পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
এসে গেছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৭ কোটি মানুষের স্বপ্ন আর আকাক্সক্ষার ফসল। বিশ্বদরবারে দেশের আত্মমর্যাদা ও সক্ষমতার প্রতীক পদ্মা সেতুর দুয়ার খুলছে আজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই সেতুর উদ্বোধন করবেন। সেতুর উদ্বোধন ঘিরে সারা দেশে সাজসাজ রব। কোটি কোটি মানুষের মধ্যে বইছে আনন্দের বন্যা। ইতিহাসে নাম লেখানোর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যেন কেউ ভূলুণ্ঠিত করতে না পারে, সেজন্য নেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। গড়ে তোলা হয়েছে ত্রিমাত্রিক নিরাপত্তা বলয়। সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে মহাসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবী ছাড়াও ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়ায় বহুল প্রত্যামিথ এ পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিস্তারিত সমীক্ষা, নকশা প্রণয়নসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসে বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঋণ চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। কাজ শুরুর আগেই দুর্নীতির চেষ্টার কল্পিত অভিযোগ তুলে দাতা সংস্থাগুলো ঋণচুক্তি বাতিল করলে ২০১২ সালের ৯ জুলাই এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সংসদেও একই ঘোষণা দেন।
এরপর থেকেই পদ্মা সেতুর বিভিন্ন কম্পোনেন্টের ঠিকাদার নিয়োগ শুরু হয়। ২০১৪ সালের ১৮ জুন মূল সেতু নির্মাণে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। আর নদীশাসনের জন্য চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। চীনের কোম্পানি ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর মূল সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর এই সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টম্বর সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর প্রথম স্প্যান বসানো হয়। এরপর ২০১৮ সালে ৪টি, ২০১৯ সালে ১৪টি, ২০২০ সালে ২২টি স্প্যান বসানো হয়। এরপর বাকি কাজ শেষ করা হয়। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর গাড়ি চলাচলের জন্য খুলে দিতে নিজ হাতের তৈরি এই সেতুর উদ্বোধনও করবেন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এদিন মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশের পর সেতু উদ্বোধন উপলক্ষ্যে স্মারক ডাকটিকিট ও স্যুভেনির শিটের উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকার প্রকল্পের আওতায় নির্মিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পরের দিন ২৬ জুন থেকে ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুতে সাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের স্বপ্নের দ্বার খুলছে। এ সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন হতে যাচ্ছে। যাতায়াত ব্যবস্থায় নতুন মাইলফলকে বাংলাদেশ। এই সেতুর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। এর সরাসরি সুফল পাবেন ৩ কোটির বেশি মানুষ। পরোক্ষ সুফল পাবে পুরো বাংলাদেশ। এ সেতুর সুবিধা নিয়ে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং ভোমরা স্থলবন্দরের ব্যবহার বেড়ে যাবে। কমবে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের ওপর আমদানি-রফতানি চাপ। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যাতায়াতের সময় অন্তত দুই থেকে চার ঘণ্টা কমে যাবে। ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এক ঘণ্টায় যাতায়াত করা যাবে। এ সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে। উন্মুক্ত হচ্ছে পর্যটনের নতুন দুয়ার। অর্থনীতিবিদদের মতে এ সেতু চালু হলে বছরে দশমিক ৮৪ শতাংশ দরিদ্রতা হ্রাস পাবে এবং জিডিপিতে এক দশমিক ২৩ শতাংশ অবদান রাখবে। আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় এটি বড় ভূমিকা রাখবে। এশিয়ান হাইওয়েতে-১ (তামাবিল-সিলেট-ঢাকা-পদ্মা সেতু-যশোর-বেনাপোল) সরাসরি যুক্ত করবে এ সেতুটি।
দেশি-বিদেশি নানা প্রতিকূলতা এবং প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা অর্জন হচ্ছে। সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে সারা দেশে সাজসাজ রব উঠেছে। মাওয়া ও জাজিরা, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আলোকসজ্জা করা হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, সেতু নির্মাণকাজের ধাপে ধাপে নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নির্মাণ করা হয় এ সেতু। সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, তৎকালীন সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এবং সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তাদের গ্রেফতারের দাবি জানায়।
অভিযোগ তোলা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে। এক পর্যায়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবুও দাতা সংস্থাগুলো এ সেতুর অর্থায়নে ফিরে আসেনি। অবশ্য কানাডার আদালতে দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা মামলাও প্রমাণিত হয়নি। এ অবস্থায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে নিজ অর্থায়নে এ সেতুর বাস্তবায়ন করা হয়।
পরিবহণ সংশ্লিষ্ট ও যাত্রীরা জানান, এ সেতুর চালুর ফলে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ঘাটে ফেরির জন্য দীর্ঘলাইন ও অপেক্ষা করতে হবে না। ঈদ-পার্বণ ও বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে জীবন বাজি রেখে যাত্রীদের আর বিশাল ও উত্তাল পদ্মা নদী পাড়ি দিতে হবে না।
জানা গেছে, গাড়ি চলাচলের জন্য প্রস্তুত পদ্মা সেতু। বুধবার পদ্মা সেতু হস্তান্তর করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ। এ সেতু নির্মাণে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকার। গত ২১ জুন পর্যন্ত এ সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১১ হাজার ৯৩৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। যদিও নদীশাসন, পুনর্বাসন, সংযোগ সড়কসহ পদ্মা সেতু বহুমুখী প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ২১ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। প্রকল্পের সার্বিক আর্থিক অগ্রগতি ৯১ দশমিক ৮৫ শতাংশ আর বাস্তব ভৌত অগ্রগতি ৯৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। এর মধ্যে নদীশাসন কাজে ৯৪০০ কোটি টাকার মধ্যে ৮৭০৬ কোটি টাকা, পুনর্বাসন কাজে ১৫১৫ কোটি টাকার মধ্যে ১১১৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বাকি টাকা অন্যান্য কাজে খরচ হয়েছে।
প্রতিবন্ধকতা ও রেকর্ড : রাজনৈতিক, অর্থনীতিবিদসহ বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে নির্মাণ করা হয়েছে এ সেতু। সেতুর কাজের মান নিয়েও বারবার প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক বৈরী পরিবেশও বারবার বাধা তৈরি করেছে। আনপ্রেডিক্টেবল পদ্মা নদীতে এ সেতু নির্মাণই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। আমাজনের পরই খরস্রোতা নদী হিসাবে বিবেচিত হয় পদ্মা নদী। এ নদীতে সেতু নির্মাণ সফলভাবে শেষ করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। সেতু বিভাগ এ সেতুকে বিশ্বের ‘মোস্ট কমপ্লেক্স সেতু প্রকল্প’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। এ সেতুর স্থায়িত্বকাল ধরা হয়েছে ১০০ বছর। সংশ্লিষ্টরা জানান, পদ্মা নদী ভাঙনপ্রবণ ও খরস্রোতা হওয়ার কারণে এ সেতুর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে পিলার ও পাইল বসানোর ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে; তা বিশ্বে প্রথম। এ সেতুতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১২২ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত পাইল বসানো হয়েছে; যা ৪০তলা বিশিষ্ট ভবনের সমান। অর্থাৎ এসব পাইল নদীর পানি ভেদ করে ১২২ মিটার পর্যন্ত গভীরতা পর্যন্ত ঠেকেছে। তবে কিছু পাইলের গভীরতা ৯৮ মিটার থেকে বিভিন্ন আকারের রয়েছে। প্রতিটি পিলারের ডায়ামিটার তিন মিটার। নদীর গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় সেতুর পাইল নির্মাণে কয়েকবার ডিজাইন পরিবর্তন করতে হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, পদ্মা নদীর স্রোতের তীব্রতা প্রতি সেকেন্ডে ৩ থেকে সাড়ে ৪ মিটার। নদীর প্রবাহমাত্রা প্রতি সেকেন্ডে দেড় লাখ ঘনমিটার। নদীর তলদেশে স্রোতে ৬২ মিটার পর্যন্ত মাটি সরে যায়। নদীর এমন আচরণ সহনীয় ফাউন্ডেশনের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে পদ্মা সেতু। নদীর তলদেশের মাটি নরম হওয়ায় ওইসব স্থানের ১১টি পিলারের নিচে স্কিন গ্রাউন্টিং পদ্ধতিতে ৭টি করে পাইল রয়েছে। পদ্মা সেতুতে ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। এর ক্যাপাসিটি ৯৮ হাজার কিলোনিউটন। রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে এ সেতুর। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্যামার ব্যবহার করা হয়েছে; যার সক্ষমতা ৩ হাজার ৫০০ কিলোজুল। ৪ হাজার টন সক্ষমতার জাহাজ আঘাত দিলেও সেতুর ক্ষতি হবে না।
১৪ হাজার শ্রমিক-প্রকৌশলী সাড়ে ৭ বছর : পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর। আর সেই কাজসম্পন্ন হয় চলতি বছরের ২২ জুন। সেতুটির নির্মাণ শেষ হতে সময় লেগেছে ২ হাজার ৭৬৫ দিন (৭ বছর ৬ মাস ২৭ দিন)। দিনরাত কাজ করেছেন প্রায় ১৪ হাজার দেশি-বিদেশি শ্রমিক, প্রকৌশলী ও পরামর্শক। এরমধ্যে প্রায় ১ হাজার ২০০ দেশি প্রকৌশলী, ২ হাজার ৫০০ বিদেশি প্রকৌশলী, প্রায় ৭ হাজার ৫০০ দেশি শ্রমিক, আড়াই হাজার বিদেশি শ্রমিক এবং প্রায় ৩০০ দেশি-বিদেশি পরামর্শক কাজ করেছেন।
প্রকৌশলীরা জানান, মূল কাজ চীনারা করলেও কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ইংল্যান্ড, কোরিয়া, নেদারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডসহ ২০টি দেশের প্রকৌশলীরা কাজ করেছেন। এ ছাড়া, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, গাইবান্ধা, যশোর, নোয়াখালী, বরিশাল, বগুড়া, টাঙ্গাইল, রংপুরসহ ১৫ থেকে ২০টি জেলার মানুষ পদ্মা সেতুতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। কয়েকটি শিফটে একেকজন শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করে। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও অনেকে কাজ করেছে।
একজন প্রকৌশলী জানান, মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে চীনের থেকে স্টিলের টুকরো দেশে আসে, এরপর এসব জোড়া লাগিয়ে স্প্যানের আকার তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া তৈরি হয়েছে সø্যাব। পিলার নির্মাণের পর স্প্যান বসানোর মতো কঠিন কাজটি সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। প্রথম স্প্যান থেকে ধারাবাহিকভাবে বসিয়ে শেষ পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে ৩৮ মাস ১০ দিন। ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে সø্যাব ও ২ হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে সø্যাব বসানো হয়েছে সফলভাবে। প্রকৌশলীরা বলছেন, যারা এখানে কাজ করেছেন, তারা দেশের অন্যান্য বড় স্থাপনা নির্মাণে যেকোনো বাধা সহজেই অতিক্রম করতে পারবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রকৌশলীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করার সুযোগ হয়েছে। এমন অনেক প্রযুক্তি এখানে ব্যবহার হয়েছে, যা পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটি সেতুতে ব্যবহার হয়েছে।
সেতুতে কর্মরত সেফটি ইনচার্জ আলমগীর হোসেন জানান, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু করেছিলাম সেতুতে। শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখাশোনা করা ছিল আমার দায়িত্ব। করোনার মধ্যে লকডাউনে পুরো দেশ অচল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পদ্মা সেতুর কাজ থেমে থাকেনি। গতি কম হলেও কাজ এগিয়ে গিয়েছে। প্রমত্তা পদ্মায় ঝড়-বৃষ্টি, তীব্র রোদ উপেক্ষা করেই কাজ করে গেছে শ্রমিক-প্রকৌশলীরা। ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলেছে। প্রায় ৪ বছর সেতুতে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করা রাহাত হোসেন বলেন, ঈদের মধ্যে সবাই যখন পরিবার নিয়ে ঈদ আনন্দ উদযাপন করেছিল, তখন আমরা সেতুতে কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কাজের গতি স্বাভাবিক রাখতে অনেক শ্রমিক-প্রকৌশলী ছুটি নেননি। বিভিন্ন উৎসবগুলোতেও আমরা সেতু এলাকাতেই অবস্থান করেছি। প্রিয়জনদের মুখও বহুদিন আমরা দেখিনি। এসব ত্যাগ সফল হয়েছে।
সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বলয় : বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোস্ট অথোরিটি (বিআরটিএ) জানিয়েছে, পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠান নির্বিঘ্ন করতে ২৪ জুন সকাল ৬টা থেকে ২৬ জুন সকাল পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া এবং মুন্সীগঞ্জ থেকে মাওয়া পর্যন্ত কোনো প্রকার বাস, ট্রাক, লরি ও কাভার্ডভ্যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ সময় তাদের চাঁদপুর-শরীয়তপুর রুট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে চলাচল করতে বলা হয়েছে। উদ্বোধন ঘিরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বলয় তৈরিতে দুই প্রান্তে পদ্মা সেতুর প্রবেশ স্থান ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো র্যাবের চেকপোস্ট স্থাপনের মাধ্যমে আগত যানবাহন ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তল্লাশি করা হচ্ছে। ভার্চুয়াল জগতে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের গুজব, উসকানিমূলক তথ্য, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো প্রতিরোধেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে র্যাব সাইবার মনিটরিং টিম অনলাইনে সার্বক্ষণিক নজরদারি অব্যাহত রাখছে। র্যাব সদর দফতর সার্বিক কার্যক্রম সার্বক্ষণিকভাবে মনিটর করা হচ্ছে।
নিরাপত্তা জোরদার : আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর থেকে প্রতিটি থানায় বিশেষ নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অপপ্রচার রোধে সর্বোচ্চ নজরদারি করা হচ্ছে। র্যাব-পুলিশ মিলে সাড়ে ৫ হাজার সদস্য মাঠে মোতায়েন করা হয়েছে। এর বাইরে আকাশপথে টহল দেবে র্যাবের এয়ার উইং। থাকবে র্যাবের কমান্ডো ইউনিটও।
পুলিশ সদর জানিয়েছে, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরে দেশে একটি মহল নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কিছু ঘটানোর চেষ্টা করছে। যাতে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানো যায়। সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় শুধু পদ্মা সেতু নয়, বরং সারা দেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বলয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ যাতে গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে না পারে, সেজন্য সার্বক্ষণিক সাইবার মনিটরিং করা হচ্ছে। উদ্বোধনের দিন পদ্মার দুইপাড়ে র্যাবসহ পুলিশের সাড়ে ৫ হাজারের বেশি সদস্য ইউনিফর্মে মোতায়েন থাকবে। এর বাইরে বিভিন্ন বাহিনীর গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা সাদা পোশাকে তৎপর থাকবে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু ও আশপাশের মানুষসহ সার্বিক নিরাপত্তায় দুটি থানার উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। থানা দুটি এর মধ্যেই কার্যক্রম শুরু করেছে। নৌপথে শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকবে নৌপুলিশ। মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ জেলা পুলিশের চাহিদা মোতাবেক আরও যদি ফোর্স লাগে, তা দেওয়া হবে। একইসঙ্গে কাজ করছে হাইওয়ে পুলিশ। আমাদের র্যাবের সদস্যরাও নিয়োজিত থাকবেন। আকাশপথে টহল দেবে র্যাবের এয়ার উইং। অর্থাৎ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রিমাত্রিক বলয় সাজানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন, যেকোনো ধরনের নাশকতা, গুজব অপপ্রচারের চেষ্টা ঠেকাতে সাইবার পুলিশ, সিটিটিসি, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের সদস্যরা সক্রিয় মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, পানিপ্রবাহের বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদীশীর্ষে। দ্বিতীয় অবস্থানেই পদ্মা নদী। এই নদীতে সেতু করতে গিয়ে মাটির ১২০ থেকে ১২৭ মিটার গভীরে পাইল বসানো হয়েছে। এত গভীরে পৃথিবীর আর কোনো সেতুর পাইল বসাতে হয়নি; যা বিশ্বে রেকর্ড। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহায়ক করে নির্মিত হয়েছে পদ্মা সেতু। তাই ভূমিকম্পের বিয়ারিং প্রযুক্ত হচ্ছে এই সেতুর দ্বিতীয় রেকর্ড। পদ্মা সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’-এর সক্ষমতা ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর অন্য কোনও সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। সেতুর তৃতীয় বিশ্বরেকর্ড হলো, পদ্মা সেতুর পিলার এবং স্প্যানের মধ্যে যে বিয়ারিং থাকে সেটি। এখানে ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ওজনের একেকটি বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। এই সেতুর চতুর্থ রেকর্ড হলো নদীশাসন সংক্রান্ত। ১৪ কিলোমিটার (১ দশমিক ৬ কিলোমিটার মাওয়া প্রান্তে ও ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার জাজিরা প্রান্তে) এলাকা নদী শাসনের আওতায় আনা হয়েছে। তিনি জানান, পদ্মা সেতুতে দেশি কোম্পানিও কাজ করেছে। পদ্মা সেতুতে আমাদের তিনটি বড় কন্ট্রাক্ট ছিল। একটা হচ্ছে মূল সেতু, একটা নদী শাসন ও অ্যাপ্রোচ সড়ক। মূল সেতুর কাজ করেছে চাইনিজ ঠিকাদার, নদীতে ড্রেজিংয়েও চাইনিজ ঠিকাদার সিনোহাইড্রো। অ্যাপ্রোচ সড়ক করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড (এএমএল)। ওরা মালয়েশিয়ার একটা কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছে। সক্ষমতার অভাবের কারণেই কিন্তু বিদেশি ঠিকাদার আনতে হয়েছে। সেতু প্রকল্পে সিমেন্ট, বালি বাংলাদেশের। তবে দুবাই ও ভারত থেকে বেশি পাথর আনা হয়েছে। রেলের কিছু প্লেট চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে। আর রেলওয়ের জন্য স্ট্রেনঞ্জার লুক্সেমবার্গ থেকে এসেছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।