Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অধিকার সংগ্রামের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করতে হয়

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৩ মে, ২০২২, ১২:০৩ এএম

অনেকে বলে থাকেন, রাজার নীতিই রাজনীতি। যদি তাই হয়, তবে সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন কেন রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হয়? রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে গুলি খেয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছে তারা সবাই তো সাধারণ নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তান। যারা শাসন ও ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত সেই মন্ত্রী বা উচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের সন্তানদের রাজপথে স্লোগান দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করার ইতিহাস তো পাওয়া যায় না।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ শরীরে স্লোগান লিখে যে নূর হোসেন জীবন দিয়েছিল সে তো একজন খেটেখাওয়া মানুষের সন্তান। এরশাদের জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ষড়যন্ত্র করে নূর হোসেনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে ‘লাশের’ রাজনীতি করার জন্য। আমার প্রশ্ন সেখানে নয়। ষড়যন্ত্রের ভিকটিম বানানোর জন্য সম্পদশালী বা ক্ষমতাবান বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যারা প্রাণপাত করছে তাদের পরিবারের কোনো সন্তানকে খুঁজে পাওয়া যায় না কেন? নূর হোসেনকে জাতি স্মরণ রেখেছে তার আত্মত্যাগের জন্য। এ কথাগুলো বলার কারণ এই, রাজনীতি যদি রাজারনীতি বা রাজকেন্দ্রিক নীতি হয়ে থাকে তবে একই কারণে গরিবের সন্তানরা বারবার ভিকটিম হবে কেন?

যে শিশু জন্মগ্রহণ করেছে বা যে শিশু মায়ের পেট থেকে এখনো ভূমিষ্ঠ হয়নি বা যে মানুষটি মরে গেছে, কেউই রাজনীতির প্রভাবমুক্ত নয়। ক্ষমতার আকার, রকম, ধরন পরিবর্তন হলেও গোটা পৃথিবী বিভক্ত রয়েছে শাসক ও শাসিতের মধ্যে। আগে যেমন সম্পর্ক ছিল রাজা ও প্রজার মধ্যে। আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে ‘প্রজা’ প্রথার বিলোপ হয়েছে বটে, কিন্তু শোষণ-শাসনের কমতি ঘটেনি। রাজার পরবর্তী আসনে বসেছেন প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী প্রভৃতি। মানুষ জন্মগ্রহণ করে তার ভাগ্য নিয়ে। কেউ জন্ম নেয় দিনমজুরের ঘরে, কেউ বড় হতে থাকে পিতৃমাতৃহীন অবস্থায় বিভিন্নজনের দয়ার ওপর নির্ভর করে। আবার কেউ জন্ম নেয় সোনার চামচ মুখে নিয়ে। পৃথিবীতে বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে সম্পদের বৈষম্য এতই বেশি যে, কারো জীবন কাটে হাভাতে, ফুটপাথে খোলা আকাশের নিচে, অন্যদিকে কারো এতই সম্পদ যে অপচয় করলেও ঘাটতি পড়ে না। অথচ গণতন্ত্র ও সম্পদের সুষম বণ্টনের দাবিতেই একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য সম্পদের সুষম বণ্টনের কথাটি উল্লেখ নেই বটে, তবে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য’ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও স্বাধীনতার সুফল খেটে পাওয়া মেহনতি মানুষদের ঘরে পৌঁছেনি।

প্রতিটি মানুষ তার জন্মগত অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও সে অধিকার শাসকগোষ্ঠীর হাতে লুণ্ঠিত হচ্ছে । জন্মগত অধিকার আদায়ের জন্য নিপীড়িত-নিষ্পেষিত মানুষ যুগে যুগে আন্দোলন করে রক্ত ঝরিয়েছে, যার অন্যতম ঘটনা শিকাগো শহরের শ্রমিক আন্দোলন, যার প্রেক্ষিতে বিশ্বের মেহনতি খেটেখাওয়া মানুষ প্রতি বছর ১ মে শ্রমিক অধিকার দিবস উদযাপন করে। এমনি ধরনের অনেক রক্তক্ষয়ী আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে, কিন্তু শাসক দলের কারসাজির কারণে খেটেখাওয়া মানুষের কাক্সিক্ষত অধিকার বাস্তবায়িত হয়নি। শাসকশ্রেণীর অযাচিত শাসন-শোষণের প্রতিবাদে যুগে যুগে সাধারণ জনগণ আন্দোলন করেছে। নারীরা আন্দোলন করেছে। ছাত্র আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, নাগরিক আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন প্রভৃতি আন্দোলন করেছে। এসব আন্দোলন শাসকশ্রেণীকে নাড়া দিয়েছে বটে, কিন্তু শতভাগ সফলতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আসেনি। অন্য দিকে পৃথিবীতে অনেক আন্দোলন তথা অপশাসন, কুশাসন, স্বেচ্ছাচারিতা প্রভৃতির বিরুদ্ধে গণমানুষ তাদের কণ্ঠ উঁচু করলেও আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাত করে আন্দোলনকে নষ্ট করার অভিযোগও কম নেই। যারা আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাত করেছে তারা আন্দোলনেরই অংশীদার, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাদের মানসিক দাসত্বের কারণে শাসকগোষ্ঠী তাদেরই শাসন ও শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।

শাসকের বিরুদ্ধে অধিকার বঞ্চিতের আন্দোলন রহিত করে সংগ্রামের মাধ্যমে অধিকার আদায় করে নেয়ার অন্যতম সনদ বা The Magna Carta,, গৃহীত হয় ১২১৫ সালে, যার মাধ্যমে নাগরিক অধিকারের বিষয়টি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরপর ১৬২৮ সালে Petition of Rights ১৬৮৯ সালে Bill of Rights এর মাধ্যমে সাধারণ নাগরিক অধিকার আদায়ে আরো সোচ্চার হয়। ১৭৮৯ সালে French Declaration of the Rights of man and the Citizen এর ২ নম্বর অনুচ্ছেদে অধিকারবঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা লাভের পর বিশ্বব্যাপী অধিকারবঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলনের মাধ্যমে কতগুলো সনদ চালু করে। যেমন- (১) Universal Declaration of Human Rights 1948, (2) International Covenant on all form of Discrimination against Women (3) Invernational covenant on civil and Political Rights (4) Geneva Declaration of the Rights of the Child of 1924 (5) International covenanton on Economic, Social and Cultural Rightsপ্রভৃতি অধিকারসংক্রান্ত এসব সনদে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত সব রাষ্ট্র সম্মতি প্রদানপূর্বক স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু পরিতাপ ও দুঃখজনক এই যে, শাসকগোষ্ঠীই গণমানুষের জন্মগত অধিকার বাস্তবায়নে প্রধান প্রতিবন্ধক এবং এ প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের।

রাজনীতি ধরাছোঁয়ার বাইরে এমন একটি পদার্থ যার আকার, প্রকার ও গতি কখন কোন অবস্থা ধারণ করে তা অনুমান ও অনুভব করা খুবই কঠিন। কেউ কেউ বলেন, রাজনীতির স্বাদ বোঝা যেমন কঠিন, আবার রাজনীতির গতি নিয়ন্ত্রণ কোথায় কিভাবে হচ্ছে তার আগাম বার্তা দূরদর্শী জ্ঞানী ব্যক্তিরাও দিতে ব্যর্থ। রাজনীতির ব্যানারে শাসক হয়েছে স্বৈরাচার, অন্য দিকে রাজনীতি গণমানুষের অধিকার আদায়ের সোপান হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। তবে যুগে যুগে সাধারণ মানুষের অধিকার আদায় হলেও নদীতে যেমন চর পড়ে স্রোত বন্ধ হয়ে যায় তেমনি শাসকদের রাজনীতির বহিঃপ্রকাশে আদায়কৃত অধিকার কার্যকরণের ক্ষেত্রে সময়ের ধারাবাহিকতায় চর পড়ে মানুষ আবার অধিকারবঞ্চিত হয়ে পড়ে। এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় অধিকারবঞ্চিত মানুষের আর্তনাদের পরিবর্তে উচ্চকণ্ঠে।

রাষ্ট্রগুলো কোথাও কোথাও অনেক আইন প্রণয়ন করে, যা মানবাধিকারের পরিপন্থী। এ মর্মে রাষ্ট্রের বক্তব্য এই যে, জননিরাপত্তা বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। রাষ্ট্রের পক্ষে সরকার আইন প্রণয়ন করে এবং অণুবীক্ষণিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর বেশির ভাগই করা হয়ে থাকে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নিরাপত্তার জন্য। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লালন করে সরকার। আর সরকার ও সরকারি মেশিনারিকে পাহারা দেয় ওই বাহিনী। ফলে উভয়ে উভয়ের স্বার্থ রক্ষার্থে যা করার তাই করে। আর অধিকারবঞ্চিত হয় সাধারণ জনগণ। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ মোতাবেক জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। এই রাষ্ট্রের মালিকানা এখন চলে গেছে সরকার ও তাদের রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

Show all comments
  • jack ali ২৩ মে, ২০২২, ১১:১৯ এএম says : 0
    যতদিন না আমাদের দেশ কোরআন দিয়ে শাসিত হবে ততদিন আমাদের কে গুম করা হবে খুন করা হবে ধর্ষণ করা হবে আমাদের কষ্টের অর্জিত ট্যাক্সের লক্ষ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করা হবে প্রতিদিন গুন্ডারা কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করবে ওরা কথায় কথায় মানুষকে হত্যা অথবা পিটিয়ে মারবে
    Total Reply(0) Reply
  • jack ali ২৩ মে, ২০২২, ১১:২৪ এএম says : 0
    আমরা মুসলিম হয়ে গণতন্ত্রের কথা বলি মানব রচিত আইন আছে আল্লাহর কাছে তাহা হারাম শুধু হারাম না তারা যদি সেটা বিশ্বাস করে তাহলে তারা কাফের চৌদ্দশ 50 বছর আগে শ্রমিকদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে তাদের ঘাম শুকানোর আগেই তাদের তাদের মজুরি দিয়ে দাও কিছু বেশি দিয়ে দাও
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন