তৌহিদবাদীরাই ভারতের আদিবাসী
হিন্দ অঞ্চলে যত লোক বসবাস করে তারাই হিন্দী বা হিন্দু। ফারসী ও তুর্কীতে হিন্দুস্তান। আরবীতে
রোজকার মত গেটে ঢুকতে গিয়েই বাধা পেলাম। একজন কম্বলধারী এগিয়ে এসে হাসলো নির্বিকারভাবে।
বলল--
: খুকুমণি না?
চারপাশ থেকে কয়েকজন হেসে উঠলো। আমি হতভম্ব।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেয়েকে কে কবে খুকুমণি হতে দেখেছে। আর ওটা আমার নামও নয়।
কারা যেন ফোড়ন কাটলো--
: মাই গড! পাগলটা কি চোখে আজকাল কম দেখতে শুরু করেছে। ইয়াং লেডিকে বলছে বেবী!
কান আমার গরম হয়ে উঠলো। বুঝতে পারলাম, চোখ-মুখ আমার লাল হয়ে গেছে।
নিজেকে শক্ত করে এগুতে চাইলাম; কিন্তু পাগলটা এবার হা-হা করে হাসতে হাসতে পথ রোধ করলো। আমার মুখের ওপর সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে বললো-
: হে, ভুল করিনি বাবা, ঠিক চিনেছি যা মজা হয়েছিল চোর ঠ্যাঙ্গাতে গিয়ে। চাষাটা ক্ষেপে উঠেছিল। হবে না? সব যে চাষা, তোমার মনে নেই খুকুমণি? আমি চমকে দু’পা পিছিয়ে এলাম। বলে কি পাগলটা! পেছন থেকে কে একজন ডাকলো-
: চলে আয় ভাই, কি শুনছিল?
কিন্তু সত্যি আমি চলে আসতে পারলাম না। পা-দু’টো যেন সেঁটে গেছে মাটির সাথে।
হঠাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে পাগলটা একটি শব্দ করলো। বলল--
: খুবতো নিয়ে গেলি চোর ঠ্যাঙ্গাতে। অমনি বলতো দেখি গহরকো বোলাও। আরে ফুঁ, গহর কি আর আছে? মরে ভূত হয়ে গেছে না? হাত দু’খানা কি আর আস্ত রেখেছিলি তোরা হ্যাঁ?
আমার স্তব্ধ ভয়টা এবার থরথর করে কাঁপতে লাগলো। সন্দেহ রইলো না, এই সেই মানুষটি, যাকে আমি সবচে বেশী ভয় পেতাম।
না, না, কোন সন্দেহ নেই। এই সেই গহর। আমার চোখের সেই দানব-দানব মানুষটাই। তখন কেন? আজ এই মুহুর্তেও ওকে আমার ভয় করছে।
তখন আমার বয়স খুবই কম।
থ্রি-ফোর -এ পড়ি। সে সময় আমাদের পাড়ায়-মানে চাষাড়ায় ভীষণ চোরের উপদ্রব শুরু হলো। চোর নামক জীবকে আমি তখন থেকেই মৃত্যুদূত জ্ঞানে সমীহ করি। ওরে বাপ! এর চেয়ে ডাকাত ঢের ঢের ভালো। আজও চোরের নাম শুনলে আমার বুকে রক্ত জমে যায়।
প্রায়ই কানে আসতো-আজ ঝিনুদের বাড়ির কল দুমড়ে মাটির সাথে লেপটে দিয়েছে। কাল নসু মামার বাইরের দরজায় দুপুর রাতে ধুমদাম লাথি মেরে গেছে। আর বিচিত্র এক ছবি এঁকে রেখেছে খড়িমাটি দিয়ে। তারপর দিন টুনুদের রান্নাঘরের চুলোয় মল ত্যাগ করেছে। ইত্যাদি।
পরপর চার পাঁচদিন এলো। জানালার গোটা দুই শিক বাঁকা করলো। এরিয়ালের তার ছিঁড়লো এবং বাগানের বাড়ন্ত গাছগুলোর মূল উপড়ালো। পাড়ার বাসিন্দারা চঞ্চল হলো। দলকে দল পরামর্শ সভা ডকলো। মেয়েদের মুখ শুকনো হলো।
আর আমরা!
বাচ্চারা সন্ধে হলেই চোখ-মুখ বন্ধ করে বুকে স্পন্দন শুনতুম।
ঠিক এমনি সময় আমাদের বাড়িতে মেম্বার হয়ে গেল গহর। মামাই নিয়ে এলেন। দিনে অফিসে দারোয়ানের কাজ করবে। আর রাতে বাড়ি পাহারা দিবে। আগে দরকার ছিল না। কিন্তু এখন বাড়ি পাহারা দেবার লোকের প্রয়োজন হয়েছে। পাড়ার কলেজের ছেলেরা পালা করে রাতের বেলা পাহারা দিতে শুরু করেছে।
দু’মামা ছিলেন সেই দলে। প্রায় ছ’ফুট লম্বা দেহের গহর। সেদিন বিকেলে মার সাথে পরিচয়পর্ব সারছিল। আমি ওর সামনে যাইনি। আড়াল থেকে দেখছিলাম এবং দেখেই ভয় পেয়েছিলাম। রাজশাহীর মানুষ গহর। বলিষ্ঠ গড়ন; লোমশ হাত। গভীর চোখ। ওকে আমার দস্যু মনে হতো। অনেক সময় ভাবতাম—
কে জানে! হয়তো চোরদের রাজা। নইলে অমন শক্ত শরীর আর শক্ত চেহারার মানুষ হয়!
মা বললেন-সবার সাথেই তো পরিচয় হলো। আমার বড় মেয়েকে বোধহয় দেখনি। দাঁড়াও ওকে ডাকি।
বয়স যতই হোক না কেন বাড়ির বড় মেয়ে সম্পর্কে প্রায় সবারই একটা আকর্ষণ জাগে।
বিশেষ করে বড় মেয়েটি যদি অদেখা হয়, তবে তার সম্বন্ধে একটু চিন্তারও অবকাশ পাওয়া যায়।
গহর নামক বিরাট দেহী মানুষটার বেলায়ও তাই ঘটলো।
আমি সেই থেকে জানালার ফুটোয় চোখ পেতে বসে আছি।
মা তখন ডেকেই চলেছেন আমাকে। আবার বলেছেন--
: বড় মেয়েটি আমার ভারী লাজুক।
আমি লাজুক ! লজ্জায় আসছি না ওই দৈত্যটার কাছে। আশ্চর্য ধারণা মার।
আসলে তো আমি ভয় পেয়েই লুকিয়ে আছি। অমন মানুষটার সামনে বসে মা হেসে কথা বলছেন কি করে?
বুকের রক্ত আমার জমতে শুরু করেছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি। নইলে, হঠাৎ আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে কেন?
: কইরে এলিনে-
মা এবার ধমকে উঠলেন।
এরপর আর আমার লুকিয়ে থাকা চলে না। অন্তত সে সাহস আমার নেই। চোখ ভিজে উঠলো। আমি পর্দার পাশে এসে দাঁড়ালাম।
একটিবার মাত্র নড়ন্ত পর্দার দিকে চোখ তুলে ঠোঁট চাটলো লোকটি, দৃষ্টি সরালো। মা বললেন- আয়।
আমি এলাম।
আর সেই মুহূর্তে রক্তিম চোখ তুললো গহর।
সেদিন মায়ের আট বছরের বড় মেয়েকে দেখে পঁচিশের গহরের মনে কি ভাবের উদয় হয়েছিল তা আমি জানতে পারিনি।
তবে স্পষ্ট মনে আছে, কয়েক মুহূর্তে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দুই বিশাল লোমশ বাহু প্রসারিত করে বলেছিল-
: এসো খুকুমণি-
আমি স্তব্ধ।
মা বললেন- ডাকছে, যা না।
গহর হাসলো তেমনি দুই বাহু বাড়িয়ে ‘এসো’-
যা ভেবেছিলাম-
নিশ্চয়ই চোরের রাজা। নইলে হঠাৎ কেন আমার জন্যে লোকটা এত ব্যস্ত হয়েছে। অথচ মা কেন এই সাধারণ কথাটুকু বুঝতে চেষ্টা করছে না।
লোকটা বুঝি এবার উঠবে আমায় ধরবার জন্যে।
নড়ে উঠলো গহর।
একটি মাত্র মুহূর্ত।
একছুটে পালিয়ে এসে ঢুকলাম শোবার ঘরে। তারপর দিলাম সব কটা খিল তুলে।
বাইরে হা- হা করে হেসে উঠলো গহর নামের সেই মানুষটা। মা হেসে বললেন ‘দুষ্টু’।
দুষ্টু আমি!
এ লোকটার হাতে ধরা দিইনি বলে দুষ্টু, শুধু মা আমায় এতবড় অপবাদ দিলেন।
নইলে কবে আমি দুষ্টুমী করেছি। কে বলতে পারবে ও কথা। আজ -আজ মা- হঠাৎ .......। আমি ঢুকরে কেঁদে উঠলাম।
জানলাম চোর তাড়াবার দলে গহরও নাম লেখালো।
পাড়ার তরুণরা রাত দশটার পর থেকে বন্দুক, লাঠি, টুকরো ইট আর টর্চলাইট নিয়ে বাড়ির ছাদে গিয়ে জমা হতো।
কয়েকটা বাড়ি পরপর একেক ছাদে চার- পাঁচজন করে থাকতো।
: গহর বললো--
ছাদে নয়-সে বাড়িগুলোর পেছন দিকে রাতে টহল দেবে। ওতেই নাকি চোরের সাথে সাক্ষাৎ ঘটবার সম্ভাবনা বেশী।
দলের নেতা ছিলেন সেজ মামা।
বললেন-
: বেশ তাই হবে। চোর ধরতে পারলে পুরস্কার পাবি।
হা-হা করে হেসে লাঠি আর টর্চ হাতে বেরিয়ে পড়লো গহর।
মামারা দলবল নিয়ে নিজেদের ডিউটিতে গেলেন।
তিনদিন হলো, অথচ চোর নামক ভয়াবহ জীবটির পাত্তা নেই।
পাহারাদের দল তবুও হাল ছাড়লো না।
সকাল দশটার মধ্যে সবাই যে যার কাজে চলে যায়। ফিরে সেই বিকেল পাঁচটার দিকে তারপর বসে পরামর্শ সভা।
নতুন নতুন পরিকল্পনা উদ্ভব হয়, একেকজনের মাথায়। গহরও তার বিরাট দেহে ঈষৎ ঝাঁকুনী দিয়ে সেজ মামার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মামা বললেন--
: কি রে! কি মনে হয় তোর?
: আমার? ভ্রু কুঁচকালো গহর। বললো--
: স্যার, আয়োজনটা বড় বেশী হয়ে যাচ্ছে। দল বড় দেখে শিকার সাবধান হয়ে গেছে। ভারটা শুধু আমায় দিলে-
: শুধু তুই একা?
: জী স্যার, নির্বিকার কণ্ঠ গহরের।
দলের সবাই মুখ দেখা দেখি করতে লাগলো।
গহর ওদের মনের অবস্থা আঁচ করতে পেরে বলিষ্ঠ কন্ঠে বলল--
: ভয়ের কোন কারণ নেই স্যার। আজ থেকে আমি একাই পাহারা দেব।
শেষ পর্যন্ত সবাই রাজী হলো। কিন্তু আমার ভয় বেড়ে গেল।
নিতান্ত অসাবধানতার জন্যে কচিৎ আমি গহরের সামনে পড়ে যেতুম।
আর অভ্যাস মত হা- হা করে হেসে উঠতো গহর, ডাকতো, ‘অমন কর কেন খুকুমণি? আমি ম্যাজিক জানি। দেখবে এসো।’
ম্যাজিকের নামে আমার বয়সী ছেলে -মেয়েরা গহরের চারপাশে ভিড় করতো। বিরক্ত করতো। আমি একছুটে ঘরে ঢুকতুম।
ম্যাজিক না হাতী। শেষে আমায় বিড়াল কিংবা কুকুর বানিয়ে দেবে আর কি। উঃ, কি সাংগাতিক ডাইনী মানুষ।
ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠতো।
সারারাত পাহারা দিয়ে খুব ভোরে রক্তঝরা চোখ আর অবিন্যস্ত চুল নিয়ে সামনের পুকুরটায় ডুব দিতো গহর।
ঠিক সেই মুহূর্তে ওকে আমার গল্পের বই-এ পড়া তান্ত্রিক মনে হতো।
লোকটা যেন তাই-
মামাকে কতদিন বলেছি, ‘দাও না ছাই ও লোকটাকে বিদায় করে’।
দরকার হলে বাড়িতে পুলিশ এনে রাখো।
কিন্তু আমার মত এক ক্ষুদে মানুষের কথায় তিনি কান দেবেন কেন?
স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, একটা সর্বনাশ খুবই তাড়াতাড়ি ঘটবে। এবং সে ঘটনার নায়ক হবে এই দানব দানব লোকটা। তখন সবাই বুঝবে যে ছোটরাও মাঝে মাঝে বুদ্ধির কথা বলে-
কিন্তু তখন বুঝেই বা আর কি হবে! যা হবার তাতো হয়েই যাবে।
আমার অনুমানই ঠিক। শেষ পর্যন্ত ঘটনাটা ঘটেছিল যার নায়ক সেই গহর।
রোজকার মতো সে রাতে গহর পাহারায় বের হলো। হাতে ইয়া মোটা লাঠি আর টর্চ। অভ্যেস মত বার কয়েক হৈ হৈ শব্দ করলো। পাড়ার মানুষেরা শুয়ে শুয়ে ভাবলো, গহর বেরিয়েছে। এবার নিশ্চিন্তে ঘুমোন যেতে পারে!
তারপর আবার চারদিক ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো। একটা কুকুর পর্যন্ত ডাকলো না। কারো বাচ্চা কাঁদলোনা। হয়তো সে রাতে গহর ছাড়া পাড়ার আর কোন প্রাণী জেগে ছিল না।
সারাদিন আকাশ মেঘলা ছিল সন্ধ্যে থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে।
মা একবার বলেছিলেন।
: আজ নাইবা গেলে গহর। বৃষ্টি পড়ছে। সারা রাত ঘুরে পাহারা দিলে অসুখ করতে পারে।
প্রতি-উত্তরে বিরাট এক সালাম ঠুকলো গহর। বলল--
: কিন্তু আজই যে ও ব্যাটার আসবার কথা মা। ঠান্ডা পড়ছে। সবাই আজ কষে ঘুম দেবে ও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে।
বেরিয়ে পড়লো গহর।
মাও আর বাধা দেননি। কারণ, কথাটা তারও একবার মনে হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমার ঘুমটা অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশী তাড়াতাড়ি এসেছিল।
একেই বৃষ্টি দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই। সব কাজ খেলা ছেড়ে জানালার ধারে বসি। কিন্তু একে রাত তার উপর চোরের উপদ্রব। এক্ষেত্রে জানালায় বসা আমার পক্ষে অসম্ভব। বিছানায় শুয়ে টুপটাপ শব্দ শোনাই ভালো।
এবং ওই বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতেই আমি সবার আগে ঘুমিয়ে পড়লাম।
হঠাৎ মাঝ রাতে দরজার ওপর দুমদাম শব্দ ও বহু কণ্ঠের হৈ-চৈ এঘুম ভেঙ্গে গেল।
বুঝলাম দীর্ঘদিন বিরতির পর চোর এবার সবান্ধব আক্রমণ চালাতে এসেছে।
ছোট মামা তড়াক করে উঠে বন্ধুক হাতে নিলেন। বাবা বাড়িতে নেই। মায়ের মুখ ফ্যাকাশে।
একটি বার মাত্র তাঁর গলা চিরে একটা অস্পষ্ট শব্দ বেরুলো-
: গহর-
বাইরে তখন ‘মার মার’ ‘ধর ধর’ ‘দরজা খোল’ ইত্যাদি শব্দের গর্জন চলছে।
ব্যপারটা বুঝতে মেজ মামার ক মুহূর্ত সময় মাত্র লাগলো।
তারপর খুশির বিদ্যুৎ খেলে গেল তাঁর সারা মুখে। মুহূর্তের জন্যে মার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন--
: ওরা চোর ধরেছে-
তারপরেই দড়াম করে দরজা খুলে লাফিয়ে পড়লেন বারান্দার নিচে-মাঠে।
ছোট মামাও ছুটলেন।
আমাদের ঘরে খানিকটা আলো পড়েছে মাঠে। সেই আলোতেই স্পষ্ট দেখলাম চোর নামক জীবটাকে প্রায় ১০ জোড়া হাত - পা শিক্ষা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে।
লাথি, কিল, ঘুষি চলছে অনবরত।
বার কয়েক অষ্ফুট স্বরে কি যেন বলতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো চোরটা। একজন রসিকতা করলেন-
: আরে দেখি শ্রীমানের মুখটি, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। টর্চের আলো পড়লো ওর মুখে। আর তখুনি আর্তনাদ করে চোরটার সামনে এসে দাঁড়ালেন সেজ মামা-
গহর!
হঠাৎ যেন বিস্ময়ের চিৎকার উঠলো সব মানুষের কণ্ঠ চিরে।
সেজ মামা গহরের রক্তাক্ত মাথাটা তুলে নিলেন নিজের কোলে।
বললেন-
: এ তোমরা কি করেছো? কেন এমন সর্বনাশ করলে? তোমরা কি মানুষ নও?
সেজ মামা যেন কেঁদে ফেললেন সবাই বিমুঢ়। একজন বললে-
: আমরা ওকে চোর মনে করে-
: চোর মনে করে?
সেজ মামা গর্জন করে উঠলেন, বললেন-
: তোমরা জানতে না, ও পাহারা দেয়? এরপর আর কথা হয়নি।
সবাই ধরাধরি করে গহরকে এনে শুইয়ে দিল বৈঠকখানার একপাশে। সে রাতে কারো ঘুম হয়নি। মা নিজে গহরের সেবার ভার নিলেন। বার কয়েক চোখ মুছলেন। মামারা সবাইকে জেঁকে ধরলেন, বললেন-
বল, কেন এ ভুল করলে?
গহরের জন্যে গরম পানি আর মামার বন্ধুদের জন্যে চা করা হয়েছিল সেই রাত চারটায়।
সেজ মামার প্রশ্ন অন্যদের উত্তর - এই করে করে রাত ভোর হলো।
শুনলাম--
আজ বৃষ্টির দিন বলে সবার মনের সেই পুরোন ভয়টা জেগেছিল। কাজেই পাড়ার কয়েকজন দলপতি অর্থাৎ সেজো মামাকেও না জানিয়ে নেহাত ব্যক্তিগতভাবে ছাদের চিলে কোঠায় বসে পাহারা দিচ্ছিলেন।
এমনি সময় গহর অতিরিক্ত বুদ্ধিমানে পরিচয় দেবার জন্য সব বাড়ীর পেছন দিককার পাঁচিল টপকে দেখছে, এমন উপযুক্ত রাতে চোর কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা।
হাতে টর্চ আর তেল চকচকে লাঠি। ছাদের ওপরের বাসিন্দরা ছায়ামূর্তির পাঁচিল টপকানো দেখলো। আর তখুনি ওপর থেকে নেমে এলো একজন। দু’জন রইল-ওপর থেকে গতিবিধি লক্ষ্য করবার জন্যে।
হঠাৎ গহর দেখলো অন্ধকারে গা মিশিয়ে কে একজন এদিকে আসছে। আর যায় কোথা।
অপর পক্ষ টর্চ মারার আগেই গহর হাতের লাঠি মারলো। চিৎকার করে বললে-
: এসেছে বাছাধন। ব্যাটা চোর হয়ে ডাকাতি। শালা চোরের বাচ্চা।
গহরের মাথা তখন চোর ধরার নেশায় খুন চেপে গেছে।
অপরজন লাঠির বাড়ি খেয়েও জাপটে ধরেছে গহরকে। আরো সবাই ছুটে এলো।
: ধরেছি ধরেছি মার শালা চোরের বাচ্চাকে। হৈ- হৈ শব্দ তুলে মারতে মারতে টেনে -হিচড়ে গহরকে নিয়ে এলো মাঠে।
ওদেরকে বুঝাবার সুযোগ গহর পায়নি। অতিরিক্ত বাহবা পাবার লোভেই নিজেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে এলো গহর।
মামাদের আলোচনায় রাত শেষ হলো। মস্ত বড় পরাজয় আর বেদনার ছবি নিয়ে যে যার ঘরে ঘরে ফিরে গেল। গহরের অবস্থা দেখবার মতো মানষিক শক্তি বোধ হয় সেজ মামার ছিল না। তাই পাঞ্জাবীটা গায়ে চড়িয়ে রাস্তায় নেমে পড়লেন। তখনো খুব বেশি লোকের চলাচল শুরু হয়নি। দেখলাম চৌমাথার বটতলা ছাড়িয়ে শ্মশান ঘাটের পথ ধরে এগিয়ে গেছেন, সেজ মামা।
আমি তখনো বারান্দার মোটা থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
কখন আকাশ ফরসা হয়েছে, কখন সূর্যের লালচে রংটা সাদা হয়ে গেছে, খেয়াল করিনি।
মুখ ধোয়া হয়নি। নাস্তা করাও হয়নি।
তখনকার মনের অবস্থা প্রকাশ করা আজ কোন প্রকারেই সম্ভব নয়!
মনেও নেই সেদিন আমার কেমন লেগেছিল। কিন্তু এটা স্পষ্ট মনে আছে যে, হঠাৎ ছুটে গিয়ে সিঁড়ির ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে ভয়ানক কেঁদেছিলাম।
কেঁদেছিলাম আমার চোখের দৈত্যটার ওই আশ্চর্য ক্লান্ত শ্রান্ত আর রক্তাক্ত ছবিটা দেখে।
মার মুখেই শুনেছিলাম গহরের কান দিয়ে নাকি অনবরত পুঁজ পড়ছে।
নাক-কান দিয়ে একটা বাজে গন্ধ বেরুচ্ছে।
জোর চিকিৎসা চলছিল।
প্রায় দিন পনের পর বিকেলে গহরের বিছানার ধারে। জানালার বাইরে এসে দাঁড়ালুম।
কিন্তু গহর আমায় দেখে ফেললো। অনেক কষ্ট করে অভ্যেস মত হাসতে চাইলো। ব্যান্ডেজ করা ডান হাতটাও ঈষৎ প্রসারিত করল। বলল-
: এসো।
আমি কেঁপে উঠলাম।
গহর বলল--
: মরেই তো যাব খুকুমণি। তবু ভয় করছো? এত ডাকছি, তবু একটিবার কাছে এসে দেখলে না?
আমার কিছু বলবার ছিল না। কিন্তু ভেতরেও আমি যাইনি। ভয়টা আমার বেড়ে গেল।
সারাদিন ধরে পাড়ার মানুষরা দেখতে আসতো। দুঃখ করতো।
হাসতো গহর। বলতো।
: এ পাড়ায় আর কোনদিন চোর আসবে না হুজুর। এ ভালোই হলো।
শিক্ষা হয়ে গেল ব্যাটাদের।
এর দিন কয় পরে-
ভোর বেলা মা গহরের জন্যে চায়ের বাটি নিয়ে গিয়ে দেখলেন-
বিছানা শূন্য।
গহর নেই।
এই ‘নেই নেই’ শব্দটা আমার সেদিন কানে বড় বেশি বেজেছিল।
চারদিকে সন্ধান করা হয়েছিল। কিন্তু ফিরে আর আসেনি গহর। মা কেঁদে বলেছিলেন।
: কোথায় গেল এই শরীর নিয়ে? জলে-ঘাটে মরা ছাড়া তো ওর...।
সেজ মামা বাধা দিয়ে বলেছিলেন-
: মরে মরুক। এখানে এই অবস্থায় থাকতে হয়তো ওর বিবেকে বেধেছে। নিজের ইস্পাত শরীর নিয়ে অহঙ্কার তো কম নয়। হয়তো, তাই।
কে জানে কার কথা সত্যি।
এরপর কত বছর কেটে গেছে। তখনকার কথা ভাবার প্রয়োজন বোধ করিনি কোনদিনও। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে বুঝতে পারছি, মায়ের অনুমান মিথ্যে। মামার অভিমানের অভিশাপও মিথ্যে।
সেই লম্বা-চওড়া দেহের গহর অহঙ্কারের শরীরকে ধুলায় মিশে যেতে দেয়নি...।
বরং একটা নতুন জীবনের মাঝে নিজেকে প্রকাশ করতে চাইছে।
আমার কল্পনার ভেলায় দাঁড়া থামিয়ে হা-হা করে হেসে উঠলো কম্বলধারী গহর। তেমনি লোমশ বাহু প্রসারিত করে বলল-
: এসো -খুকুমণি।
একটি মাত্র মুহূর্ত। ওর মুখের দিকে চাইলাম। তারপরেই দ্রুত পায়ে গেটের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বিশ্বাস কি?
তখন পারেনি হাজার চেষ্টা করেও কাছে টানতে। হয়ত আজ টানাটানি শুরু করে দেবে হাত ধরে।
কিন্তু যেতে যেতে স্পষ্ট শুনতে পেলুম, গহর বলছে-
: তুমি অনেক বদলেছ খুকুমণি। অনেক সুন্দর হয়েছো। কিন্তু তোমার সেই ভয় পাওয়াটা একটু বদলায়নি।
তারপরেই সেই প্রচন্ড হাসি।
আমি প্রায় ছুটতে ছুটতে ওর চোখের আড়াল হয়ে গেলাম।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।