Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

বখাটে-সন্ত্রাসীরা কি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকবে?

| প্রকাশের সময় : ২৩ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইভটিজিং ও সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে অনেক ক্যাম্পেইন হয়েছে। অপরাধ আগের চেয়ে কমেছে বলেও কেউ কেউ দাবি করছেন। তবে প্রতিদিনই পত্রিকায় ইভটিজিং, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার কারণে পারিবারিক বিপর্যয় ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। গতকাল একটি দৈনিকে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ থানার নলভাঙ্গা গ্রামের এক হতভাগ্য পিতার করুণ আর্তি প্রকাশিত হয়েছে। সপ্তম শ্রেণীতে পড়–য়া কন্যাকে গ্রামের বখাটেরা স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করত বলে পিতা সমাজে বিচার দিয়েছিলেন। এই ‘অপরাধে’ গত ১৬ অক্টোবর পিতা শাহানুর বিশ্বাসকে হাতুড়ি ও শাবল দিয়ে পিটিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা। আঘাত এতই মারাত্মক ছিল যে, ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও ডাক্তাররা শাহানুরের দুই পা’ই কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। বিনা অপরাধে পঙ্গুত্ব বরণ করা শাহানুর এখন ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের বেডে শুয়ে ভিটে মাটি হারানোর ভয় নিয়ে দিনাতিপাত করছেন বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এমন বর্বরোচিত ঘটনায়ও স্থানীয় থানা প্রথমে মামলা নিতে চায়নি। বহু চেষ্টা-তদ্বিরের পর নলভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা ও কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার এবং স্থানীয় যুবলীগ নেতা কামালকে প্রধান আসামি করে একাধিক মামলা হলেও এখন পুলিশ প্রধান আসামিকে খুঁজে পাচ্ছে না বলে জানিয়েছে।
এটি শুধু একজন শাহানুর বিশ্বাসের বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সারাদেশে এমন অসংখ্য পরিবার দলীয় পরিচয়ধারী ক্যাডার ও বখাটে-সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী তরুণী ও শিশুরা প্রতিনিয়ত এসব বেপরোয়া সন্ত্রাসীর হাতে নিগৃহীত হচ্ছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বাবা, ভাই বা নিকটাত্মীয়দের মার খেয়ে পঙ্গুত্ব বরণ অথবা প্রাণ হারাতে হচ্ছে। রাজধানী শহরে বা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্য সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাগুলো নিয়ে সোস্যাল মিডিয়াসহ গণমাধ্যমে ঝড় উঠেছে, গণদাবির মুখে দলীয় পরিচয়ধারী সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ গ্রেফতারও হয়েছে। তবে একটির রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি চাঞ্চল্যকর নৃশংসতার সাক্ষী হচ্ছে পুরো সমাজ। সিলেটে ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের হাতে খাদিজা আক্তার নির্মম রক্তাক্ত সহিংসতার সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি। সাধারণ মানুষ আশা করে, একেকটি ঘটনার এমন বিচার ও শাস্তি হোক, যেন আর কোনো বখাটে-সন্ত্রাসী আরেকটি অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সাহস না দেখায়। আদতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচারব্যবস্থা সে ধরনের উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে। একশ্রেণীর পুলিশ কর্মকর্তার দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে দুর্বল চার্জশিট ও প্রয়োজনীয় সাক্ষী-সাবুদের অভাব ও আইনগত ফাঁকফোকর গলিয়ে দাগী অপরাধীরা সহজেই জামিন পেয়ে আবারো একই ধরনের অপরাধে লিপ্ত হওয়া অন্য উঠতি সন্ত্রাসীরা উৎসাহিতবোধ করে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বখাটে-সন্ত্রাসীদের হাতে নিগৃহীত ও সন্তান হারানো পিতা-মাতারা বছরের পর বছর আদালতে ঘুরেও হতাশ হয়ে চোখের পানি ফেলছেন, আমাদের সামনে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে।
ষোল বছর আগে ২০০০ সালের পয়লা জুলাই ঢাকার মালিবাগে নিজ বাসায় সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসীদের দ্বারা ধর্ষিত ও খুন হন রুশদানিয়া ইসলাম বুশরা। একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার কন্যার এমন হত্যাকা- চাঞ্চল্যকর হত্যাকা- হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা লাভ করে। হত্যাকা-ের অভিযুক্তদের মধ্যে বুশরার মামা আওয়ামী লীগ নেতা এম এ কাদেরসহ বেশ কয়েকজন নি¤œ আদালতে মৃত্যুদ-সহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজাপ্রাপ্ত হয়। ২০০৩ সালে ঘোষিত আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিলের রায় পেতে ১৬ বছর লেগে যায়। চলতি নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তায় আপিল বিভাগের রায়ে আসামিদের সবাইকেই খালাস দেয়া হয়েছে। আদালতের রায়ের ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার এখতিয়ার না থাকলেও এ কথা নিশ্চিত যে, বুশরার মা তার সন্তান হারানোর সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অভিযুক্ত আসামিরা নির্দোষ হলে বুশরার হত্যাকারী কে তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক রিপোর্ট অনুসারে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে সারাদেশে ২০৮ জন নারী উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে, এদের মধ্যে ৮ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। বখাটে-সন্ত্রাসীদের কারণে বহু মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। বখাটেরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একদিকে রাজনৈতিক কারণে চিহ্নিত অপরাধীরাও পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে ধারাবাহিকভাবে অপরাধ কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার পরও মামলা ও তদন্তের দুর্বলতার কারণে হত্যা মামলার আসামিরাও পার পেয়ে যায়। সার্বিকভাবে একেই বলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। কোনো সমাজে এমন সংস্কৃতিকে লালন করা হলে সেখানে অপরাধ দমন, শান্তি, স্থিতিশীলতা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব। বুশরার মা ১৬ বছর পরও মেয়ে হত্যার বিচার না পেয়ে ভেঙে পড়েছেন। একইভাবে ঝিনাইদহের শাহানুর বিশ্বাস মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার বিচার চাইতে গিয়ে নিজের দুই পা হারানোর পর এখন প্রভাবশালী সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসীদের দ্বারা বাড়িঘর হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। এ এক নির্মম অবিচারের সমাজ বাস্তবতা। বিচারহীনতার এ সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা পরিবর্তনে সব রাজনৈতিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন