দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পরাজয় মানে ব্যর্থতা। আবার পরাজয় মানে হতে পারে সফলতা, যদি পরাজয়কে জয় করার প্রবণতা মনের মধ্যে গড়ে উঠে। যদি বলি সেকেন্ড প্লেস ইজ ফর লুজার তাহলে কি ভুল হবে? না। পৃথিবীর যেকোনো প্রতিযোগিতায় একটি মাত্র বিজয়ের স্থান রয়েছে সেটা হলো প্রথম স্থান। বাকি স্থানগুলোর কি তাহলে কোনো মূল্যই নেই? আছে। মনে কি পড়ে সেই কথাটি--- আলো বলে, অন্ধকার তুই বড় কালো, অন্ধকার বলে, ভাই, তাই তুমি আলো?
আলো হলো উজ্জ্বল দীপ্তিময়, অন্ধকার হলো আলোহীন তমসা। আলোর বিপরীত রূপ হলো অন্ধকার। আলোর প্রতি আকর্ষণ যতখানি, অন্ধকারের প্রতি ততখানিই অনাগ্রহ। তবু মেনে নিতে হবে, অন্ধকার আছে বলেই আলো অত দীপ্তিময়, আলোর গৌরব বৃদ্ধি। আলো ও অন্ধকারের মতো মানব সমাজের বিপরীতধর্মী কত কিছুই আছে- ভালো-মন্দ, পাপ-পূণ্য, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, উত্থান-পতন, বলে শেষ করা যায় না। ঐ বিপরীত ধর্মিতা সৃষ্টিকে করেছে বৈচিত্র্যময়, সুন্দর ও মধুময়।
দুঃখ নেই শুধু সুখ, সে তো ‹হ্যাপি প্রিন্স› -এর মতো বিড়ম্বিত জীবন। পতনের হতাশাময় জীবনের মাঝে উত্থানের আনন্দঘন মুহূর্তের তুলনা হয় না। কাজেই আমাদের কাছে অন্ধকারের মতো মন্দ, পাপ, দুঃখ, বেদনা, নিরাশা, পতন ইত্যাদি যতই অনভিপ্রেত হোক, ওগুলির প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। এ কথা তো ঠিক যে, ব্যর্থতা ও অসাফল্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সাফল্যের চাবিকাঠি। সেজন্য সৃষ্টিতে বিপরীতধর্মীর সহাবস্থান অপরিহার্য।
খোলা আকাশ কি এতো ভালো লাগতো যদি কিছু কিছু মেঘ নাহি থাকতো। বলি জীবন কি সুন্দর হতো এমন যদি একটুও ব্যথা নাহি থাকতো। এসব কথার মধ্যে যে সত্যতা লুকিয়ে রয়েছে তা অস্বীকার করা কঠিন।
তবে একদিকে দরিদ্রতা যেমন সহজেই নিজের প্রতি বিশ্বাস হারাতে সাহায্য করে অন্যদিকে বিলাসিতা অলসতায় পরিপূর্ণ করে,আর গ্রাস করে জীবনের সুযোগগুলোকে। যারা ভাগ্যের উপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে পরাজয়কে বরণ করে তারা হয় ব্যর্থ আর যারা সব বাঁধা সত্তে¡ও চেষ্টা চালিয়ে যায় তাঁরাই হয় সফল।
মানুষ হিসাবে জীবনের পরিপূর্ণতা পেতে আদেশ, নির্দেশ, উপদেশ, অনুরোধ, ধৈর্য এবং সহ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
আদেশ মানে হচ্ছে, আমাকে যা করতে বলা হবে, আমি তাই ই করব। এখানে কোন নমনীয়তা নেই। পালন করতেই হবে। আদেশ হল কোন কিছু করার বা না করার হুকুম দেওয়া। আদেশ হল ‹অর্ডার›। যারা ‹চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত› নেওয়ার অধিকারী তাঁরাই আদেশ জারি করেন।
নির্দেশ বা ‹ডিরেকশন› দেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। নির্দেশ দেয়া হয় আদেশ পালন করার জন্য।
আর উপদেশ হচ্ছে, আমাকে কিছু বলা হল, যেটা আমার জন্য ভালো। এখন মানব কি মানব না, সেটা আমার ব্যাপার আর পালন করা বাধ্যতামূলক না।
আর উপদেশ হল কোনকিছুর ভালো মন্দ বিচার করে সেটা করা উচিৎ/অনুচিৎ বলা। এটা যেকোনো বয়সের মানুষই দিতে পারে। হতে পারে আমার থেকে বয়সে বড় বা ছোট অথবা হোক সমবয়সী।
মানব চরিত্রের উত্তম গুণাবলির অন্যতম হলো ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ নিজেকে ধৈর্যশীল ও পরম সহিষ্ণু হিসেবে পরিচয় প্রদান করেছেন।
ধৈর্যের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন মজিদে বলেছেন, ‘মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (পারা: ৩০, সূরা-১০৩ আসর, আয়াত: ১-৩)। এই সূরার শেষে আল্লাহ ধৈর্যকে সাফল্যের নিয়ামকরূপে বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করো এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো। আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (পারা: ৪, সূরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ২০০)।
ধৈর্য ধারণকারীর সাফল্য সুনিশ্চিত, কারণ আল্লাহ তাআলা ধৈর্য ধারণকারীর সঙ্গে থাকেন; আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যার সঙ্গে থাকবেন, তার সফলতা অবধারিত। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’(পারা: ২, সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৩)।
ধৈর্য মানবজীবনে পরীক্ষাস্বরূপ। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জাত কোরআনুল আজিমে বলেন, মহামহিমান্বিত তিনি সর্বময় কর্তৃত্ব যাঁর করায়ত্ত; তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদিগকে পরীক্ষা করার জন্যকে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল। (পারা: ২৯, সূরা-৬৭ মুলক, আয়াত: ১-২)।
ধৈর্যশীলদের জন্য রয়েছে সফলতার সুসংবাদ। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা কোরআন মজিদে বলেন, ‘আমি তোমাদিগকে কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের, যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) আমরা তো আল্লাহর এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী’। (পারা: ২, সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)।
আজও আমরা বিপদ-আপদে পড়লে পড়ি, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ (নিশ্চয় আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে আমরা তাঁর নিকটেই প্রত্যাবর্তনকারী)। কিন্তু এটি আমরা পড়ি অধৈর্য হয়ে পড়লে তখনই। মূলত আমরা এর দর্শন ভুলে গিয়ে এটিকে প্রথায় পরিণত করেছি।
এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে উদ্দেশ করে কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব, তুমি ধৈর্য ধারণ করো তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষায়, তুমি মৎস্য-সহচরের (ইউনুস আলাইহিস সালাম) ন্যায় অধৈর্য হয়ো না, সে বিষাদ আচ্ছন্ন অবস্থায় কাতর প্রার্থনা করেছিল।’ (পারা: ২৯, সূরা-৬৮ কলম, আয়াত: ৪৮)।
আমরা সাধারণত বিপদ-আপদ ও বালা-মুসিবতে বিচলিত না হওয়াকেই ধৈর্য বলে মনে করি।
কোনো ব্যক্তি যদি ধৈর্য অবলম্বন করে, তবে তার জীবনে পূর্ণতা ও সফলতা অনস্বীকার্য। কারণ প্রথমত, অন্যায়–অপরাধ তথা পাপকার্য থেকে বিরত থাকা সকল প্রকার অকল্যাণ ও গøানি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়। দ্বিতীয়ত, ইবাদত ও সৎকর্ম সম্পাদন করা সফলতার একমাত্র সোপান। তৃতীয়ত, প্রতিক‚লতায় দৃঢ়পদ থাকা লক্ষ্যে পৌঁছার একমাত্র মাধ্যম। সুতরাং পরিপূর্ণ ধৈর্যই মানবজীবনকে পূর্ণতা দিতে পারে।
বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা-বিপদে আমি না যেন করি ভয়। দুঃখতাপে ব্যথিত চিত্তে নাই-বা দিলে সান্ত¡না, দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।
লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।