Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ব্যাংকিং সেবায় নতুন দিগন্ত ‘উপশাখা’

গ্রামীণ জনগোষ্ঠী স্বাভাবিক ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছে : আবু ফারাহ মো. নাছের ষ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জনপ্রিয় মাধ্যম, গতি বাড়ছে অর্থনীতিতে

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৩০ মে, ২০২২, ১২:০০ এএম

ব্যাংকের একটি শাখা খোলা মানে অনেক সাজসজ্জার বিশাল জায়গা নিয়ে কার্যক্রম চালানো। মাস শেষে মোটা অঙ্কের ভাড়া ও ইউটিলিটি বিল গুনতে হয়। শাখাগুলোতে গ্রামের সাধারণ মানুষ ঢুকতেও ভয় বা ইতস্তত বোধ করে। নতুন শাখা খুলে মুনাফা তুলে আনাও বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। শাখার জায়গা ক্রয় বা ভাড়া নিয়েও একাধিক ব্যাংক পরিচালকদের অনিয়মের উদাহরণ রয়েছে। আর এসব খরচ তুলতে গিয়ে ব্যাংকগুলো এতদিন ঘুরেফিরে শহর ও বড় বাজারকেন্দ্রিক শাখা খুলত। তবে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কমাতে এখন অনেক ব্যাংক উপশাখা খোলায় জোর দিয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম ছাড়া এসব উপশাখার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ, আমানত সংগ্রহসহ যাবতীয় ব্যাংকিং সেবা দেয়া হচ্ছে। একটি শাখার আওতায় এসব উপশাখা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ফলে গ্রাহকরাও সব লেনদেন স্বাভাবিকভাবেই করতে পারছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাছের ইনকিলাবকে বলেন, গ্রামের সাধারণ মানুষ যারা ব্যাংক বিমুখ ছিল তাদের ব্যাংকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে ‘উপশাখা’ একটি নতুন মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। তিনি বলেন, উপশাখার সিংহভাগই গ্রামে। ব্যাংকের সাধারণ শাখা অভিযাত এলাকায় এবং সাজ-সজ্জার কারণে গ্রামের মানুষ ভয়েও প্রবেশ করেনা। সেখানে উপশাখাগুলো গ্রামের ছোট বাজার, ইউনিয়নে স্থাপন করায় গ্রামের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকিং কার্যক্রম করতে পারছে। আবু ফারাহ মো. নাছের বলেন, ইতিমধ্যে দেশে ১১ হাজারের মত ‘উপশাখা’ চালু করা হয়েছে। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে দেশে শাখা খোলা হয়েছে ১৩ হাজারের মত। তিনি বলেন, বাড়ির কাছে উপশাখা চালু হওয়ায় সহজেই মানুষ ব্যাংকে হিসাব খোলার সুযোগ পাচ্ছে। ব্যাংকগুলো স্বাভাবিকভাবেই কৃষি ও এসএমই ঋণ প্রদাণ করতে পারছে। বেশিরভাগ ব্যাংক উপশাখা খোলার দিকেও আগ্রহ দেখাচ্ছে। একটি উপশাখাতে কম স্থান এবং কম লোকবল নিয়ে মূলত শাখার মতো করেই ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো যায় বলে বেশিরভাগ ব্যাংকই নতুন নতুন উপশাখা খোলার দিকে নজর দিচ্ছে। আবু ফারাহ মো. নাছের বলেন, দেশে উপশাখা চালু করা নিয়ে প্রথম আমি উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আমি চট্রগ্রামে চলে যাওয়ায় করা সম্ভব হয়নি। ডেপুটি গভর্নর হওয়ার পর সাধারণ মানুষকে ব্যাংকিং সেবায় অন্তুর্ভুক্ত করতে আবার গুরুত্ব দিয়েছি। আর এখনতো ব্যাংক ও সাধারণ গ্রাহকের কাছে আস্থার নাম ‘উপশাখা’। ইতিমধ্যে ৬০টি ব্যাংকই উপশাখা কার্যক্রম চালু করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে মোট উপশাখা ছিল ১ হাজার ১৪৭টি। জনপ্রিয়তা বাড়ায় চলতি বছরের এপ্রিল শেষে ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। সূত্র মতে, দেশে ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রথম উপশাখার ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করে চতুর্থ প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমাল। এরপর ওই বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকের ব্যবসায়িক কেন্দ্র স্থাপনবিষয়ক নীতিমালায় বুথ ব্যাংকিংকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে বুথ ব্যাংকিং শব্দ নিয়ে অনেকের মধ্যে অস্পষ্টতা থাকায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নীতিমালা সংশোধন করে এর নাম দেয়া হয় উপশাখা। এরপর স্বল্প পরিসরে কয়েকটি ব্যাংক উপশাখা কার্যক্রম শুরু করলেও করোনাভাইরাস মহামারি সংক্রমণের পর ব্যাপকভাবে এদিকে ঝুঁকেছে ব্যাংকগুলো। এক হাজার বর্গফুটের কম জায়গায় দুই থেকে তিনজন লোকবল নিয়ে উপশাখা পরিচালিত হয়। একটি শাখায় পাঁচ থেকে ২০ জন লোকবল থাকে। উপশাখায় কম লোকবল ও কম জায়গার কারণে তুলনামূলক আয় কম হলেও তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় অনেক কম থাকে। ফলে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামে উপশাখা খুলে খুব অল্প দিনের ব্যবধানে মুনাফা করতে পারে ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকগুলো নতুন শাখা খোলার গতি একেবারে কমিয়ে এনেছে। ২০২০ ও ২১ নতুন শাখা খুলেছে ব্যাংকগুলো ১শ’ নিচে। ২০২০ সালে সব ব্যাংক মিলে মাত্র ১০৩টি শাখা খুলেছে। ২০১৯ সালে যেখানে খুলেছিল ২৮৭ শাখা। এর আগে কয়েক বছর গড়ে তিনশ’র বেশি শাখা খুলত। অথচ ২০১৮ সালের অক্টোবরে একেবারে নতুন ধারণা নিয়ে শুরু হওয়া উপশাখার সংখ্যা বাড়ছে। দেশে কার্যরত ৬১ ব্যাংকের মধ্যে সিটিজেন ব্যাংক ছাড়া সবাই উপশাখা কার্যক্রম শুরু করেছে। সিটিজেন ব্যাংকও ৬টি উপশাখার আবেদন করেছে। শীর্ষ ১০ ব্যাংকের তালিকায় থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে উপশাখা বেশি চালু করেছে আইএফআইসি ব্যাংক। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। আর দেশে প্রথম উপশাখা চালু করা এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক এখন পর্যন্ত খুলেছে ৮৮৭টি উপশাখা। ব্যাংকটি তৃতীয় অবস্থানে আছে। চতুর্থ অবস্থানে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, পঞ্চম অবস্থানে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। শীর্ষ ১০ ব্যাংকের তালিকায় থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে পর্যায়ক্রমে ইউসিবিএল, এক্সিম, যমুনা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট এবং ওয়ান ব্যাংক। এর বাইরে অগ্রণী, প্রিমিয়ার, ব্যাংক এশিয়া, পূবালী, মিডল্যান্ড, ঢাকা, ট্রাস্ট, শাহ্জালাল ইসলামী ও ইস্টার্ণ ব্যাংকও উপশাখায় গুরুত্ব দিয়েছে। মূলত ব্যাংকগুলো এখন কম খরচে মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য উপশাখায় জোর দিয়েছে। একই সঙ্গে শাখার বিকল্প হিসেবে ব্যাংকগুলো উপশাখায় এখন ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অ্যাপভিত্তিক লেনদেন, এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো ডিজিটাল সেবায় জোর দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও কম খরচের এসব সেবাকেন্দ্র খোলার প্রতি ব্যাংকগুলোকে উদ্বুদ্ধ করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের বলেন, সাধারণভাবে একটি শাখা খুলতে ব্যাংকগুলো দুই ও তিন হাজার এমনকি ছয় হাজার বর্গফুট পর্যন্ত জায়গা নেয়। উপশাখার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক হাজার বর্গফুটের সীমা দেয়া হয়েছে। ফলে একটি উপশাখায় এসি লাগালেও একটি হলেও চলে। উচ্চ সাজসজ্জারও দরকার হচ্ছে না। এতে করে ব্যাংকের খরচ দুই-তৃতীয়াংশে নেমেছে। যে কারণে দ্রুততম সময়ে একটি শাখা লাভজনক পর্যায়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চায় প্রতিটি বড় শিল্পকারখানা ও বস্তির সঙ্গে একটি করে উপশাখা হোক। এতে ব্যাংক ও শিল্পকারখানা উভয়ে লাভবান হবে। কারখানার বেতনসহ সব ধরনের লেনদেন ওই উপশাখার মাধ্যমে করা যাবে। অন্যদিকে শ্রমিকরা এক দিনে সব টাকা তুলে নেবে না। অনেকে সঞ্চয় করবে। ব্যাংকে অর্থের প্রবাহ বাড়বে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কম খরচে উপশাখার এ ধারণার ফলে ব্যাংকগুলোর মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা কিছুটা কমছে। কেননা, আগে দেখা যেত রাজধানীসহ বড় শহরে একই এলাকায় একাধিক ব্যাংক শাখা খুলে একই গ্রাহকের পেছনে দৌঁড়াচ্ছে। ভালো কোনো গ্রাহক পেলেই সবাই তাকে ঋণ দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে পড়ে। তবে শাখা নেই- এরকম এলাকায় কম খরচে উপশাখা খোলার ফলে আর অসম প্রতিযোগিতার সুযোগ নেই। যে যার মতো করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এখন উপশাখার বেশিরভাগ গ্রামকেন্দ্রিক হওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন প্রকৃত ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছে। এ জন্য আগের মতো আর শুধু এনজিও, সমবায় কিংবা সেবার জন্য দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে না। পূর্ণাঙ্গ একটি শাখার মতোই যেখানে গ্রাহকরা ঋণ আবেদন, আমানত সংরক্ষণ, টাকা স্থানান্তর, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বিতরণসহ সব ধরনের সেবা পাচ্ছেন গ্রাহক।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান এবং এনসিসি ও মেঘনা ও এনসিসি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকে এখন লেনদেন করছেন। তবে এখনও অনেক মানুষ প্রকৃত ব্যাংকিং সেবার বাইরে আছেন। এসব লোককে সেবার আওতায় আনতে উপশাখা একটি বড় সম্ভাবনার জায়গা তৈরি করেছে। এক কথায় মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জনপ্রিয় মাধ্যম এটি। একটি শাখা খুলতে হয়তো শুরুতে এক কোটি টাকা খরচ করতে হতো। এখন তা ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকায় হয়ে যাচ্ছে। আবার কম লোকবল, স্বল্প ভাড়া ও কম ইউটিলিটি বিলে একটি শাখা চলছে। এতে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোরও সরাসরি ক্ষুদ্রঋণ, কৃষিঋণ বিতরণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটি যেন শাখার মতো না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে কোনো একটি ব্যাংক একটি বাজারে উপশাখা খোলার পর সবাই যাতে সেখানে হুমড়ি খেয়ে না পড়ে। এতে শাখার মতো অসম প্রতিযোগিতার বিষয়টি থেকে যাবে। এ জন্য উপশাখা অনুমোদনের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেখতে হবে আশপাশে আর শাখা বা উপশাখা আছে কিনা। এতে সাধারণ মানুষ প্রকৃত ব্যাংকিং সেবা পাবে। অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ বাড়বে।

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম আওলিয়া ইনকিলাবকে বলেন, দেশের সকল মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে ‘উপশাখা’ একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। এর মাধ্যমে গ্রামের মানুষ স্বাভাবিক ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছে। তিনি বলেন, দিনে দিনে উপশাখাগুলোতে ভালো সাড়া মিলছে।##



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ব্যাংক

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ