জনসংখ্যা দক্ষ করতে পারলে তা স¤পদে পরিণত করা সম্ভব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, অপুষ্টি, পর্যাপ্ত শিক্ষার সুযোগ, বেকারত্ব, চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতার মূলে রয়েছে অতিরিক্ত জনসংখ্যা। আর এসব বিষয়কে সামনে রেখে জনসংখ্যা বিষয়ক সমস্যাগুলো সকলকে অবহিত করা এবং তা গুরুত্ব সহকারে সমাধানের প্রচেষ্টা করাই হলো দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে প্রতি মিনিটে বিশ্বে ২৫০টি শিশু জন্মগ্রহণ করে। যেসব রাষ্ট্র এই জনসংখ্যাকে বোঝা হিসেবে দেখে, তারা জনসংখ্যা বৃদ্ধিকেই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। তবে জনসংখ্যা সমস্যা নিয়ে কিছুটা বৈশ্বিক বিতর্কও আছে। অনেকের মতে পৃথিবীর যে সীমিত স¤পদ রয়েছে তাতে সর্বোচ্চ ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি লোককে জায়গা দেওয়া সম্ভব। তাদের মতে ধীরে ধীরে জনসংখ্যা কমিয়ে আনা উচিত। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও উন্নত বণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদাও পূরণ করা সম্ভব বলে মনে করেন অনেকে বিশেষজ্ঞ। জনবহুল সমস্যায় জর্জরিত চীন এক সন্তান নীতির মাধ্যমে জনসংখ্যা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। আবার কিছু দেশ ঋণাত্মক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের কারণে উল্টো বৃদ্ধি নীতিও গ্রহণ করেছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই প্রবণতা খুব বেশি আগের নয়। মূলত কৃষি বিপ্লবই জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। এর পূর্বকার সময় খাদ্যাভাব পরোক্ষভাবে জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে নগরায়ন, বন উজাড়, জলবায়ুর পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বৈশ্বিকউষ্ণতা ক্রমশই বাড়ছে। এরসাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। সেইসাথে বিশ্বজুড়ে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও বিবাদ নানা কারণে বাস্তুচ্যুতি ও জোরপূর্বক অভিবাসন তো রয়েছেই। এসব দুর্যোগ ও দ্বন্দ্বে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আর এসব দিক বিবেচনায় বিশ্বে জনসংখ্যার ধনাত্মক কিংবা ঋণাত্মক হার যেটিই হোক তা বিশ্ববাসীর জন্য কল্যাণই বয়ে আনবে বলে আশা করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান ২০২২ নামের এই প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাস্থ্যসেবার জনবলে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এই জনবলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। সবার ওপর রয়েছে মালদ্বীপ। জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদর দপ্তরে ৭৫তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনের স্বাস্থ্য খাতের পরিসংখ্যান নিয়ে এই বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মূলত টেকসই উন্নয়ন অভিষ্টের (এসডিজি) স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অবকাঠামো বা আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকাই যথেষ্ট নয়। সেগুলো কার্যকরভাবে চালু রাখার জন্য পর্যাপ্ত ও দক্ষ জনবল থাকা জরুরি। এসডিজি অর্জনের জন্য তৈরি করা জনবল কৌশলপত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, এক হাজার মানুষের সেবা দেওয়ার জন্য ৪ দশমিক ৪৫ জন চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ দরকার। বাংলাদেশে এক হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক আছেন শূন্য দশমিক ৬৭ জন। আর এক হাজার মানুষের জন্য নার্স ও মিডওয়াইফ আছেন শূন্য দশমিক ৪৯ জন। এক হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ আছেন ১ দশমিক ১৬ জন। অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মানদণ্ডের চেয়ে ৭৪ শতাংশ চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ কম আছে। প্রতিবেদনে মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্যবিধি, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ, টিকাসহ ৫০টির বেশি সূচকের পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ২০১৬ সালের তথ্যও ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে বছরে ২০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় অনিরাপদ পানিসংশ্লিষ্ট সমস্যার কারণে। পাঁচ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয় বিষক্রিয়ায়। সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন রোগের মৃত্যুর তথ্যও প্রতিবেদনে আছে। অন্যের হাতে মৃত্যুর তথ্যও প্রতিবেদনে এসেছে। দেশে এক লাখ মানুষের মধ্যে বছরে ২ দশমিক ৮ জন খুন হয় অন্যের হাতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩ লাখ। সেই হিসাবে, বছরে ৪ হাজার ৭৬৮ জন মানুষ অন্যের হাতে খুন হচ্ছে। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে ১৩ জন মানুষ অন্যের হাতে মারা যাচ্ছে। প্রতিবেদনে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ মানুষ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার সূচক অনুযায়ী সেবার আওতায় আছে। এর অর্থ দেশের ৫১ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনের সময় মানস¤পন্ন সেবা পায়। এর অন্য অর্থ হচ্ছে, ৪৯ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনের সময় মানস¤পন্ন সেবা পায় না। পাশাপাশি বলা হচ্ছে, ২৪ শতাংশ মানুষের পারিবারিক আয়ের ১০ শতাংশ চলে যায় চিকিৎসা খরচ মেটাতে। ৮ শতাংশের বেশি মানুষ পারিবারিক আয়ের ২৫ শতাংশের বেশি খরচ করে চিকিৎসার পেছনে। কয়েক বছর ধরে জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা বলে আসছেন, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দেশের অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে, অনেকে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রায়ই বলে থাকি, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। মানব উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসাবে স্বাস্থ্য সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক) এবং ১৮(১) অনুসারে চিকিৎসাসহ জনগণের পুষ্টি স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।

সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত অন্যতম খাত স্বাস্থ্য। বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছরে এ খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্য ছাড়াও অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির বিস্তার, মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ ও মৃত্যুহার নিম্নমুখী, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রীর নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩০-এ আনয়ন, গড় আয়ু বেড়ে ৭২.৮ বছর, অপুষ্টি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে দেশব্যাপী ভিটামিন এ ও ফলিক এসিড বিতরণ এসবই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সাফল্যের চিত্র।

বাংলাদেশে রোগী-চিকিৎসক স¤পর্কের ক্রমাবনতি, অনাস্থা, অসন্তুষ্টি সমস্যাগুলো পুরনো। জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির গবেষণায় বলছে, সঠিক রোগ নির্ণয়, কার্যকর চিকিৎসা এবং চিকিৎসার ফলাফল বা ট্রিটমেন্ট আউটকাম নির্ভর করে চিকিৎসক ও রোগীর স¤পর্কের ওপর। চিকিৎসা সেবা নিয়েও রয়েছে বিপরীত বক্তব্য। আমরা মনে করি, সমস্যাগুলো পুরাতন ও বহুমাত্রিক হলেও দূরত্ব কমাতে আলোচনা, প্রয়োজনে মাসিক গণশুনানি ও চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি। জেলা হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা সরকারি হাসপাতালের তুলনায় প্রাইভেট চেম্বারে বেশি আগ্রহী, সকল শ্রেণির মানুষের জন্য ন্যূনতম ওষুধও পাওয়া যায় না। সরকারের ভিশন হলো, সুস্থ জাতি সমৃদ্ধ দেশ। মিশন হলো, স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়নের মাধ্যমে সবার জন্য গুণগত স্বাস্থ্যসেবা ও পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করা। তা নিশ্চিত করতে নিুলিখিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

ক) দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য স্বাস্থ্যবীমা পলিসির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকার প্রয়োজনে এ পলিসির প্রদানের উদ্যোগ নিতে পারে। এই প্রিমিয়ামের অর্থ চিকিৎসকসহ অন্যান্যদের বেতন ভাতা বাবদ বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা প্রার্থী নাগরিকের অধিকার ও চিকিৎসকের ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে।

খ) হাসপাতালগুলোতে দালালের দৌরাত্ম্য বন্ধ ও গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিয়মিত গণশুনানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

গ) ডাক্তারদের স্বতন্ত্র বেতন-কাঠামো তৈরি করে তাদেরকে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে আর্থিক নিশ্চয়তার বিধান করলে তাদের প্রাইভেট র্প্যাকটিসে অনেক সময় যে নৈরাজ্য চলে তা কিছুটা হলেও কমবে।

ঘ) উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ঙ) আত্মীয়করণ বদলি প্রথা বন্ধ করা প্রয়োজন।

চ) তরুণ চিকিৎসকের বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য প্রেষণা প্রদান প্রয়োজন।

ছ) ওষুধ, খাবার ও অন্যান্য সকল কেমিকেল, মেডিকেল মালামাল ক্রয়ে পিপিআর-৮ (ই-টেন্ডার) প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে। বাৎসরিক প্রয়োজন নির্ধারণ করতে হবে যেন ঘাটতি না পড়ে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি। আমরা মনে করি, চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যবিদ, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, পেশাজীবী সংগঠন, নাগরিক সমাজ বসে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের এখনই উপযুক্ত সময়। বিদ্যমান স্বাস্থ্য ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রাখা, একই সঙ্গে সেবার সঠিক মূল্যায়ন ও কার্যকর সেবা প্রদান বা সেবা গ্রহণে সার্ভিস প্রদান কার্যক্রমকে পর্যালোচনা করা, নতুন চাহিদার পরিসরে সুরক্ষা বা নিরাপত্তা প্রদান করা। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করা, নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে অত্যাবশ্যকীয় সেবা খুঁজে বের করা ও বহুমুখী সেক্টর পরিকল্পনা করে অগ্রসর হওয়া। নীতিনির্ধারকদের এসব বিষয়ে কোভিডকালীন উপাত্তের শূন্যতা পূরণে কাজ করতে হবে। জন্ম-মৃত্যুর সঠিক ও সময়মতো উপাত্তের ভিত্তিতে পরিবর্তনকে বিবেচনায় নিয়ে সব ক্ষেত্রে প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন