পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
অবশেষে দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দুয়ার খুলে দেয়া হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতুর ফলক উন্মুক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শনিবার মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে যানবাহন চলাচলের জন্য বহুল প্রত্যাশিত ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ স্বপ্নের পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
স্বপ্নের এই সেতু রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য বড় শহরের সাথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক অগ্রগতি বয়ে আনবে। এর আগে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে মাওয়ায় পৌঁছান। বর্ণাঢ্য এই অনুষ্ঠানে মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা ছাড়াও ঢাকায় কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকসহ হাজারো বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম মেগা প্রকল্পের জমকালো উদ্বোধন উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর সময়সূচি অনুযায়ী মাওয়া পয়েন্টে সকাল সাড়ে ১১টায় স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির সীট, উদ্বোধনী খাম এবং বিশেষ সিলমোহর উন্মোচন করেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে ১.২ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত জিডিপি বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অতপর মাওয়া পয়েন্টে সকাল ১১টা ৪৯ মিনিটে টোল পরিশোধের পর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন। এরপর তিনি মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্ট থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী জাজিরা পয়েন্টে পৌঁছে সেতু ও ম্যুরাল-২-এর উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন। সেখানে মোনাজাতেও অংশগ্রহণ করেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাবলীল ভাষায় মোনাজাত পরিচালনা করেন। তবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতে দেখা যায়নি।
পদ্মা সেতু আশপাশের সবকিছুই বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছিল। সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে মহড়া দিয়েছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ৩১টি বিমান ও হেলিকপ্টার। বিমানবাহিনীর মহড়া পদ্মা সেতুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাওয়া পয়েন্টে টোল পরিশোধ করে সেতু দিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট স্থানে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি থামলে দুপুর সোয়া ১২টায় বাংলাদেশে বিমান বাহিনী মহড়া শুরু হয়। ফাইটার বিমান থেকে রঙ ছড়ানো হয় পদ্মার উন্মুক্ত আকাশে। লাল-সবুজসহ বিভিন্ন রঙে বর্ণিল হয়ে উঠে পদ্মার আকাশ। এছাড়া বিমান বাহিনীর পাঁচটি হেলিকপ্টার উড়ে বেড়ায় পদ্মার আকাশে। প্রথম হেলিকপ্টারে ছিল বাংলাদেশের ছবি সংবলিত পতাকা, দ্বিতীয় হেলিকপ্টারে ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছবি, তৃতীয় হেলিকপ্টারে ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সংবলিত কাপড়ের পতাকা, চতুর্থ হেলিকপ্টারে ছিল পদ্মা সেতুর অর্জন স্বপ্নজয় সংবলিত পতাকা, পঞ্চম হেলিকপ্টারে ছিল জাতীয় সেøাগান জয়বাংলা সংবলিত পতাকা। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি আকাশে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ডিসপ্লে ও মিগ-২৯ এর ফ্লাইপাস মন্ত্রমুগ্ধ করে অপেক্ষমাণ পদ্মা সেতুর দু’পাড়ের লাখো মানুষকে। এসময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে উপস্থিত থেকে বিমান বাহিনীর ডিসপ্লে ক্যামেরাবন্দি করতে দেখা যায়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী মেয়ে পুতুলের সঙ্গে সেলফি তোলেন।
এদিকে মাদারিপুরের কাঠালবাড়িতে বিভিন্ন রং-বেরঙের সাজসজ্জা করে নৌকা নিয়ে জনসমাবেশে যোগ দেন নেতাকর্মীরা। সমাবেশস্থলটি পদ্মা নদীর পাশে হওয়ায় সহজেই নৌকা নিয়ে তারা সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। শরীয়তপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর জেলা থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে সমাবেশস্থলে আসছে মানুষ।
গতকাল সব পথ মিলে গিয়েছেল পদ্মা সেতু পাড়ে। উদ্বোধনের পর হাজার হাজার মানুষ পায়ে হেটে পদ্মা সেতু পার হচ্ছেন। আজ রোববার যানবাহন চলাচলের জন্য সেতু খুলে দেয়া হবে। এখন থেকে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ সরাসরি সড়কপথে ঢাকায় যেতে পারবেন। এর মধ্যদিয়ে তারা ফেরিঘাটের যন্ত্রণাদায়ক দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। তারা এখন এ সেতুর ওপর দিয়ে মাত্র ৬ মিনিটে এ নদী পার হবেন।
স্বপ্নের এ পদ্মা সেতু শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকা ও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সরাসরি সড়ক ও রেল যোগাযোগই স্থাপন করেনি না বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক সংযোগ ও বাণিজ্যের দ্বার খুলে দিল। এছাড়া, এ সেতু সাধারণভাবে সারা দেশের পাশাপাশি বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সমৃদ্ধি আনয়নের ক্ষেত্রে পরিবহন সময় ও অন্য ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রভাব রাখবে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে হাজার বিতর্ক ছিল। কিন্তু সব বিতর্ককে থোরাইকেয়ার করে শেখ হাসিনা ঘোষণা অনুযায়ী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়।
প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, মূল সেতু নির্মাণের কাজটি করেছে চীনের ঠিকাদার কোম্পানি চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) এবং নদীশাসন করেছে চীনের সিনো হাইড্রো কর্পোরেশন। মোট ৩০ হাজার ১৯৩৩.৭ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে।
২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুর নির্মাণকাজে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে পদ্মা সেতুর অংশ দৃশ্যমান হয়। পরে একের পর এক ৪২টি পিলারের ওপর বসানো হয় ৪১টি স্প্যান। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ ৪১তম স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে বহুমুখী ৬.১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর সম্পূর্ণ কাঠামো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। মূল সেতু নির্মাণের ব্যয় ১২ হাজার ১৩৩.৩৯ কোটি টাকা (৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন টাওয়ার এবং গ্যাস লাইনের জন্য ১০০০ কোটি টাকাসহ) এবং ১৩.৮ কিলোমিটার নদীশাসন কাজের ব্যয় ৯৪ হাজার কোটি টাকা।
টোল প্লাজা এবং এসএ-২ সহ ১২ কি.মি. অ্যাপ্রোচ রোডের নির্মাণব্যয় ১ হাজার ৯০৭.৬৮ কোটি টাকা (২টি টোল প্লাজা, ২টি থানা ভবন এবং ৩টি পরিষেবা এলাকাসহ) যেখানে পুনর্বাসনের ব্যয় ১ হাজার ৫১৫.০০ কোটি টাকা, ২ হাজার ৬৯৩.২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় ব্যয় ১ হাজার ২৯০.৩ কোটি টাকা, কনসালটেন্সি ৬ হাজার ৭৮৩.৭ কোটি টাকা এবং অন্যান্য (বেতন, পরিবহন, সিডি ভ্যাট এবং ট্যাক্স, ফিজিক্যাল এবং প্রাইস কন্টিনজেন্সি, ইন্টারেস্ট ইত্যাদি) ১ হাজার ৭৩১.১৭ টাকা।
পদ্মা বহুমুখী সেতু ব্যবহারের জন্য এরই মধ্যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ১৭ মে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সেতু বিভাগ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু পার হতে একটি মোটরসাইকেল ১০০ টাকা, প্রাইভেট কার ও জীপ ৭৫০ টাকা, পিকআপ ১২০০, মাইক্রোবাস ১৩০০, ছোট বাসের জন্য (৩১ সিট) ১৪০০, মাঝারি আকারের বাস (৩২ আসনের বেশি) ২০০০ এবং বড় বাস (তিন অ্যাক্সেল) ২৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ছোট ট্রাকের (৫ টন পর্যন্ত) জন্য ১৬০০, মাঝারি ট্রাক (৫ থেকে ৮ টন) ২১০০ এবং ৮ থেকে ১১ টন ওজনের ট্রাক ২৮০০, ট্রাকের (থ্রি-অ্যাক্সেল) ৫৫০০ টাকা, ট্রেলার (চার অ্যাক্সেল) ৬ হাজার টাকা পারাপারের টোল নির্ধারণ করা হয়। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, চার অ্যাক্সেল ট্রেলারের ওপরে প্রতিটি এক্সেলের জন্য ৬ হাজার টাকার সঙ্গে অতিরিক্ত ১০০০ টাকা যোগ করা হবে।
সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম পদ্মা সেতুর নির্মাণবিষয়ক সূচনা বক্তৃতা দেন। তিনি প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম, উপ-পরিচালক কামরুজ্জামান, প্রজেক্ট ম্যানেজার এন্ড সুপারভিশন কনসালটেন্ট ররার্ট জন এভিসসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনের সঙ্গে অনুষ্ঠানে পরিচয় করিয়ে দেন। মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর একপাশে ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, অন্যপাশে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আর তার পাশে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম। এ ছাড়াও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রিসভার সদস্য, বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন, ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে শিল্পকলা একাডেমি নির্মিত দেশের শিল্পীদের অংশগ্রহণে থিম সঙ্গ পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতুর ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।