Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষার প্রেক্ষাপট ও যুগ চাহিদায় করণীয়

প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মিযানুর রহমান জামীল

॥ এক ॥
সময়ের স্রোত অনেক দূর এগিয়ে যায়। কালের আয়নায় লেগে যায় কতো যুদ্ধ বিগ্রহের দাগ। সূর্যের উদয় অস্তের মধ্যে উল্টে যেতে থাকে কালের পৃষ্ঠা। ১৭৫৬ সাল। ভারত উপমহাদেশে মুসলমানরাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। দীর্ঘ আট শত বছর মুসলিম শাসনের ফলে ভারত উপমহাদেশ ব্যবসা বাণিজ্যসহ বিভিন্ন উন্নতি ও সমৃদ্ধির একটি ঈর্ষণীয় অবস্থানে পৌঁছে যায়। সংখ্যালঘু মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের নীতি নৈতিকতা ও উন্নত আদর্শের মাধ্যমে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে ছিল মাথার তাজ। তাই মুসলমানদের শাসক হিসেবে গ্রহণ করতে তাদের কোনো আপত্তি ছিল না। এরই মধ্যে অনেক পানি গড়িয়ে যায়।
১৭৫৭ সাল। শুরু হলো বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। আর তখনই শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহদ্দিসে দেহলভীর শিষ্য ও সন্তান শাহ আব্দুল আজীজ দেহলভী রহ. ভারত বর্ষকে ‘দারুল হরব’ ঘোষণা করেন। ১৮৩১ সালে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে সংগ্রামের সূচনা করেন ইসলামী খেলাফত প্রত্যাশী অবিসংবাদিত প্রাণ পুরুষ শাহ সৈয়দ আহমদ বেরলভী রহ.। আর এই ১৮৩১ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রেরণা (বালাকোট যুদ্ধ)
ইংরেজদের রোষানলে পড়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলেন। কেউ মাল্টা বা আন্দামান দীপে নির্বাসিত হন। কেউ কারাগারে তিলে তিলে ক্ষয় হন। শেষ পর্যন্ত আলেমদের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের (বালাকোট ফেরত) অন্যতম মুজাহিদ নেতা মাওলানা ইয়াহইয়া আলীর পরোক্ষ নেতৃত্বে ১৮৫৭ সালে গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. তার সহকর্মীদের মধ্যে আন্দোলনের কাজ বণ্টন করে দেন। নিজেও সশরীরে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ১৮৫৭ সালের আযাদী বিপ্লবের সময় থানাভবন ফ্রন্টে তার সঙ্গে যে সব মর্দে মুসলমান ও সংগ্রামী আলেম জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাদের সংখ্যা ছিল হাজর হাজার। তন্মধ্যে হাজ এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর সহকর্মী শিষ্য হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ., হযরত মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ. এর মতো যুগশ্রেষ্ঠ আল্লাহর ওলীরা থানা ভবনে এসে সমবেত হন। তারা সেখানে ইংরেজদের হটিয়ে অনেক এলাকা জয় করেন। এমনকি ইংরেজদের প্রধান ঘাঁটিও দখল করতে সক্ষম হন। কিন্তু বালাকোটের ন্যায় এবারও বিশ্বাসঘাতকদের ঘড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়। ফাঁসির কাষ্ঠে ২৮ হাজার মুসলমান ও সাত শত আলেম শাহাদাত বরণ করেন।
মোটকথা ঊনবিংশ শতাব্দীটা ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য ছিল অত্যন্ত ক্রান্তিকাল। নানামুখী আগ্রাসনে তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ইসলামী শৌর্য-বীর্যের প্রদীপ নিভে যাওয়ার ঘোষণা করছিল। দিল্লির রাজ সিংহাসন থেকে মোগল শাসন বিদায় নিয়েছিল। সেখানে ব্রিটিশ শাসন জেঁকে বসেছিল। ইংরেজ শাসন গোটা ভারতবর্ষকে গ্রাস করে ফেলেছিল। ইসলামী সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনৈসলামী কৃষ্টি-কালচার, ধ্যান-ধারণা ও শেরেকী আকীদা-বিশ্বাস এমনভাবে শেকড় গেড়ে চলেছিল যে, ইসলামের আসল পরিচয়ই হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়ে পড়েছিল। ইসলামী সমাজ বিভিন্ন সভ্যতা ও ধর্মের আগ্রাসনে বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। তার আসল রূপই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
ইসলামী সমাজের ওপর একই সাথে দ্বিমুখী হামলা চলছিল। একদিকে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভারতবর্ষের মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে নির্মূল করার জন্য দলে দলে খ্রিস্টান পাদ্রিদের প্রেরণ করতে লাগল। এসব পাদ্রি নানারূপ চক্রান্ত করে ভারতের মানুষকে খ্রিস্টান বানাবার চেষ্টা করতে লাগল এবং মুসলমানদের মসজিদকে গীর্জায় রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। দিল্লির জামে মসজিদকে গীর্জায় রূপান্তরিত করার জন্য তারা চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। পাদ্রিদের দুঃসাহস এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, তারা মুসলমানদের সাথে শুধু বিতর্কই নয়, সংঘর্ষেও লিপ্ত হতো। বিভিন্ন বাজারে গলিতে গলিতে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাদ্রিরা দলে দলে ঘুরে বেড়াত এবং মুসলমানদের ঈমান আকিদা-নষ্ট করার চেষ্টা করত। সারা ভারতবর্ষে খুব কমই শহর ও জনবসতি ছিল যেখানে পাদ্রিরা তাদের অপচেষ্টা চালায়নি। এমন স্থান খুব কমই ছিল, যেখানে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে বিষ ছড়িয়ে মুসলমানদের অন্তর ক্ষত বিক্ষত করেনি। তারা জোরপূর্বক সর্বত্র নিজেদের প্রচার কার্য চালাত এবং মুসলমানদের মোকাবিলা করার জন্য চ্যালেঞ্জ দিত। ঝঞ্ঝা বায়ুর ন্যায় তাদের প্রচার তৎপরতা সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইংরেজদের এই ষড়যন্ত্রের সাথে অপরদিকে তারা অভ্যন্তরীণভাবে ইসলামের নামে এমন একটি আন্দোলনের জন্ম দিয়ে মুসলমানদের শেকড় কর্তনের এমনি এক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করল যে, খ্রিস্টান মিশনারীরা সারা জীবন চেষ্টা করেও তা করতে সক্ষম হতো না। আর সে আন্দোলনটি ছিল কাদিয়ানী আন্দোলন। এ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট হলো, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি ইংরেজদের সর্বাপেক্ষা অস্থির করে তুলেছিল তা হলো, ‘ইসলামের জিহাদ নীতি’।
ইসলামের যে জিহাদী তরবারী ইংরেজদের মাথার ওপর সদা ঝুলছিল, তা চিরকালের জন্য চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে ইংরেজরা ছিল বদ্ধপরিকর। যদিও প্রাচ্যবিদদের একটি দল জিহাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল, তবুও এ বিষয়ে সফলকাম হওয়ার জন্য তাদের নিকট মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী অপেক্ষা আর কেউ উপযুক্ত ছিল না। তাই তারা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ইসলামের জিহাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিল। যাতে মুসলমানদের ভেতর থেকে সেই জিহাদের আগুন জ্বলে না উঠতে পারে, যার ভয়ে তারা সব সময় তটস্ত থাকত। এই অভিশপ্ত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ইংরেজ সরকারের সহযোগিতায় ইসলামের ‘জিহাদ নীতি’র বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। পরবর্তীতে সে ইংরেজদের ছত্রছায়ায় প্রথমে ‘ঈসা মাসীহ’ তারপর ‘শেষ নবী’ পর্যন্ত দাবি করেছিল। এর মাধ্যমে সে লাখ লাখ মুসলমানের ঈমানী দুর্গে দিন-দুপুরে হামলা চালিয়েছিল।
কাদিয়ানী ফিতনার পাশাপাশি বাদশাহ জাহাঙ্গীরের শাসনামলে শেকড় গেড়ে বসা শিয়া সম্পদ্রায়ও তাদের অসংখ্য শেরেকী আকীদা-বিশ্বাস ও প্রথা-প্রচলন মুসলিম সমাজে প্রসার ঘটিয়েছিল, যা ধীরে ধীরে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের স্বীকৃত আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যে শামিল হয়ে যাচ্ছিল। শিয়া ফিতনা ছাড়াও কিছু দুনিয়াদার, স্বার্থপর পীর ও ওলামায়ে ছূ’র প্রচেষ্টায় নির্ভেজাল তাওহীদ ও সুন্নাতের পরিবর্তে আশ্চর্য ধরনের বিদআত, রসম-রেওয়াজ ও প্রথা-প্রচলন এবং শেরেকী কর্মকা- সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল। এসব ওলামায়ে ছূ হুব্বে রাসূল-এর আড়ালে রাসূল ও পীর-আওলিয়াদেরকে ‘প্রভুত্বের’ মর্যাদায় আসীন করেছিল।
ভারতবর্ষে হাজার হাজার কবরকে তারা ‘কাবা শরীফের’ মর্যাদা দিয়েছিল। কবরের সামনে তারা আনুগত্যের মাথা অবনত করত। এসব কবরীদের মধ্যে বিশেষভাবে ব্রেরেলীর রেজভী সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য। মোটকথা, ভারতবর্ষে ইসলামের চেরাগ নিভে যাওয়ার উপক্রম করছিল। পরিস্থিতির যাঁতাকলে মুসলমানরা নিষ্পেষিত হচ্ছিল। কিন্তু কখনো এই ভূখ-কে ‘তাওহীদ ও সুন্নাত’-এর ঝরণাধারা থেকে বঞ্চিত করার ইচ্ছা আল্লাহ পাকের ছিল না। তাই এই কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে ব্যর্থবিদ্রোহের পর উপমহাদেশের ওলামায়ে কেরাম সুদূর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খালেস ইলমে দীন শিক্ষা, দাওয়াতী মিশন পরিচালনার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলার ইলহামী নির্দেশে ‘একটি ইসলামী ছাউনী’ প্রতিষ্ঠা করার সংকল্প করলেন। সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে আপাতত ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে এ কাজটি হাতে নেন। ফলে শুরু হয় একাডেমিক পন্থায় ভারত উপমহাদেশের নতুন জিহাদী কার্যক্রম।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষার প্রেক্ষাপট ও যুগ চাহিদায় করণীয়
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ