বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
উন্নয়ন ও অগ্রগতির চাকাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলনে ২০৪১ সালে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চায় তার একটি নীতি-নির্ধারণী কর্মসূচি জাতির সামনে তুলে ধরা হয়েছে। সরকারের নানা প্রচেষ্টা, উদ্যোগ, পরিকল্পনা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা থাকছে না।
কিন্তু দুর্নীতি, অনিয়ম, অদক্ষতা, নৈতিক মূল্যবোধের চরম অভাবে সরকারের সকল অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ দিতে হয় এত সমস্যা, অনিয়ম, দুর্নীতি থাকার ফলেও তাদের কর্মতৎপরতা আমাদের সকলকে মুগ্ধ করেছে। তাই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি সঠিক কাজটি করার জন্য বাস্তবায়ন, পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগকে সাধুবাদ দিতে হয়। দায়িত্ব পালনে কোন রকম অবহেলা, অলসতা, অসততা না দেখিয়ে জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ৩৯টি প্রকল্পে অনিয়ম ধরা পড়েছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তদন্তে। আইএমইডি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে এসব প্রকল্পের ক্রটি ও অনিয়ম সম্পর্কে সুপারিশ করেছে এবং এ বিষয়ে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের জানাতে বলেছে। কিন্তু ১৪টি প্রকল্প সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আইএমইডিকে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। এমনকি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল নিজে চিঠি দিয়েও মন্ত্রণালয়গুলোর কাছ থেকে কোনো জবাব পাননি। মন্ত্রণালয়গুলো আইএমইডির চিঠির পাওয়ার পর কোনো সাড়া না দেওয়ায় কমিটির বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। কমিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পর্কিত জবাবদিহি আদায়ের ক্ষমতা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
সংসদীয় কমিটির সদস্যরা বলছেন, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প পাস হলেও তাদের কাছে জবাবদিহি আদায়ের ক্ষমতা না থাকায় কাজ ভালো হচ্ছে না। আইএমইডি কর্মকর্তারা বলছেন, আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় মন্ত্রণালয়গুলো তাদের সুপারিশ আমলে নেয় না। এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিকবার আলোচনা করেও কোনো ফল হয়নি।
বৈঠকে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, প্রকল্প বাতিলের ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর। বর্তমানে ৪০-৪২টি প্রকল্প বাতিলের তালিকায় আছে। এগুলো প্রধানমন্ত্রীর গোচরে আনা হয়েছে। তিনি প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারের কোন প্রকল্পের কাজ কত ভাগ শেষ হয়েছে, কতটি প্রকল্পের সময় বাড়ানো হয়েছে এবং কতটি মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে, সে সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের কাছে হালনাগাদ তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। এছাড়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা, তা জানতে একটি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে।
বৈঠকে আইএমইডি থেকে বলা হয়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারের ৫৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মোট ৭০৫টি চলমান প্রকল্প পরিদর্শন করা হয়েছে। ৫৩টি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের মধ্যে ৩৯টি প্রকল্পের অনিয়ম ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে আইএমইডিকে অবহিত করার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ১৪টি প্রকল্প সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোনো জবাব দেয়নি। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় এক বছর আগে বিদ্যুৎ বিভাগের রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পকে পরিবেশবান্ধব করতে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের সুপারিশ করে মোট আট দফা সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি আইএমইডিকে কিছুই জানায়নি। বিদ্যুৎ বিভাগের আরেক প্রকল্প ভেড়ামারা কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টের বিষয়ে সাত দফা সুপারিশ করে কোনো জবাব পায়নি আইএমইডি।
রেল বিভাগের ১৭০ কোটি টাকা ব্যয়ের লাকসাম-চাঁদপুর সেকশনের প্রকল্পে নিম্নমানের ব্যালাস্ট (ছোট পাথর) বাতিল ও নিম্নমানের ইট পরিবর্তনসহ করা সাত দফা সুপারিশ করেছিল আইএমইডি। কিন্তু মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। সেখানে যে ধরনের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা আছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগের ৫৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্রামীণ সড়ক ও হাটবাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন, ৩৬ কোটি টাকার জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়নকেন্দ্র স্থাপন এবং ১৯০ কোটি টাকার ঢাকা আরবান অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প সম্পর্কে আইএমইডি সুপারিশ করে কোনো জবাব পায়নি। এসব প্রকল্পে নিম্নমানের ইট, পাথর, বালি ও বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে রিকাবীবাজার-রামপাল-দিঘীরপাড়-বাংলাবাজার-মুন্সিগঞ্জ সদর-নয়াগাঁও-মুক্তারপুর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, ২২৪ কোটি টাকার গাজীপুর-আজমতপুর-ইটখোলা সড়ক নির্মাণ, ২০ কোটি টাকার টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট অনিয়মের অভিযোগ করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও মন্ত্রণালয় থেকে এর কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
এখন আমাদের করণীয় : ১) দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সরকারগুলো যুদ্ধ করে এসেছেন। কিন্তু দুর্নীতি, অনিয়ম যেন আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে পড়েছে। সমাজের সকল স্তরে কিছু অন্যায়, অনিয়ম ও আত্মকেন্দ্রিকতা আমরা সব সময় দেখতে পাচ্ছি। জাতির এই সকল অভিশাপ থেকে বাঁচার জন্য আমাদের সকলকে সংকল্প গ্রহণ করতে হবে। শুধু সরকার চেষ্টা করে অনিয়ম, দুর্নীতি দূর করতে পারবে না। নাগরিক হিসেবে আমাদের সকলকে দায়িত্বশীল হতে হবে। আমাদের সকলকে ন্যায়-নিষ্ঠাবান নাগরিক হতে হবে। সকলের ঐক্যবদ্ধ চেষ্টার মাধ্যমে আমরা সকল নিয়ম ও নীতিহীনতা থেকে বের হয়ে আসতে পারবো।
(২) প্রত্যেক মন্ত্রণালয়কে নিজ দায়িত্বের কথা স্মরণ করতে হবে। শুধু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বাস্তবায়ন ও নিরীক্ষণ শাখা অনিয়ম, দুর্বলতা, কাজের ক্ষতি অবহেলা দূর করতে পারবে না। তদন্ত কমিটি দুর্বলতাগুলো বের করে দিয়েছেন। সংশোধন করতে হবে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়কে। প্রত্যেক মন্ত্রীকে তার নিজের মন্ত্রণালয়ের দায়-দায়িত্ব একান্তভাবে নিজ কর্ম বলে গ্রহণ করতে হবে।
৩) আইএমইডি তদন্ত প্রতিবেদনে যে সকল সুপারিশ করা হয়েছে তার বাস্তবায়ন জরুরি। তদন্ত প্রতিবেদনটি অত্যন্ত নির্ভুল ও যুক্তিসঙ্গত। তাই পরামর্শগুলো বাস্তবায়নে দেশের উন্নয়নের স্বার্থ সুবিবেচনায় নিতে হবে।
৪) না হলে প্রকল্পগুলো দুর্বল ও অপূর্ণাঙ্গ থেকে যাবে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা কখনও সম্ভব হবে না। তাই এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি দেয়াটা একান্তই কাম্য।
৫) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের যে কোনো প্রকল্প পরিদর্শক ও পরামর্শ দেয়ার বিধান থাকা দরকার। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটিকে আইনগতভাবে পরামর্শ গ্রহণের বাধ্যবাধকতার বিধান করার প্রয়োজন। আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকলে এই সকল তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা সময় ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছু নয়। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে বিষয়টি সরকার সুবিবেচনা নেবেন বলে আমরা সকলে আশা করি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ জোগান দেন। কিন্তু অনিয়ম, দুর্নীতি হলে বিচারের দায়িত্ব কার হবে? এই বিষয়টি নিয়ে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক তদন্ত প্রতিবেদনে যে সকল সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে তার একটি সুবিচার হওয়া প্রয়োজন। এই জন্য আইনগত সুবিধা প্রদান করা প্রয়োজন। নতুবা এই ৩৯ প্রকল্পের ভাগ্যে যা ঘটবে আগামীতে যে কোনো প্রকল্পকেও অনুরূপ ভাগ্যবরণ করতে হতে পারে।
৬) সকল অনিয়ম, দুর্নীতির বিচার দেশে প্রচলিত আইনে রয়েছে। সরকার নানাভাবে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করার চেষ্টা করছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন দুর্নীতিকে ‘না’ বলার জন্য। দুর্নীতি দমন কমিশন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করছে। নিয়মিত মামলা করছে। অপরাধীকে গ্রেফতার করছে। সমাজের কিছু অংশ দুর্র্নীতি দমন কমিশনের এই কার্যক্রমে বেশ সচেতনতা রয়েছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিলে ধীরে ধীরে সমাজ থেকে দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
জনগণ, সুশীল সমাজ তথা আমরা সকলে সচেতন হলে সমাজে অনিয়ম, দুর্নীতি অনেক কমে আসবে। এখন প্রয়োজন সকলের মধ্যে দেশের প্রতি মায়া সৃষ্টি হওয়া। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি যত দয়া-মায়া সৃষ্টি হবে, ততোই দেশ থেকে দ্রুত অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য হ্রাস পাবে।
লেখক : সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।