তৌহিদবাদীরাই ভারতের আদিবাসী
হিন্দ অঞ্চলে যত লোক বসবাস করে তারাই হিন্দী বা হিন্দু। ফারসী ও তুর্কীতে হিন্দুস্তান। আরবীতে
রবার্ট ফ্রস্ট ‘মেন্ডিং ওয়াল’ কবিতায় বলেছেন-গুড ফেন্সেস মেইক গুড নেইবার্স। কবি বুঝাতে চেয়েছেন, দুটি বাড়ির মাঝখানে ভালো দেয়াল থাকলে ভালো প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করা যায়। পাশাপাশি অবস্থানকারী দুটি দেশের মধ্যে সীমানা নির্ধারিত না হলে পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয় এবং ছোটখাটো বিষয় নিয়েও তখন কলহ-বিবাদ হয়। শস্যখেতের মধ্য দিয়ে গরু নিতে গেলে গরুর মুখে ঠুসি দেওয়া লাগে, যাতে সে অন্যের খেতের ফসল খেতে না পারে। ঠুসি গরুর খাওয়ার স্বাধীনতাকে হরণ করে বটে কিন্তু এ নিয়ে কেউ আপত্তি করে না, কারণ ঠুসি গরুকে তার খাওয়ার সীমানা বুঝিয়ে দেয়।
মানুষ স্বাধীন জীব বলেই যে পৃথিবীর সর্বত্র সে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে, তা বলা যায় না। স্বাধীনতা মূলত একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে এর প্রায়োগিক ক্ষমতা পায়। দেশের বাইরে যেতে গেলে চাই পাসপোর্ট। অর্থাৎ সর্বজনস্বীকৃত সীমানার বাইরে মানুষের স্বাধীনতা প্রয়োগের কোনো ক্ষমতা নেই। মাছ পানিতে শক্তিশালী, ডাঙায় দুর্বল। আকাশের চাঁদ রাত্রির সীমানার মধ্যে সৌন্দর্য জাহির করে কিন্তু দিনের আলোতে নিষ্প্রভ হয়ে যায়। বাঘিনী যে-দন্ত দিয়ে নির্মমভাবে হরিণের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়, সেই একই দন্ত দিয়ে কত কোমলভাবে সে তার শাবককে কামড়ে ধরে বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্যে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যায়। দাঁত থাকলেই যে কামড় বসিয়ে দেয়া যায় না, তা বাঘিনীও জানে। প্রত্যেক ব্যক্তিকেও তার স্বাধীনতার সীমানা বুঝে নিতে হয়, তা না হলে পরিবারে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে, রাষ্ট্রে, কখনো কখনো সারা পৃথিবীতে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। একজন লেখকের জন্যেও সাহিত্যের সীমানা বুঝে নেওয়া তেমনি জরুরি।
প্রায়শই আমরা শুনতে পাই, অমুক বইয়ের জন্য অমুক লেখকের বিরুদ্ধে দেশে দেশে আন্দোলন হচ্ছে এবং অমুক দেশের সরকার শেষপর্যন্ত তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বই সাধারণত দুই কারণে নিষিদ্ধ হয়- জনগণের আন্দোলনের চাপে সরকার নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয় অথবা সরকারের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে সরকারই স্বপ্রণোদিত হয়ে নিষিদ্ধ করে। নজরুলের বিষের বাঁশি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সরকার নিষিদ্ধ করেছিল, নিষিদ্ধ করেছিল শরৎচন্দ্রের পথের দাবিও; অনুরূপভাবে সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেসও বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে। এই দুই-নিষিদ্ধের মধ্যে পার্থক্য অনেক। বিষের বাঁশি ও পথের দাবি স্বাধীনতাহরণকারী জালিম ব্রিটিশরাজের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। আর স্যাটানিক ভার্সেস পৃথিবীর একটি সভ্য জাতির বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিতভাবে অন্যায়-আক্রমণ চালায়। ফলে কোটি কোটি মানুষের ন্যায়সঙ্গত রোষ ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের সরকার বইটি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়। আর্টিস্ট মকবুল ফিদা হুসেন স্বরস্বতী ও ভারতমাতার নগ্ন ছবি এঁকে হিন্দুদের রোষানলে পড়ে দেশ ছেড়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। নজরুল ও শরৎ তো দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবের পক্ষে কলম ধরেছিলেন কিন্তু সালমান রুশদি ও মকবুল ফিদা হুসেন কোন্ বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন তাঁদের সাহিত্য কিংবা শিল্পকর্ম দ্বারা? দাঁত থাকলেই যেমন সব জায়গায় কামড় দেওয়া যায় না, তেমনি কলম থাকলেই যা খুশি তাই লেখা কিংবা তুলি থাকলেই যা খুশি তাই আঁকা যায় না।
মহাকবি মিল্টন ১৬৪৪ সালে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন ‘এরিওপ্যাজিটিকা’ নামে। মিল্টন এ পুস্তিকাটি লিখেছিলেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যখন যে-কোনো গ্রন্থ প্রকাশের আগে সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে বলে আদেশ জারি করেছিল, তার বিরুদ্ধে তাঁর যুক্তি তুলে ধরে। এ পুস্তিকাটি ছিলো মূলত সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে মিল্টনের দার্শনিক বিরোধিতা। মিল্টন বলেন, ‘সমস্ত স্বাধীনতার ঊর্ধ্বে উঠে আমাকে আমার বিবেক অনুসারে জানার, কথা বলার ও মুক্তভাবে যুক্তি পেশ করার স্বাধীনতা দিন।’ লেখকের মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে কলম ধরার কারণে মিল্টন অমর হয়ে আছেন সাহিত্যের ইতিহাসে। কিন্তু মিল্টন লেখকের সেই ধরনের মত-প্রকাশের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন, যে-মত মানুষের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নে অবদান রাখে।
প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে ট্র্যাজেডি, কমেডি, মহাকাব্য, সঙ্গীত- সবকিছুকেই কবিতা বলে গণ্য করা হতো এবং এসবের রচয়িতাদের বলা হতো কবি। প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ থেকে কবিদেরকে উৎখাত করেছিলেন এই অভিযোগে যে, কবিরা মিথ্যা অনুকরণের মাধ্যমে মানুষের ভিতরকার আবেগকে উস্কে দেয়, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। প্লেটোর মতো মহামণীষী কবিদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন কি রুশদির মতো লেখকদের কারণে? মিথ্যা অবশ্যই নিন্দনীয়; কিন্তু সাহিত্যের মিথ্যা আর সাধারণ মিথ্যা যে এক নয়, এরিস্টোটল তাঁর ‘ পোয়েটিকস’-এ তা বুঝিয়ে দিয়েছেন সুন্দরভাবে। মূলত সাহিত্যের মিথ্যা উঠে আসে সত্যের ভিতর থেকে; মানুষের মধ্যে বিরাজমান সত্য থেকে আবির্ভূত হয়ে সে সত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। পথের পাঁচালি-র দূর্গা বাস্তবে না থাকলেও কিছু যায় আসে না কারণ পাঠক জানে, এরকম দূর্গা বসবাস করে আমাদের আশপাশে সর্বত্র। এভাবে সাহিত্যের মিথ্যা মানবজীবনে তার প্রায়োগিক মূল্য পায়। গালিভার ট্রাভেলস ইংরেজি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ স্যাটায়ার। বাস্তবে লিলিপুট, ব্রব্ডিংনাগ, লাপুটা, বাল্নির্বাবি, লাগ্ডাগ্ড্রিব এরকম কোনো দেশ আছে কিনা কিংবা সাতসুমুদ্দুরপাড়ে হুয়িইনিম্সদের কোনো ভূখণ্ড আছে কিনা যেখানে উৎকৃষ্ট সৃষ্টি হলো হুয়িইনিম্স অর্থাৎ ঘোড়া আর নিকৃষ্ট সৃষ্টি হলো ইয়াহু অর্থাৎ মানুষ, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না কারণ আমরা জানি জোনাথান সুইফট এখানে প্রতীকের মাধ্যমে আধুনিক সভ্যতার নানা ভন্ডামি ও অসঙ্গতিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছেন। এ মিথ্যা আমাদেরকে উত্তেজিত করে না, বরং আমাদেরকে পরিশুদ্ধ হতে সাহায্য করে। কিন্তু রুশদি কিংবা ফিদা হুসেনরা সজ্ঞানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সাহিত্য কিংবা শিল্পের নামে যা করেন, তা আমাদেরকে কী দেয় শুধু ঘৃণা ও ক্রোধ ছাড়া?
সত্য আছে দু-ধরনের-প্রচলিত সত্য ও ঐতিহাসিক সত্য। বহু দূরের ঐতিহাসিক সত্যও, যার পক্ষে এখন আর কোনো প্রমাণযোগ্য দলিলপত্র পেশ করা যায় না, মানুষের মাঝে প্রচলিত সত্যের মতোই বিরাজ করতে দেখা যায়। মানুষের অন্তর্গত সত্তা সবসময়ই সত্যের পূজারী। এটা মানুষের খুব দুর্বল জায়গা কারণ এটি মস্তিষ্কে নয়, বিরাজ করে তার অন্তরে; তাই তার এ নরম জায়গায় কেউ হাত দিলে সে প্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকে। এরকম কিছু নরম জায়গা হলো তার ধর্ম, রাষ্ট্র, ভাষা, বংশ, মাতা-পিতা, স্ত্রী-সন্তান। এসব প্রসঙ্গ নিয়ে কেউ বিরূপ মন্তব্য করলে, যদি তা মিথ্যা না-ও হয়, সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এক শহরে দুই বন্ধু বাস করতো; একই শ্রেণিতে পড়াশুনা করতো তারা। একজন ছিলো ফর্সা কিন্তু অহংকারী, অন্যজন কালো কিন্তু বিনয়ী। একদিন ফর্সা ছেলেটি তার কালো বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গেল। তার বন্ধুর মা তাকে এসে স্বাগত জানালো এবং যথাসাধ্য আপ্যায়ণ করলো। পরের দিন স্কুলে কালো বন্ধুর সাথে তার দেখা হলে সে বলে উঠলো, ‘তোর মা যে তোর চেয়েও কুৎসিত!’ আসলে কালো বন্ধুটির মায়ের চেহারা মোটেই সুন্দর ছিলো না, তার উপর তাঁর এক চোখ ছিলো কানা। কিন্তু ঠাণ্ডা, বিনয়ী, ভদ্র ছেলেটি তার বন্ধুর কথা শুনে রেগে গেল এবং কোনো কিছু না ভেবেই তার মুখের উপর সজোরে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো। ফর্সা ছেলেটি থানায় গিয়ে তার বন্ধুর নামে কেস করলো; ফলে পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে গেল। তাকে যখন আদালতে তোলা হলো, আদালত দুই বন্ধুকে জেরা করলো। আদালত কালো বন্ধুর কাছে জানতে চাইলো সে সত্যি সত্যিই তার বন্ধুকে ঘুষি মেরেছে কিনা। সে স্বীকার করলো যে, সে সত্যি সত্যিই তার বন্ধুকে ঘুষি মেরেছে। আদালত তার কাছে জানতে চাইলো, সে কেন তাকে ঘুষি মেরেছে। সে বললো, তার বন্ধু তার মাকে কুৎসিত বলেছে। আদালত ফর্সা বন্ধুর কাছে জানতে চাইলো, সে সত্যি সত্যিই তার মাকে কুৎসিত বলেছে কিনা। সে বললো যে, সে বলেছে। আদালত জানতে চাইলো, সে কেন এরকম কথা বলেছে। সে বললো, তার মা কয়লার মতো কালো, তার উপর তার একটি চোখ কানা। আদালত তার কাছে জানতে চাইলো, তার বন্ধু তাকে কয়টি ঘুষি মেরেছে। সে বললো, একটা। আদালত এবার কালো বন্ধুকে বললো, ‘তুমি এবার গুনে গুনে তাকে দশটা ঘুষি মারো।’ ফর্সা বন্ধুটি এ বিচার দেখে মর্মাহত হলো কিন্তু পুলকিত বোধ করলো উপস্থিত সবাই। কারো মা কালো ও তাঁর এক চোখ কানা কিন্তু তাই বলে তাই নিয়ে তাকে খোঁচা দেওয়ার অধিকার আমাদের আছে কিনা, তা আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে। ভালবাসার জায়গাতে, সত্য দিয়েও যেহেতু আঘাত করা যায় না, তাহলে জলজ্যান্ত মিথ্যা দিয়ে সেখানে আঘাত করলে আঘাতকারীর কী পরিণতি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
কবি-সাহিত্যিকদের প্রায় সময়ই যে-কয়টি ব্যাপারে অভিযুক্ত করা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা ও দেশদ্রোহিতা। দুটিই অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। যদি ধরেও নেয়া হয় যে, ধর্মীয় চর্চার মধ্যে কিছু গলদ-বলদ রয়ে গেছে, যা সেই ধর্মের মানুষকে আধুনিক কিংবা বিজ্ঞান মনস্ক হতে দিচ্ছে না, তাহলে সেসব মানুষকে আলোর পথে আনার উপায় কী তাদের ধর্মীয় বিশ^াসে আঘাত করা? তা অবশ্যই নয়। এ কাজটি লেখক করতে পারেন রূপকের মাধ্যমে, কিন্তু অবশ্যই তা হতে হবে ঘৃণা প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং দরদ ও ভালবাসার মাধ্যমে। জোনাথান সুইফটকেও তাঁর সালিভার ট্রাভেলস-এর মধ্যে আমরা দেখি রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন-আদালত, বিজ্ঞান ও শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মের বিরুদ্ধেও বিদ্রুপের বাণ নিক্ষেপ করতে। লিলিপুটে ধর্মীয় আইন ছিলো ডিম ভাঙতে হবে ডিমের বড় পাশ থেকে। কিন্তু লিলিপুট-সম্রাটের এক পুত্র ডিম ভাঙতে গিয়ে তার হাত কেটে ফ্যালে; ফলে সম্রাট রেগে গিয়ে এক ফরমান জারি করে বসেন যে, এখন থেকে ডিম ভাঙতে হবে ডিমের ছোট পাশ থেকে। এ নিয়ে দেশের লোকজন দু-দলে ভাগ হয়ে যায়। একদলের নাম হয় বিগ-এন্ডিয়ান ও আরেকদলের নাম হয় স্মল-এন্ডিয়ান এবং দেশে শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ, যাতে হাজার হাজার লিলিপুটিয়ান মৃত্যুবরণ করে। বিদ্রোহীদের একটা বিশাল অংশ পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় ব্লেফ্লুস্কুতে এবং তারা ব্লেফ্লুস্কুর সম্রাটকে প্ররোচিত করে লিলিপুট দখল করে নেওয়ার জন্য। সুইফট এখানে লিলিপুটদের ধর্মীয় চর্চাকে হাস্যকর করে তুলে মূলত চপেটাঘাত করেছেন বৃটিশদের মুখে কিন্তু সুইফট তাতে মোটেই আক্রান্ত হননি কারণ তিনি এক্ষেত্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন রূপকের। রুশদির মতো লেখকদের প্রায়শই দেখা যায় সাহিত্য করার নামে দিগম্বর হয়ে নাচানাচি করতে আর বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ ও ধর্মীয় চরিত্র নিয়ে সরাসরি আক্রমণ করতে। সাহিত্য কী জিনিস, তা এঁরা অধ্যয়ন না করেই মূলত সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করেছিলেন বলে মনে হয়, ডাক্তারি না পড়ে ডাক্তার হওয়ার মতো।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি’। আক্রমণটা বড়ই তীব্র কিন্তু বাঙালী তো এতে ক্ষেপে যায়নি রবীন্দ্রনাথের পরে, কারণ বাঙালীও জানে এটা রবীন্দ্রনাথের দরদের মার, ভালবাসার তীব্র আঘাত, যেরকমটি জসীমউদ্দীন মায়ের দরদের ভাষা বুঝাতে গিয়ে বলেছিলেন- ‘ওরে মুখপোড়া, ওরে ও বাঁদর/ গালি ভরা মার এমনি আদর!’ নজরুল কি কম তুলোধুনা করেছেন বাঙালি-মুসলমানকে? কি বিদ্রুপের স্বরেই না তিনি বলেছিলেন-
বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমার তখনও বসে
বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফিকাহ ও হাদিস চষে।
কিংবা তিনি তাঁর ‘জীবনে যাহারা বাঁচিল না’ কবিতায় কি-আঘাতটাই না দিয়েছেন তাঁর পথভ্রান্ত, পশ্চাতপদ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণ মুসলমান জাতিকে!
প্রশ্ন হলো, নজরুল যাদেরকে ‘পৃথিবী হইতে রসাতল পানে’ ছুঁড়ে মারার আহ্বান জানিয়েছেন, সেই বাঙালি-মুসলমানই কেন তাঁকে মাথায় তুলে নিয়ে রাত্রিদিন হর্ষোল্লাস করে? হর্ষোল্লাস এজন্যে করে যে, নজরুলের মতো এত বেশি করে বাঙালি-মুসলমানকে কেউ ভালবাসেনি কখনো। আক্রমণ করার অধিকার তারই তো বেশি, ভালবাসার ক্ষমতা যার সবচেয়ে বেশি। সাহিত্যের মধ্যে যদি স্যাটায়ার, আইরোনি, এলিগোরি না থাকলো, তাহলে তা সাহিত্য বলে বিবেচিত হবে কেন? সাহিত্যের ‘স’ও যারা ঠিকমতো বোঝেন না, এদেশে তাঁদেরকেও দেখা যায় সাহিত্যের সমালোচক সেজে বসতে। প্রতিক্রিয়াশীল অসাহিত্যিক লেখকদের পক্ষেই কেবল সম্ভব নজরুলের মতো মহান লেখকদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা। কারণ, তাঁরা বাঙালি-জাতিসত্তাকে ধারণ করেন না, বাংলার আলো-বাতাসে লালিতপালিত হয়েও তাঁরা বিদেশি মানুষ। এটা বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার, যাদের কলম দিয়ে দু-চরণ অমর পঙক্তি বের হতে দ্যাখেনি কখনো কেউ, তারাও কেমন সাবলীলভাবে নজরুলের মতো এত বড় একজন কবি, সর্বোপরি একটি দেশের জাতীয় কবির বিরুদ্ধে, মিথ্যাচারিতা করে যায়! স্টেজে বাঁদররা দাঁত কেলিয়ে কেমন নাচন-কুদন করে যাচ্ছে আর দর্শক-গেলারিতে বসে বাঘ-সিংহেরা দিয়ে যাচ্ছে করতালি। সেলুকাস! সত্যিই বড় বিচিত্র এই দেশ!
সাহিত্যেও আক্রমণ করা যায়, যেমনটি করেছেন জোনাথান সুইফট কিংবা কাজী নজরুল ইসলাম, কিন্তু সে-আক্রমণকে স্বাগত জানিয়েছে তাঁদের জাতি কারণ তাঁরা মনেপ্রাণে ছিলেন জাতীয় লেখক, স্বজাতি-বিদ্বেষী ছিলেন না কখনো। ওয়ার্ডসওয়ার্থকেও আমরা দেখি ‘লন্ডন-১৮০২’ কবিতায় ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতে কিন্তু তাঁর এ ফুঁসে ওঠা ইংল্যান্ডের স্বার্থবিরোধী ছিলো না, বরং তা ছিলো এর কল্যাণের জন্যেই। তিনি বলেন,
হে মিল্টন, যদি আপনি থাকতেন এ-সময় বেঁচে!
ইংল্যান্ডের প্রয়োজন আপনাকে, কারণ সে গেছে
হয়ে এক বদ্ধ জলাশয়। তার কবি-সাহিত্যিক,
উপাসনালয় ও যোদ্ধারা হারিয়ে ফেলেছে দিক
আর অতীত গৌরব। ভরা ছিলো কি-সুখে অন্তর!
হারিয়েছি সে-সুখ যখন হয়ে গেছি স্বার্থপর
আমরা সবাই। হায়, কবি, জাগিয়ে তুলুন ফের
এ জাতিকে। এবং ফিরিয়ে দিন এসে আমাদের
হৃত সব সদাচার, সৎগুণ, শক্তি, স্বাধীনতা।
আপনার আত্মা ছিলো নক্ষত্রের মতো, কখনো তা
থাকেনি এ মর্ত্য; আর ছিলো আপনার কণ্ঠস্বর
সমুদ্র উত্তাল; খোলা আকাশের মতো নিরন্তর
পবিত্র-স্বাধীন যেতেন আপনি ছুঁয়ে সমুদয়
পথ; ছিলো সবার সেবায় লিপ্ত আপনার হৃদয়।
মূলত কবি-সাহিত্যিকদের আক্রমণ হয় কাউকে আহত করার জন্য নয়, বরং একটি জাতিকে পরিশুদ্ধ করার জন্য কিংবা জাগিয়ে তোলার জন্য। সাহিত্য কোনো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা নয় যে, শত্রুপক্ষকে যেভাবেই হোক আমাদের পরাজিত করতেই হবে; এটা কোনো দৌড়-প্রতিযোগিতাও নয় যে, সব প্রতিযোগীকে পিছনে ফেলে আমাদের স্পর্শ করতেই হবে বিজয়ের রেখা। সাহিত্য তো সত্যের শিল্পায়িত রূপ; সাহিত্য তো শান্তির, আনন্দের ও মুক্তির শেষ আশ্রয়; এ জগৎ কলুষিত হলে, এ-আকাশ ভরে গেলে হিংসার মেঘে মেঘে, কোন্ আকাশের নিচে গিয়ে দাঁড়াবে মানুষ?
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।