Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্কট ও সামাজিক-রাজনৈতিক দুষ্টচক্র

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৬ জুলাই, ২০২২, ১২:০১ এএম

দেশে শিক্ষার মানহীনতা এবং শিক্ষাব্যবস্থার সংকট এখন সাধারণ মানুষকেও ভবিয়ে তুলেছে। দীর্ঘদিন ধরেই এই সংকট নিয়ে আমরা গণমাধ্যমে কথা বললেও সরকারের সংশ্লিষ্টদের টনক নড়েনি। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যম এবং পঞ্চম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে সম্মিলিত সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরেও রাষ্ট্রের ফিফ্থ স্টেট বা পঞ্চম স্তম্ভ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাম্প্রতিক দশকে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং দেশের প্রতিটি সেক্টরে সর্বব্যাপী দুর্নীতি-অনিয়ম, অবক্ষয় ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেশের সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে। আর এর পশ্চাতে কাজ করেছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মানহীনতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের বৈশিষ্ট্য মুছে ফেলার দুরভিসন্ধিমূলক শিক্ষানীতি থেকেই এই সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। একদিকে শিক্ষার মানহীনতা অন্যদিকে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে, অকার্যকর করে তোলার মধ্য দিয়ে দেশে একটি একপাক্ষিক অসহিষ্ণু ও অস্থিতিশীল সামাজিক কাঠামো সৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে বিজাতীয় সংস্কৃতি আমাদের নতুন প্রজন্মের মন মগজকে গ্রাস করে নিলেও তার বিপরীতে জাতীয়, আদর্শিক ও নৈতিক মানদণ্ডের কোনো রক্ষাকবচ নেই। শুধুমাত্র আইন করে বা পুলিশ দিয়ে মানুষের নৈতিক চরিত্র ঠিক রাখা অসম্ভব। এর জন্য অবশ্যই শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে পরমার্থিক শক্তি ও বিশ্বাসের প্রতি অবিচল আস্থা ও পারলৌকিক জবাবদিহিতার শিক্ষা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আমাদের শিক্ষানীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যে রাজনৈতিক এক্সপেরিমেন্ট চলছে, তার সাথে আমাদের সমাজবাস্তবতা ও লৌকিক জীবনের কোনো সংযোগ না থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিতদের মধ্যে ভোগবাদী, দুর্নীতিবাজ ও সামাজিক দায়বদ্ধতাহীন একটি শ্রেণী গড়ে উঠেছে। সেই শ্রেণীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্ম এখন আমাদের সমাজ ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অঙ্গন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের ভেতরে এই শ্রেণীর তৃতীয় প্রজন্ম যেন এখন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের রূপ ধারণ করেছে। এরা তুচ্ছ কারণে পিটিয়ে মেধাবী সহপাঠীকে হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না। পবিত্র শিক্ষাঙ্গনে নারীর শ্লীলতাহানি অথবা ব্যক্তিগত ধর্ষণের উচ্চ সংখ্যাকে সেলিব্রেট করার ঘটনাও শোনা গেছে। গত সপ্তাহে আশুলিয়ার চিত্রাশাইল এলাকায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর হাতে ক্রিকেট স্ট্যাম্পের আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে হাসপাতালে নিহত হওয়ার পর শিক্ষার অবক্ষয় সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চাপা ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটতে দেখা যাচ্ছে। বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী জিতু শিক্ষককে স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত করার তাৎক্ষণিক দৃশ্যমান কোনো কারণ ছিল না। সে নাকি বেপরোয়া মটরসাইকেল চালাতো, স্কুলের মেয়েদের উত্ত্যক্ত করতো। বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান উৎপল কুমার সে সব আচরণে বিরক্ত ছিলেন এবং তাকে সংশোধনের জন্য চাপ দিয়েছিলেন। সম্ভবত এটাই ছিল তার প্রতি হিংস্রতার কারণ। অভিযুক্ত সেই শিক্ষার্থীসহ আরো কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে।

নরাইলে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় বেশ কয়েকজন গ্রেফতার, রিমান্ড এবং স্থানীয় অজ্ঞাতনামা প্রায় ২০০ জনের নামে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। এলাকায় আতঙ্কজনক অবস্থা বিরাজ করছিল বলে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। ভারতের বিজেপি নেত্রী নুপুর শর্মা ইসলাম ধর্মের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করে ভারতসহ সারাবিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। বিজেপি থেকে সেই নুপুর শর্মাকে বহিষ্কার করার পরও ভারতের মুসলমানদের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ ঘটনায় ভারতের সাথে মুসলিম বিশ্বের কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশ্বনবী সম্পর্কে বিজেপি নেত্রীর ঘৃণ্য মন্তব্য সমর্থন করায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হিন্দু-মুসলমান সংঘাত ও রক্তারক্তি ঘটনার সংবাদ এখনো পাওয়া যাচ্ছে। গত সপ্তাহে রাজস্থানের উদয়পুরে এক হিন্দু দর্জি বহিষ্কৃত বিজেপি মুখপাত্র নুপুর শর্মার ইসলাম বিদ্বেষি মন্তব্য সমর্থন করে পোস্ট দেয়ার পর স্থানীয় মুসলমান যুবকদের ছুরিকাঘাতে নিহত হওয়ার পর প্রশাসন পুরো শহরে কার্ফিউ জারি করতে বাধ্য হয়েছে। ভারতে যখন এই অবস্থা তখন শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে কেউ যদি নুপুর শর্মাকে সমর্থন করে ফেসবুকে পোস্ট দেয় এবং স্থানীয় জনগণের ক্ষোভের মুখেও তা ডিলিট করতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে বুঝতে হবে এর পেছনে কোনো বদ মতলব ছিল। ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে আঘাত দেয়ার পরও কলেজ অধ্যক্ষ তাৎক্ষণিক যথাযথ ব্যবস্থা নিলে পরবর্তী ঘটনা হয়তো ঘটত না। যেখানে ইউরোপের প্যারিসে বা ভারতের রাজস্থানে ও ইসলাম অবমাননাকারিদের বিরুদ্ধে নিজের জীবন বাজি রেখে চরমপন্থা অবলম্বন করতে দেখা গেছে, সেখানে বাংলাদেশে কলেজ অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করার মত ঘটনাকেও আমরা সমর্থন বা প্রশ্রয় দিতে রাজি নই। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় স্থানীয় পুলিশের ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। একইভাবে তাৎক্ষণিকভাবে নুপুর শর্মার সমর্থনে পোষ্টদাতা হিন্দু শিক্ষার্থীকে পোস্ট ডিলিট করতে চাপ না দেয়া বা তার পক্ষ নেয়ার যে অভিযোগ উঠেছে তা যদি সত্য হয় তবে সেই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ। তার অবহেলা বা ব্যর্থতার কারণে একটি বড় ধরণের সাংঘর্ষিক অবস্থা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপে তা রোধ করা সম্ভব হলেও এ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়া জরুরি। শিক্ষককে লাঞ্ছনার জন্য অভিযুক্ত কয়েকজনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে এবং প্রায় ২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ঠিক একইভাবে যে ঘটনার কারণে এই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা জরুরি। দু:খজনক বিষয় হচ্ছে, প্রায় একই সময়ে দেশের দুই প্রান্তে দুই কলেজ শিক্ষক হত্যা ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন, তারা দুজনই হিন্দু। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনাকে কেউ কেউ সাম্প্রদায়িক রং চড়াচ্ছেন। এসব ঘটনায় সারাদেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হতে দেখা গেছে।

আমরা আঙুল তুলে দেখাচ্ছি, শিক্ষাঙ্গণে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সমাজে, রাষ্ট্রে, রাজনৈতিক অঙ্গণে প্রতিদিন যে অসংখ্য দুর্নীতি, অপকর্ম, অবিচার, লুণ্ঠন ও চৌর্যবৃত্তির ঘটনা ঘটে চলেছে তার জন্যও আমাদের শিক্ষাঙ্গণ ও শিক্ষাব্যবস্থার পরোক্ষ দায় আছে। দায় আছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন ও শিক্ষা প্রশাসনেরও। দেশে গণতন্ত্র না থাকায় জনবিচ্ছিন্ন টাকাওয়ালা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সংসদ সদস্য হয়ে জনগণের স্বার্থের বদলে নিজের চ্যালা-চামুন্ডাদের স্বার্থে কাজ করেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বেশিরভাগ মূলত বিনাভোটে নির্বাচিত মন্ত্রী-এমপিদের আর্শিবাদপুষ্ট। স্থানীয় হাট-বাজার, মার্কেট, লঞ্চঘাট, গুদারাঘাট, বাস-ট্রাকস্ট্যান্ডের টোল ও চাঁদাবাজিতে যেমন তাদের দখলবাজির রাজত্ব কায়েম হয়েছে, একইভাবে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত তাদের দখলবাজি, লুটপাট-চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য ও রাজনৈতিক দলবাজির আখড়ায় পরিনত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গণ সন্ত্রাস-দুর্নীতি ও ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া প্রতাপের শিকার হয়েছে। গত এক দশকে তা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। গত একযুগ ধরে দেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডল থেকে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ক্ষমতাসীনরা সব ধরণের বিরোধি মত ও রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধের মাধ্যমে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে সর্বত্র এক ধরণের শান্তিপূর্ণ স্থিতিশীলতা বিরাজ করলেও এ সময়টাকে আমরা আমাদের শিক্ষাঙ্গণের জন্য একটা অন্ধকার যুগ বলে বিবেচনা করতে পারি। আমরা নানাবিধ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রাকৃতিক ও মানবিক সংকট ও সর্বব্যাপী অবক্ষয়ের সময়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবি শিক্ষার্থীরা খাচায় বন্দি ফার্মের মুরগির মত মোটাতাজা হয়ে বেড়ে উঠেছে। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রত্যাশিত ইতিবাচক পরিবর্তনে এরা তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। উপরন্তু কেউ ব্যক্তিগতভাবে এসব অনিয়ম-দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মত প্রকাশ করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন। বুয়েটের মেধাবি শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ভারতের পানি আগ্রাসন ও অসম পানিচুক্তি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় ছাত্রলীগ নেতারা বুয়েটের হলে ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। জনগণের রাজস্বের হাজার হাজার কোটি টাকায় পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ রুদ্ধ করে দলীয় বিচারে প্রশাসন, ভিসি, শিক্ষক নিয়োগ ও পদায়নের কারণে সেখানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। তারই প্রভাব পড়েছে সমাজের প্রতিটি স্তরে এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে। এর মধ্যে শিক্ষা বিভাগ সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত সেক্টর হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। গত কয়েক দিনে ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষা অধিদফতরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা দেশের ২৬ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে বছরে দেড় হাজার কোটি ঘুষ আদায় করে থাকেন। এমনিতেই বাংলাদেশের শিক্ষকরা বিশ্বের যেকোনো দেশের শিক্ষকদের চেয়ে কম বেতন পান। এমপিওভুক্ত একজন শিক্ষককে বছরে গড়ে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। তথাকথিত নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তি বাণিজ্য থেকে শুরু করে কোচিং বাণিজ্য, বছরের পর বছর ধরে গলাকাটা টিউশন ফির গ্যাড়াকল পেরিয়ে পাবলিক পরীক্ষার আগে জুয়ার মত প্রশ্নপত্র ফাঁসের বাণিজ্যের টোপ অত:পর উচ্চগ্রেড প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা যখন চাকরির বাজারে ঢুকতে গিয়ে লাখ লাখ টাকা ঘুষ বা লেনদেনের অনিবার্য বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের নিয়োগের ইন্টারভিউ থেকে শুরু করে এমপিওভুক্তি পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিক-পরিচালক, ম্যানেজিং কমিটি ও স্থানীয় নেতা এবং মাউশির কর্মকর্তাদের দাবি মিটিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হয়। এরপর চাকরির শেষদিন এবং পেনশন পর্যন্ত এই অনৈতিক বাণিজ্যের সাথে আপস করেই চলতে হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) বিভাগের একটি আঞ্চলিক উপপরিচালকের কার্যালয়ের কম্পিউটার অপারেটরের ধনকুবের হয়ে যাওয়ার গল্পও অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

দেশে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা সামাজিক প্রগতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে নেতৃত্বের সূতিকাগার হয়ে উঠেছে। অক্সফোর্ড, ক্যাম্ব্রিজ হাবার্ড, এমআইটি থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নেতৃত্বের শীর্ষ আসন দখল করে আসছে। এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত শতবছরের প্রাচীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন বিশ্বের প্রথম ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পায়না। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বের দেড়শতাধিক মেট্রোপলিটান শহরের মধ্যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান পাচ্ছে। একিউআই বাএয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স নামের র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বায়ু বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষিত। মানি লন্ডারিং বা টাকা পাচারের আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ তিনটি দেশের মধ্যে রয়েছে। গণতান্ত্রিক বিশ্বের সূচকে গত একযুগ ধরে বাংলাদেশ পূর্বের ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের অবস্থান থেকে হাইব্রিড রিজিমের চক্করে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেশের রাজনীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সুশাসনের প্রত্যাশিত অবস্থান থেকে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির প্রতিটি স্তুরে দুর্নীতি, বিচারহীনতা, অবক্ষয়, অশ্লীলতা, অসহিষ্ণুৃতা ও সহিংসতার বিস্তার ঘটে চলেছে। আর এসবের মূলে রয়েছে আমাদের অপরিনামদর্শি, লক্ষ্য ও দিকনির্দেশনাহীন শিক্ষানীতি, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা ও বিভ্রান্তিকর শিক্ষাকারিকুলাম । এই শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দরিদ্র জনগণের রাজস্ব ব্যয়ে উচ্চশিক্ষিত প্রজন্মকে দেশের মানুষের সেবায় ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে অথবা যারা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিয়ে দেশে থাকছেন তাদের বেশিরভাগই জনগণের সম্পদ লুন্ঠন করে টাকা বিদেশে পাচার করে দিতেই যেন দেশে থাকছেন। ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানি, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির উচ্চশিক্ষিত মালিক-পরিচালকদের বড় অংশই শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। অথচ সমাজের একশ্রেণীর তথাকথিত প্রগতিশীল উচ্চশিক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারি ব্যক্তি দেশে মাদরাসা ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেড়ে যাওয়ায় আক্ষেপ করে থাকেন। এক সময় তারা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদি মিডিয়াগুলোর সাথে সুর মিলিয়ে আমাদের মাদরাসাগুলোকেও জঙ্গিবাদের আখড়া বলে প্রচার করার কোশেশ করেছে। শেষ পর্যন্ত তা মিথ্যা প্রপাগান্ডা হিসেবেই প্রমানিত হয়েছে।

দেশে নানা ধরণের কারিক্যুলামের হাজার হাজার মাদরাসা থেকে লাখ লাখ শিক্ষার্থী বেরিয়ে আসছে। তাদের মধ্যে অনেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষার মূল ধারায় মেধার প্রতিযোগিতায় প্রথম সারিতে স্থান করে নিচ্ছে। মাদরাসা শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়া বা অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা খুবই কম। এ থেকে বুঝা যায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশের শিক্ষাকারিক্যুলামে মুসলমানদের জন্য কোরান-হাদীসের শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হলে দেশ কখনো এতটা দুর্নীতি-দুরাচার প্রবণ হতে পারত না। দেশের শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকা এবং শিক্ষা কারিক্যুলামে বিজাতীয় ও বিধর্মীয় সংস্কৃতির চর্চা দেশের মুসলমান সমাজের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে দেয়া বক্তব্যে বিরোধিদলের একজন সংসদ সদস্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাকারিক্যুলামে ইসলামি শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ টপিক বাদ দিয়ে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি চর্চার উপযোগি বিষয় অনুপ্রবেশের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। জাতীয় সংসদে দেয়া এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যদিও মাননীয় সংসদ সদস্য শিক্ষা কারিক্যুলামে যে পরিবর্তনের কথা বলেছেন তা কয়েক বছর আগে দেশের আলেম-উলামাদের দাবির মুখে পরিবর্তন করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এটি আমাদের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার আংশিক সামান্য চিত্র মাত্র। একদিকে দেশে লাখ লাখ শিক্ষিত যুবক বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে হতাশায় মাদকসহ নানা রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধপথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। অন্যদিকে দেশের রফতানিমুখী গার্মেন্টস খাত, আইটি খাত থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেক্টরে লাখ লাখ বিদেশি কর্মী(প্রধানত ভারতীয়) উচ্চ বেতনে চাকরি করে বাংলাদেশ থেকে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে। জাতিগঠন, নৈতিক ও আদর্শিক দিক বাদ দিলেও প্রায়োগিক দিক থেকেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা এভাবেই ধরা পড়ছে।

[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন