পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মিয়ানমারে মুসলমান অধ্যুষিত রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনী কর্তৃক ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা চালানোর বিরুদ্ধে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। মুসলমান নিধনের প্রতিবাদে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। ক্ষুব্ধ, বিক্ষুব্ধ মানুষ রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাঁচাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বর ও পৈশাচিক গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। কোনো কোনো পক্ষ থেকে দাবী উঠেছে মিয়ানমারের উপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করার জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন, নির্যাতন ঠেকাতে মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। এছাড়া মিয়ানমার সরকারের বোধোদয় হবে না। বাংলাদেশের ইসলামি সংগঠনগুলো দাবী করেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও অং সান সূচির উপর গণহত্যার অভিযোগ আনতে হবে। মিয়ানমারের উপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও সেখানে শান্তিরক্ষি বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যবস্থা করাসহ অবিলম্বে ত্রাণ তৎপরতা শুরু করতে হবে। তারা ওআইসি’র সমালোচনা করে বলেছে, ওআইসি মুসলমানদের রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমারের উপর ওআইসি কর্তৃক অবরোধ আরোপ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধেরও আহ্বান জানায় তারা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর যে নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতন এবং হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, তা ইতিহাসে বিরল। এমন নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ হিটলারের অত্যাচার ও গণহত্যাকেও হার মানিয়েছে। মিয়ানমারে এখন যা ঘটছে, তাকে ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। লন্ডনের কুইনমেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিউএমইউএল-এর গবেষকরা মিয়ানমারে সরেজমিনে চালানো এক গবেষণায় রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার প্রমাণ দাবী করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, দেশটির সরকার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের সমষ্টিগতভাবে শাস্তি দিচ্ছে। মিয়ানমারের এ আচরণকে সংস্থাটি ‘নিষ্ঠুর’ আখ্যা দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের উপর কী ধরনের বর্বরতা চলছে তার বিবরণ পাওয়া যায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের কাছ থেকে। তারা বলেছেন, সেখানে নিরপরাধ মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মারছে সেনাবাহিনী। শিশুদের জ্বলন্ত আগুনে ছুড়ে হত্যা করা হচ্ছে। স্বজনদের সামনে অনেককে জবাই করা হচ্ছে। অনেককে হাত-পা কেটে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে। ১০ বছরের বেশি ছেলেদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে। শত শত নারীকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। প্রতিটি গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, মানুষ কর্তৃক মানুষ হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়নের এমন দৃষ্টান্ত সকল গণহত্যাকে হার মানিয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, জাতিসংঘসহ বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এ নিয়ে তেমন কোনো বিকার নেই। তারা বক্তব্য-বিবৃতি ও দুঃখ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত আছে। কেবল লিপ সার্ভিসের মধ্যেই তাদের দায়িত্ব শেষ করছে। অবিলম্বে যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, তার কোনো সদিচ্ছা তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তাদের আচরণে এটাই প্রতীয়মান হয়, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যেভাবে মুসলমানদের হত্যা ও উচ্ছেদ করা হচ্ছে, মিয়ানমারের মুসলমানদের উপর চালানো গণহত্যা এবং উচ্ছেদকেও তার সাথে শামিল করা হচ্ছে। মুসলমান হত্যা ও নির্যাতনকে তারা মানবতার পাল্লায় পরিমাপ করছে না। মুসলমানদের ক্ষেত্রে তাদের বিবেক, বোধ ও মানবিকতা নিষ্ক্রিয়। বিগত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে রাখাইনে যে গণহত্যা চলছে, তাতে তাদের মধ্যে এতটুকু বিচলন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ মুসলমানদের বাইরে অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপর ফুলের টোকা পড়লেই তাদের টনক টনটনিয়ে উঠে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তারা মিয়ানমার সরকারকে গণহত্যা বন্ধের কথা না বলে পালিয়ে বেড়ানো রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার কথা বলছে। রাখাইনে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের ঢুকতে দিচ্ছে না বলে অনুযোগ করছে। তাদের এ আচরণ যে ‘লোক দেখানো’ তা ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থে মুসলমান দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত ওআইসি এবং আরব লীগ এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ সীমিত সামর্থ্য ও সাধ্যের মধ্যে থেকেও রোহিঙ্গাদের পক্ষে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ করেছে। যেসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে তাদের আশ্রয় ও খাদ্যসংস্থান করছে। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও যারা এ দেশে এসে পড়েছেন, তারাও তো মানুষ। আমরা যতদিন পারি তাদের এ দেশে রাখব। চীন ও থাইল্যান্ড রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য তাদের সীমান্ত খুলে দিয়েছে। মিয়ানমারের প্রতিবেশি দেশগুলো এমন মানবিক আচরণ করলেও অং সান সূচির মধ্যে তার দেশের আদি বাসিন্দাদের জন্য বিন্দুমাত্র মায়া-মমতা দেখা যাচ্ছে না। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেও তার নেতৃত্বেই এই গণহত্যা চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে তার শান্তি পুরস্কার প্রত্যাহার করার জন্য মানব দরদী মানুষের পক্ষ থেকে দাবী উঠেছে।
মানবতার ক্ষেত্রে কোনো জাত-পাত ও ধর্ম কাজ করে না। বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং জীবন বাঁচানোই মানবতার মূল চেতনা। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের বৈষম্য থাকতে পারে না। আমরা লক্ষ্য করছি, মানবতার বিষয়টি কেবল মুসলমানদের ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হচ্ছে। বিশেষ করে বিশ্বের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও দেশগুলোর আচরণে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলো এবং তাদের দ্বারা গঠিত সংস্থাগুলোর নীরবতাও মানবতার বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা মনে করি, রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যেভাবে নিরীহ মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করছে, এ ব্যাপারে বিশ্ব বিবেকের জাগ্রত হওয়া উচিত। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশসহ এশিয়ার যেসব রাষ্ট্রে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, তার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা জরুরি। সবার আগে অনতিবিলম্বে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর উপর হস্তক্ষেপ করে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া অপরিহার্য। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। শুধুমাত্র ‘মিয়ানমার মুসলিম বিতাড়ন চায়’ বলে দায়সারা বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। সেনাবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছে এবং চালাচ্ছে, তা তদন্তে আন্তর্জাতিক তদন্ত সংস্থা গঠন করতে হবে এবং দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। রোহিঙ্গারা যাতে তাদের দেশে নাগরিক মর্যাদা নিয়ে নির্বিঘেœ থাকতে পারে, সে ব্যাপারে স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।